রক্ত সাধনা (ভৌতিক উপন্যাস)

Table of Contents
-----




রক্ত সাধনা (ভৌতিক উপন্যাস) – মোশতাক আহমেদ

[প্রথম ফ্লাপ

পিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল লিমন। একজন নারী এতটা সুন্দরী কীভাবে হতে পারে? অথচ সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি পিয়ার মধ্যে কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে। যখন বুঝতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পিয়া তাকে বশ করে ফেলেছে। বার বার চেষ্টা করেও এড়িয়ে যেতে পারছে না তাকে। বরং তাকে রক্তসাধনায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য করে ফেলেছে। শুধু কী তাই? দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে ভালোবাসার ইমার কাছ থেকে। একসময় পিয়া তাকে বিয়ে করবে বলে প্রস্তাবও দেয়। তাও আবার অমাবস্যার রাতে। রাজি হয় না লিমন। কিন্তু পিয়া নাছোড়বান্দা। লিমনকে বিয়ে করে সে রক্তসাধনা করবে, উৎসব করবে রক্তপানের। তারপর তারা দুজনে হবে সুখী, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী। লিমন সবকিছু বুঝতে পেরে পিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পারে না। কারণ পিয়াকে স্বাভাবিকভাবে হত্যা করা সম্ভব নয়। পিয়াকে হত্যা করতে হলে তার নিজেরও মৃত্যু হবে। কী করবে সে এখন? এদিকে অমবস্যার রাত চলে এসেছে। বিয়ের দিন ক্ষণ সব প্রস্তুত। প্রস্তুত রক্তপানের জন্য বন্দি করে রাখা অজানা এক নারী।

শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল লিমনের জীবনে? সত্যি কী সে মুক্ত হতে পেরেছিল রক্তপিপাসু পিয়ার কাছ থেকে? নাকি সারাটা জীবন রক্তপানে মগ্ন থাকতে হয়েছিল?]

রক্তসাধনা – মোশতাক আহমেদ
অনিন্দ্য প্রকাশ

রক্তপ’ ও কিছু কথা

এই উপন্যাসে ‘রক্তপ’ নামের একটি শব্দ আমি ইচ্ছে করে ব্যবহার করেছি। ‘রক্তপ’ কোনো আভিধানিক শব্দ নয়। আমি নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছি। যে সকল মানুষ অন্য মানুষের রক্ত পান করে তাদের ‘রক্তপ’ বলেছি। উপন্যাসটি লেখার সময় এরকম একটি শব্দের আমার খুব প্রয়োজন ছিল। এই শব্দটি পরিবর্তনযোগ্য নয়।

রক্ত সাধনা বইটি ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখে শুরু করেছিলাম। সেদিন ছিল ভ্যালেন্টাইনস্ ডে অর্থাৎ ভালোবাসা দিবস। বইটি শেষ হয় ১৪ এপ্রিল ১০১৭ তারিখে। এই দিন পহেলা বৈশাখ। কাকতলীয়ভাবে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিনে বই শুরু ও শেষ হয়। এর পিছনে কোনো কারণ আছে কিনা জানি না। হতে পারে বইটি ভৌতিক বলেই এমন হয়েছে। তবে এরকম মিল পাওয়াটা আমার খুব ভালোলেগেছে। কারণ আমি প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস লিখি। এই উপন্যাসগুলোর ঘটনা মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ ঘটনাগুলো প্রকৃতিতে ঘটে। আমার এই উপন্যাসের শুরু আর সমাপ্তির মিল হয়তো ঐরকম অতিপ্রাকৃত কিছু যা পাঠকরা কখনো বিশ্বাস করতে চাইবে না।

উৎসর্গ

২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমার এক কিশোর পাঠক খুব অনুরোধ করে বলেছিল তাকে যেন আমি একটি বই উৎসর্গ করি। আমি তার নাম লিখেও রেখেছিলাম। কিন্তু কোথায় লিখেছিলাম তা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি নিশ্চিত আমার ঐ পাঠক আগামী বছর এসে জানতে চাইবে আমি তাকে কোনো বই উৎসর্গ করেছি কিনা। তখন তার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। সে ক্ষমা না করলে হয়তো এই উপন্যাসটি দেখিয়ে বলতে হবে, ‘আমি তোমার নামেই উপন্যাসটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নামটা মনে ছিল না, ক্ষমা করো।’

