এমন সময় বয়স্ক মহিলার রূপ ধারণ করে এক ডাইনি রাজার সামনে এলো।

 






অনেকদিন আগের কথা। এক রাজার গল্প বলছি, তার শখ ছিল ঘোড়ায় চড়ে শিকার খোঁজা। একবার ঘোড়ায় চেপে শিকার করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে সেদিকে খেয়ালই করেননি। পেছনে তাকিয়ে দেখেন ভৃত্যরাও তার পাশে নেই। রাজা ভৃত্যদেরকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন। কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাজা বুঝে গেলেন তিনি ভৃত্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।

এমন সময় বয়স্ক মহিলার রূপ ধারণ করে এক ডাইনি রাজার সামনে এলো।
দূর থেকে ঘোড়ায় চড়ে তাদের বাবার মতো কাউকে আসতে দেখে রাজার ছয় ছেলে আনন্দে দৌড়াতে দৌড়াতে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসতেই ডাইনির মেয়ে তাদের ওপর জাদুর কাপড় ছুঁড়ে দিলে তারা ছয়খানা রাজহাঁস হয়ে বনের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। ডাইনির মেয়ে জানতোও না যে, রাজার সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে ছয় ছেলে দৌড়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু তাদের ছোট বোন তখনো দুর্গের মধ্যেই ছিল।
রাজা সেই বনের ভেতর দিয়ে দুর্গে এসে পৌঁছালেন তার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে দেখার জন্য। এসেই তো রাজা হতবাক! তার সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে শুধু ছোট মেয়ে রয়েছে। ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করায় সে তার বাবাকে সবিস্তারে জানালো। তার ভাইয়েরা কেমন করে রাজহাঁস হয়ে উড়ে গেছে গভীর বনের দিকে। জানালা দিয়ে সে দেখেছে তার ভাইদের রাজহাঁস হয়ে উড়ে যাওয়া। এমনকি রাজহাঁস হয়ে উড়ে যাওয়ার আগে তাদের ডানা থেকে খসে যাওয়া পালকও সে কুড়িয়ে রেখেছে রাজাকে দেখাবে বলে।
পালক হাতে নিয়ে রাজা পুরো ঘটনার সত্যতা বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে দুর্গের সামনের চাতালে বসে পড়লেন, আর ভাবতে লাগলেন তার একমাত্র মেয়ের কথা। এদিকে, রাত হলে দুর্গের মধ্যে একা থাকতে থাকতে ছোট মেয়েটার ভীষণ ভয় করতে লাগলো। তার মনে হতে লাগলো ভাইদের ছাড়া সে থাকতে পারবে না। সে রাতেই বনের অন্য প্রান্তে বেরিয়ে গেল, যেদিকে তার ভাইয়েরা রাজহাঁস হয়ে উড়ে গেছে।
সন্ধ্যা নামার খানিক আগেই বনের ভেতর সে একটি পোড়াবাড়ি দেখতে পেল। চুপিসারে বাড়িটির কাছাকাছি আসতেই তার চোখে পড়ল ঘরের ভেতর ছয়টি ছোট ছোট খাট। সন্ধ্যা নামার একটু আগেই ডানার ঝটপট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ খুলতেই সে দেখলো ছয়টি রাজহাঁস কোথা থেকে উড়ে এসে জানালার ধারে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই তাদের সব ডানা খুলে পড়ে যেতেই ছোট মেয়ে অবাক হয়ে গেল রাজহাঁসের জায়গায় তার ছয় ভাইকে দেখে। ছোট মেয়েটি কেঁদে উঠলো, সে তার দাদাদের বললো, তোমরা এই যাদুমন্ত্র থেকে মুক্ত হতে পারো না?
তখন তার দাদারা বললো, রাজহাঁস থেকে মুক্ত করার একটিই উপায়, আর তা হলো ছয় বছর ধরে তাদের ছোট বোন কোনো কথা বলতে পারবে না, হাসতেও পারবে না। আর এই ছয় বছরে তাদের জন্য সাদা ঘাসের ছয়টি ছোট ছোট জামা তাকে বানাতে হবে। জামা বানাতে বানাতে এই ছয় বছরের মধ্যে যদি একটিও কথা সে বলে ফেলে কিংবা হেসে ফেলে একটুও তাহলে আবার শুরু থেকে তাকে জামা বানাতে হবে।
সে ওই পোড়াবাড়ি ছেড়ে বনের দিকে ফিরে গেল। যেতে যেতে যেতে অনেক দূরে একটি বড় গাছের নিচে এসে সে বসে পড়ল, আর অনেক সাদা ঘাস এরইমধ্যে সে জোগাড় করেছে। সেই ঘাস দিয়ে এক মনে জামা বানাতে লাগলো। ঠিক করলো মুখে একটিও শব্দ করবে না, আর হাসবেও না ছয় বছরের জন্য, যতক্ষণ না দাদাদের জন্য সে ঘাসের জামা তৈরি করতে পারছে।
সেই গাছের নিচে বসে ঘাসের জামা বানাতে বানাতে রাজকন্যার অনেকদিন কেটে গেল। এরমধ্যে রাজকন্যা আরো বড় হয়ে গেছে, দেখতেও ভারী সুন্দর হয়েছে। এমন সময় একদিন পাশের রাজ্যের রাজা শিকারে এলেন সেই বনে। তার দলবল শিকার করতে করতে সেই গাছের কাছে এসে পৌঁছালো, আর সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখতে পেয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করলো। রাজকন্যা দাদাদের জন্য জামা সেলাই শেষ না করে কথা বলতে পারবে না তাই শুধু মাথা নাড়লো। কিন্তু তাতে কিছুই বুঝতে না পেরে রাজার দলবল তার সর্ম্পকে আরো জানতে ইচ্ছুক হলো। তারা আবার তাকে জিজ্ঞেস করলো, সে কোথায় থেকে এসেছে, কোথায় যাবে। কিন্তু রাজকন্যা একটিও শব্দ করলো না। তাকে তারা ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে এলো রাজার দরবারে।
রাজা তাকে দেখেই অনেক প্রশ্ন করলো তার সর্ম্পকে, কিন্তু সব প্রশ্নেতেই রাজকন্যাকে চুপ থাকতে দেখে রাজারও ভীষণ মায়া হলো। আর রাজা ঠিক করলেন মেয়েটিকে তারই কাছে রাখবেন। এদিকে, রাজকন্যা দেখতেও ছিল খুব সুন্দর, আর রাজপুরীর সুন্দর সুন্দর সাজগোজে তাকে দেখতে আরো সুন্দরী লাগছিল। রাজা ঠিক করলেন এমন মেয়েই রাজরাণী হওয়ার যোগ্য।
রাজার মা ছিলেন ভীষণ চালাক আর বদমাশ। কিছুদিন পর রাজকন্যা তার প্রথম সন্তানের জন্ম দিলেন। রাজার মা যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সন্তানের জন্মের পর রাজার মা রাণীর কাছ থেকে তার ছেলেকে চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন। আর রাজাকে এসে বললেন, রাণী তার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন।
রাজা অন্দরমহল থেকে রাণীকে ডেকে পাঠালেন সবিস্তার ঘটনা জানার জন্য। কিন্তু মুখ থেকে একটিও শব্দ উচ্চারণ করলেন না রাণী। রাজা এবার পুত্র শোকে রেগে গিয়ে রাণীকে দোষী সাব্যস্ত করলেন, আর তার শাস্তিস্বরূপ আগুনে পুড়ে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন।
দেখতে দেখতে মৃত্যুদণ্ডের দিন হাজির। আর সেদিনই আসলে সেই ছয় বছর ধরে কোনো কথা না বলে, এতোটুকু না হেসে রাজকন্যার সাদা ঘাসের জামা বানানোর শেষ দিনও ছিল। ছয়টি জামাও তার বানানো হয়ে গিয়েছিল। তাই যখন রাজকন্যাকে রাজার আদেশ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের জন্য ওপরে আনা হলো তখন তার হাতে করে সে ওই ছয়টি জামাও নিয়ে এসেছিল। আর সারাক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল কখন সেই ছয়টি রাজহাঁস উড়ে আসে।
এদিকে, ঠিক যখন রাজার আদেশ অনুযায়ী নিচে আগুন ধরানো হবে তখনই সেই ছয়টি রাজহাঁস উড়ে এসে রাজকন্যার কাঁধে রাখা জামার কাছে এসে তাদের ডানার পালক ঘসলো। আর সাথে সাথেই তাদের সব পালক খসে গিয়ে রাজহাঁসের ভেতর থেকে সুন্দর ছয় ছয়টা রাজপুত্র বেরিয়ে এলো।
রাজা তো এসব দেখে অবাক! রাজার হুকুমে রাণীকে নিচে নামিয়ে আনা হলো, আর তারপর সে নিজে সমস্ত কথা রাজাকে খুলে বললেন।
রাজকন্যার দাদাদের ওপর থেকে সেই জাদুর মায়াও কেটে গেল। তারা আবার ফিরে পেল তাদের আগের চেহারা। আর তার সাথেই শেষ হলো তাদের দুঃখের জীবন। এরপর থেকে সেই রাজা-রাণী আর তার ছয় ভাই ওই রাজ্যে সুখে স্বাচ্ছন্দে দিন কাটাতে লাগলো।