শহীদ চোখ মেলে তাকাল। তার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। তারপরও সে দেখতে পাচ্ছে মেয়েটিকে। বয়স কত হবে? ছাব্বিশ সাতাশ কিংবা কিছুটা বেশি। দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু মন মোটেও সুন্দর না। এক কথায় ভয়ংকর। মেয়েটির বাহ্যিক চেহারার আড়ালে যে পৈশাচিক রূপ রয়েছে তা কেউ জানে না। জানলে নিশ্চিত শিউরে উঠবে। সে নিজেও জেনেছে, তবে অনেক দেরিতে। এত দেরি যে এখন আর তার কিছু করার নেই।

শহীদ মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তাকে কফিনের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। পা দুটো আংটার সাথে লাগান। হাত দুটো কোথায় ঠিক দেখতে পাচ্ছে না, তবে অবশ হয়ে আছে। চাইলেও নাড়াতে পারছে না। সে ভাবল, সে চিৎকার করবে। তাও পারল না। তার মুখ বাঁধা। শুধু বাঁধাই না, এমন শক্তভাবে বাঁধা যে জিহ্বা পর্যন্ত নাড়াতে পারছে না। কতদিন ধরে সে এভাবে আছে বলতে পারবে না। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে আসে আবার হারিয়ে যায়। তাকে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত দেয়া হয় না। মৃত্যুর এখন সে খুব কাছাকাছি। কারণ তার শরীরের রক্ত নিঃশেষ হয়ে আসছে। তাকে আর ওদের প্রয়োজন নেই। এজন্য ওরা আর তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না।

ওরা কারা? প্রথমে কিছুই জানত না শহীদ। ধীরে ধীরে জেনেছে। জানার পর থেকে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। কারণ ওদের হাত অনেক লম্বা, ওদের ক্ষমতাও অনেক বেশি। একবার ওদের বেড়াজালে পা দিলে আর মুক্তির উপায় নেই। মৃত্যুই একমাত্র গন্তব্য। সেই গন্তব্যের দিকেই ধাবিত হচ্ছে সে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

শহীদকে সারাদিন বিশেষভাবে তৈরি এক কফিনে বন্দি থাকতে হয়। এই কফিনের পাশেই ওরা রক্ত পান করে। চলে যাওয়ার সময় উপরের ঢাকনাটা নামিয়ে রেখে যায়। আবার যখন আসে ঢাকনাটা তুলে নেয়। তারপর তার শরীর থেকে রক্তপান করে। তার ধমনীর সাথে স্যালাইনের টিউবের মতো কয়েকটি টিউব লাগান আছে। বাইরের অংশ মুখের মধ্যে নিয়ে টান দিলে তাজা রক্ত মুখে চলে যায়। দৃশ্যটা এত বিভৎস যে না দেখলে বোঝান যাবে না। এই বিভৎস দৃশ্যটা শহীদ দেখতে চায় না। অথচ তাকে দেখতে হয়।

মেয়েটি একটি হলুদ শাড়ী পড়ে এসেছে। শাড়ীটি খুব পাতলা। এমনভাবে এরা শাড়ী পরে যে নিজেদের নান্দনিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার থেকে যেন শারীরিক সৌন্দর্য প্রদর্শনই মুখ্য থাকে। এজন্য সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে উঠতি বয়সী কোনো যুবক কিংবা তরুন। এরকম ফাঁদেই পা দিয়েছিল শহীদ। আর পা দিয়ে যে কী ভুল করেছে, আজ সে বুঝতে পারছে। এখন ঐ ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত করছে।

মেয়েটি কফিনের পাশে এসে বসেছে, মুখে হালকা হাসি। সামনে খানিকটা ঝুকে আসতে মেয়েটির চুল এখন এসে পড়েছে শহীদের মুখে। মিষ্টি একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল শহীদের। এই গন্ধটা পরিচিত। এরা যে মিষ্টি সুগন্ধীটা ব্যবহার করে তা যে কারো ভালো লাগবে। আগে তারও ভালো লাগত। কিন্তু এখন আর লাগে না। তাই সে মুখটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শরীর তার কেমন যেন একেবারে অবশ হয়ে আসছে।

এবার মেয়েটি স্যালাইনের সরু টিউবের মতো অংশটি হাতে তুলে নিল। তারপর বাইরের অংশ মুখের মধ্যে নিয়ে অনেকটা হুক্কা টান দেয়ার মতো টান দিল। শহীদের শরীরের রক্ত যখন মুখের মধ্যে পৌঁছাল তখন অদ্ভুত এক তৃপ্তির ঢেকুর তুলল মেয়েটি। মনে হলো পৃথিবীর সকল প্রশান্তি বুঝি শুধুই তার। তারপর টিউবে টান দিতেই থাকল। আর শহীদের তাজা রক্ত প্রবেশ করতে থাকল মেয়েটির মুখে। রক্তে মুখ ভর্তি হয়ে গেলে কিছুটা রক্ত মুখের পাশ থেকে গড়িয়ে পড়ল। ঐ রক্তটুকুও চেটে খেয়ে ফেলল মেয়েটি।

এরপর হঠাৎই যেন রেগে উঠল মেয়েটি। কারণ টিউবে আর রক্ত আসছে না। সে বেশ কয়েকবার মুখ দিয়ে জোরে জোরে টান দিল টিউবে। কিন্তু কোনো রক্ত এলো না। অতৃপ্ত মেয়েটির চোখ তখন লাল হয়ে উঠল। তারপর যেভাবে হঠাৎ রেগে উঠেছিল সেভাবে আবার ঠান্ডা হয়ে গেল। কারণ পিছনে দ্বিতীয় আর এক মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। চেহারা অস্পষ্ট হলেও তাকে দেখে চিনতে পারল শহীদ। ঐ মেয়েই তার সর্বনাশ করেছে। নিজের রূপ সৌন্দর্যের ফাঁদে ফেলে এখানে বন্দি করেছে তাকে। তারপর তার রক্তপান করছে। তাও একদিন, দুইদিন নয়, দিনের পর দিন ধরে। কী দুঃসহ জীবন! আর চিন্তা করতে পারছে না সে।

ঐ মেয়ে যখন কফিনের একেবারে পাশে এসে দাঁড়াল তখন ধীরে ধীর সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকল চোখের সামনে। এক সময় আর তাকিয়ে থাকতে পারল না শহীদ। তীব্র একটা ঝাকি দিয়ে চোখ দুটো চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।

শেষ রাতের দিকে শহীদের নিথর দেহটিকে তৃতীয় আরও এক মেয়েসহ মোট তিনজন পানিতে ডুবিয়ে দিল। কেউ জানল না যে শহীদ নামের একজন চিরতরে বিদায় নিয়ে গেল পৃথিবী থেকে।

বাড়িটি দোতলা না বলে আড়াই তলা বলা যেতে পারে। কারণ ছাদের উপর ছোট ছোট দুটো রুম রয়েছে। এরই একটি রুম ভাড়া নিয়েছে লিমন। একহাজার টাকা মাসিক ভাড়া। তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ঘরের এক কোনায় একটি খাট রয়েছে। অন্যপাশে একটি টেবিল। একটা আলনাও আছে। নিজের মতো করে রান্না বান্না করবে বলে ঠিক করেছে।

লিমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকস্ এর ছাত্র। থার্ড ইয়ারে পড়ছে। এতদিন ছিল এক মেসে। সম্প্রতি মেসের মালিক মেস ভেঙ্গে দেয়ার কারণে বেশ সমস্যায়ই পড়ে সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শ্যামপুরে এই রুমটি খুঁজে পেয়েছে। আগে তাকে দিতে হতো পাঁচশ টাকা, এখন দিতে হবে এক হাজার টাকা। সুবিধা হচ্ছে একা থাকতে পারবে এবং নিজের মতো পড়াশুনা করতে পারবে। আগের মেসে পড়াশুনার কোনো পরিবেশ ছিল না। এক রুমে ছিল আটজন। সারাদিন মানুষ আসা যাওয়া করতে থাকত। যার ফলে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়া সম্ভব হতো না। এখানে এই ঝামেলা নেই। তাছাড়া দুটো বড়তি সুবিধা আছে। এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ও কাছে। আগে ছিল কদমতলীতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করতে বেশ সময় লেগে যেতে। এখন অতটা লাগবে না। বাড়তি আর একটা সুবিধা হচ্ছে যে বাসায় সে টিউশনি করে সেই বাসাটাও এখান থেকে কাছে। তার ছাত্রের বাসা যাত্রাবাড়ি। ক্লাস সিক্সে পড়ে। মাস ছয়েক হলো এই টিউশনিটা সে পেয়েছে। বাসার সবাই খুব ভালো। তাছাড়া তাকে সম্মানীও দেয় ভালো। সাড়ে চার হাজার টাকা। এই টাকা থেকে বাসা ভাড়া এক হাজার টাকা খরচ করা তার জন্য সমস্যা নয়। একটু ভালোভাবে থাকতে হলে কিছু খরচ তো করতে হবে। এই নীতিতে বিশ্বাসী সে। এজন্য দোতলার উপর ছাদে ছোট্ট এই রুম ভাড়া করতে বেশি সময় ব্যয় করেনি।

বাড়ির মালিক জিন্নাত আলী কাচামালের ব্যাপারি। সে এখানে থাকে না। সূত্রাপুরে কোথায় যেন থাকে। সে এই পুরো বাড়িটি ভাড়া দিয়েছে। নিচ তলায় আলুর গুদাম। দোতলায় জিন্সের প্যান্ট তৈরির ফ্যাক্টরি। সারাদিন ছেলেমেয়েরা সেলাইমেশিনে কাজ করে। ছাদের উপর অতিরিক্ত দুটো রুম বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে। জিন্নাত আলী মানুষ হিসেবে ভালো, এক কথার মানুষ। প্রথমে এক হাজার টাকা বলেছে তো সেই এক হাজার টাকাই ভাড়া। আর কমায়নি। জায়গার তুলানায় ভাড়া কম। ইচ্ছে করলে সে সহজে পনেরশ’ টাকা ভাড়া দিতে পারত। কিন্তু তা করেনি। মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে হবে, এটাই তার নিয়ম। এতে কোনো সমস্যা নেই লিমনের। সে বরং খুশি। কারণ তাকে অতিরিক্ত ইলেকট্রিক কিংবা পানির বিল দিতে হবে না। আজকাল বাড়িওয়ালাদের নানা শর্ত থাকে। এ ধরনের কোনো শর্ত নেই জিন্নাত আলীর। এজন্য জিন্নাত আলীকে তার পছন্দ হয়েছে।

লিমন নতুন এই বাড়িতে উঠেছে গতকাল সন্ধ্যায়। পাশের রুমে কাউকে সে দেখেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস শেষে ছিল টিউশনি। সন্ধ্যায় ফিরে আসতে দেখল পাশের রুম খোলা। কে আছে জানার জন্য দরজায় উকি দিল। ভিতরে এক যুবককে দেখল রান্না বান্না করছে। সে সালাম দিতে যুবক মুখ তুলে বলল, কে?

আমি লিমন। পাশের রুমে উঠেছি।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। এসো, এসো, ভিতরে এসো।

লিমন রুমের মধ্যে প্রবেশ করলে যুবক বলল, আমার নাম সজল। একটা ওষুধ কোম্পানিতে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কাজ করি। জিন্নাত চাচা তেমার কথা আমাকে বলেছে। তুমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো, তাই না?

জ্বি ভাইয়া।

আমি আগেই শুনেছি। বয়সে আমার থেকে তুমি ছোট হবে। এজন্য তোমাকে তুমি করে বলছি। মনে কষ্ট নিও না।

না ভাইয়া, না। কী যে বলেন?

তুমি পাশে ঐ চেয়ারটায় বসো। আজ আমার সাথে খাবে।

আমি বাইরে খেয়ে নেব।

না না, তা কীভাবে হয়? আমি আজ খিচুড়ি রাঁধছি। খিচুড়ি আমার খুব প্রিয়। বিশেষ করে সবজি খিচুড়ি। ভিতরে টমেটো, কুমড়া, আলু আর পুইশাক দেয়া। একটু ঝোল ঝোল থাকবে। দারুন লাগবে খেতে। আমি নিশ্চিত তুমি পছন্দ করবে।

আপনার কথা শুনেই খেতে ইচ্ছে করছে।

এজন্যই বলছি আমার সাথে খাবে। খিচুড়ি খাবে ডিম দিয়ে। বেশি করে পিয়াজ মরিচ দিয়ে জমিয়ে ভাজব। ভাজা ডিমের রঙ হবে পোড়া ইটের মতো। তুমি..

ভাইয়া আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি খাওয়া দাওয়া আপনার খুব প্রিয়।

অতটা প্রিয় না। আসলে সারাদিন বাইরে বাইরে খাই। ভালো লাগে না। সময় পেলে বাসায় রাঁধি। রান্নাটা আমি বেশ আনন্দ নিয়ে করি। কারণ নিজের ইচ্ছেমতো খাওয়া যায় সবকিছু। তবে এটা সত্য আমার রান্না খারাপ না। তুমি মজা পাবে।

আপনি রাঁধবেন আর আমি খাব, এটা কী ঠিক হবে?

ঠিক বেঠিকের কিছু নেই। আজ আমি রাঁধছি তুমি খাবে, আর আগামীকাল তুমি রাঁধবে, আমি খাব। তবে যদি কাজ করতে চাও তাহলে আলু ছিলতে পারো। পারবে?

হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি তো আমার নিজের রান্না নিজেই করব ভাবছি।

চমৎকার। আর হ্যাঁ, কোনো সাহায্য লাগলে আমাকে বলবে।

তা তো বলবোই। আপনার সাহায্য ছাড়া আমি এখানে থাকবো কীভাবে?

সজল খিচুড়ির চালে নাড়া দিয়ে বলল, আমাকে অবশ্য বেশিদিন এখানে পাবে না।

কেন?

এ মাসেই বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে আসতে হবে। নতুন বাসাও খুঁজে রেখেছি।

তাই নাকি! অভিনন্দন আপনাকে।

ধন্যবাদ তোমাকে।

তহালে তো আপনার বাসায় বেড়াতে যেতে হবে।

সবসময়ই তোমার আমন্ত্রণ থাকবে।

বাসা নিয়েছেন কোথায়?

গাজিপুরে

গাজীপুর কেন?

ওখানে আমার বদলী হয়েছে।

ও আচ্ছা।

আগামী কিছুদিনের মধ্যে যোগদান করতে হবে। কবে যেতে হবে এখনো ঠিক হয়নি। সাত দিনও হতে পারে। আবার বিশ পঁচিশ দিনও লাগতে পারে। এই অফিসের কিছু হিসেব নিকেশ আছে। সব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর যাব। তার আগে ছোট্ট একটা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হবে।

কীসের প্রশিক্ষণ?

আমাদের কোম্পানিতে কারো প্রমোশন হলে তাকে দুইদিনের একটি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ঐ প্রশিক্ষণের কথা বলছি।

লিমন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, আপনার প্রমোশন হয়েছে?

হয়নি এখনো। তবে হয়ে যাবে। জিএম স্যারের কাগজ স্বাক্ষর করা বাকি আছে।

আপনি তো দেখছি খুব পোশাদার।

তা না হলে এত দ্রুত প্রমোশনের প্রস্তাব যেত না। যাইহোক, তোমার কথা বলো। কেমন লাগছে এখানে?

ভালো, কেবল তো একরাত কাটালাম।

জায়াগাটি তোমার ভালো লাগবে। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী। সন্ধ্যার পর এই নদীর উপর দিয়ে আসা দখিনা বাতাসের আবেশ তুমি কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। এই বাতাসের ভলোলাগার গভীরতা এতে বেশি যে, তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হলে বেশ কষ্ট পেতে হবে। আমারও এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না। মূল কারণ নদী আর জোছনা। জোছনা রাতে বুড়ীগঙ্গাকে এত সুন্দর লাগে যে তোমাকে বোঝাতে পারব না। দেখবে, তোমার শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

তারপরও আপনি চলে যাচ্ছেন।

উপায় নেই। চাকরির কারণে মাঝে মাঝে ভালোলাগাকে উপেক্ষা করতে হয়। আমার এই চলে যাওয়া ঐরকমই কিছু।

আমার এই রুমে আগে যে ছিল সে কোথায় গিয়েছে?

আমি জানি না। ছেলেটির নাম ছিল রুবায়েত। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সহকারী ক্যাশিয়ারের চাকরি করত। খুব সুন্দর ছিল দেখতে। স্বভাবেও ছিল ভদ্র নম্র। আমার সাথে সম্পর্কও ভালো ছিল। শেষের দিকে কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছিল। কথা খুব কমই বলত। একা একা ছাদে হেঁটে বেড়াত। চেহারাটাও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। সম্ভত বিষণ্নতায় ভুগছিল। হঠাৎ তার এই পরিবর্তনের কারণ ছিল রহস্যময়। কারণ বের করার জন্য চেষ্টাও করেছি, কিন্তু পারিনি। তারপর একদিন সে নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুজি করেও পাওয়া যায়নি। মাসখানেক আগে তার বাড়ি থেকে দুসম্পর্কের এক মামা এসেছিল। তাকে তার মালামাল বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

কতদিন হলো সে নিখোঁজ?

তিন মাস হবে।

তিন মাস!

হু।

খুব বিস্ময়কর!

বিস্ময়করই বটে। আমি নিজেই হতবাক হয়ে গিয়েছি। তার কোনো শত্রু ছিল বলে আমার জানা ছিল না। আসলে রুবায়েতের মতো মানুষের কোনো শত্রু থাকতে পারে না। বিভিন্ন সময়ে আমি তার কাছ থেকে টাকাও ধার নিয়েছি। মৃত্যুর আগে সে আমার কাছে ছয় হাজার চারশ টাকা পেত। তার চাচাকে আমি টাকাটা দিয়ে দিয়েছি। রুবায়েত কিন্তু কখনো টাকা ফেরত চাইত না। এটা ছিল তার চরিত্রের অন্য এক বৈশিষ্ট্য। মানুষের কাছে টাকা দিলে মানুষ টাকা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে। কিন্তু রুবায়েতের মধ্যে সেরকম কিছু ছিল না। যাইহোক বাদ দাও রুবায়েতের কথা। তোমার কথা বলো। রুম গুছিয়েছ?

এখনো শেষ করতে পারি নি।

কিছুটা সময় তো লাগবেই।

হ্যাঁ, তা লাগবে। যে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে জানাবে আমাকে।

অবশ্যই জানাব।

চলো খেতে বসি। খিঁচুড়ি হয়ে গেছে।

ডিম ভাজতে সময় লাগল না। দুজনে একইসাথে খেতে শুরু করল। সজল খাটের উপর, আর লিমন চেয়ারে। প্রথম লোকমা মুখে দিয়েই লিমন বলল, অসাধারণ, দারুন হয়েছে।

স্বাদে ব্যতিক্রম কিছু কী পাচ্ছ?

হ্যাঁ, তেলটা মনে হচ্ছে সরিষার।

হু। সরিষা তেলের পাতলা খিচুড়ির মজাই আলাদা।

আপনি সত্যি অসাধারণ ভাই। রান্নায় যে আপনি অতুলনীয় সেটাও বুঝতে পারছি।

তোমাকে আমি আরও কিছু খাবার খাওয়াব। ওগুলো আমার স্পেশাল মেন্যু। আমি নিশ্চিত তুমি পছন্দ করবে।

আমি আপনার রান্না করা কোনো খাবার বাদ দিতে চাই না।

তাই হবে।

টুকটাক আরও কিছু কথা হলো দুজনের মধ্যে। প্রথম দিনেই সজলকে পছন্দ হয়ে গেল লিমনের। সজল যে এতটা আন্তরিক হবে কল্পনাও করেনি সে। তার এখানে অবস্থানটা যে আনন্দের হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই আনন্দ খুব অল্প সময়ের জন্য। কারণ সজল দ্রুত চলে যাচ্ছে।

গোছগাছ করার মতো লিমনের তেমন কিছু নেই। কিছু জামাকাপড়, আর বই, এই যা। বেশিরভাগই সাজিয়ে ফেলেছে। বাকি যা ছিল সেগুলো গুছিয়ে ফেলল। তরপর পর্দা হাতে নিল। আজ সে তিনটা পর্দা বানিয়েছে। একটি দরজার জন্য, অন্য দুটো জানালার জন্য। তার রুমে পূর্বে এবং দুক্ষিণে দুটো জানালা আছে। দক্ষিনের জানালাটা বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে ওটাতে পর্দা টানিয়ে পূর্বটিতে লাগাতে এলো সে। পূর্বের জানালার ওপাশে ঠিক তাদের এই বাড়ির মতোই আর একটি বাড়ি। বাড়িটি দোতলা। তবে দোতলা বাড়ির উপর দুটো রুম আছে। একটি রুমের জানালা তার রুমের পূর্বের জানালার ঠিক ওপাশে। দূরত্ব পাঁচ ফিট হবে। ওপাশে কে বা কারা থাকে জানা নেই তার।

জানালার পর্দা লাগানো শেষ করে লিমন যখন চলে আসেব, তখনই ওপাশে আলো জ্বলে উঠল। পাশের বাড়ির জানালায় সাদা পর্দা লাগান। পর্দার উপর একটি ছায়া এসে পড়েছে। ছায়াটা এক শাড়ী পরা মেয়ের। জানালা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিতে পারল না। কারণ ভিতরের মেয়েটি তার নিজের শাড়ী খুলতে শুরু করেছে এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ শাড়ীটি খুলে ফেলল। তারপর বাঁধা চুল ছেড়ে দিয়ে ডানে বামে মাথা ঝাকি দিল। লিমন একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। সে যে এরকম কিছু দেখবে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। এরই মধ্যে ব্লাউজও খুলতে শুরু করেছে ঐ মেয়ে। পর্দার উপর এসে পড়া ছায়াতে সবকিছু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। শরীর কাঁপতে শুরু করেছে লিমনের। সে সরে যওয়ার পরিকল্পনা করলেও সরে যেতে পারছে না। অজানা এক আকর্ষণ তাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং উঁকি দিতে বাধ্য করছে। এরমধ্যে অন্তর্বাস খুলতে শুরু করেছে মেয়েটি। আর থাকতে পারল না লিমন। পর্দা টেনে দিয়ে জানালার পাশ থেকে সরিয়ে নিল নিজেকে। এখন তার খুব ইচ্ছে করছে জানালার পাল্লা আটকে দিতে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। কারণ সে কেন যেন বিশ্বাস করছে, পাল্লা আটকাতে গেলে ঐ মেয়ের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে যাবে। তখন খুব বিব্রত অবস্থায় পড়তে হবে। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না।

সকালে লিমন ক্লাসে যাওয়ার আগে ভাবল সজলের সাথে কথা বলবে। সজলকে সে পেল না। দরজায় তালা মারা। অনুমান করল সকালেই সজল বের হয়ে গেছে। এরপর সে এলো নিচে। তাদের বাসার সামনে একটা হোটেল আছে। নাম গরম হোটেল। এই হোটেলের সব খাবার নাকি গরম দেয়া হয়। এজন্য নাম গরম হোটেল। কিন্তু বাস্তবে এখনে সবকিছু গরম থাকে না। তাকে যে ডাল দেয়া হলো তা ঠান্ডা। তবে রুটি গরম। গরম রুটি আর ঠান্ডা ডাল মন্দ লাগছে না তার।

গরম হোটেলের সামনের দিকের একটি টেবিলে বসেছিল লিমন। এখান থেকে চোখ পড়ল পাশের বাড়িটার উপর। এই বাড়ির তিন তলায় গতরাতে সে একটি মেয়েকে কাপড় পালটাতে দেখেছিল। দৃশ্যটা মনে হতে তার শরীরে কেমন যেন শির শির অনুভূতি বয়ে গেল। বাড়িটা অনেক পুরাতন। অধিকাংশ জায়গায় প্লাস্টার খসে লাল ইট বের হয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও ভিতরের পিলারের লোহা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কবে এই বাড়ি রঙ করা হয়েছে তা বোধহয় বাড়িওলাও বলতে পারবে না। বাড়ির দোতলায় একটি সাইনবোর্ড টানানো। সেখানে লেখা ‘পিয়া নৃত্য স্কুল’। এরকম জরাজীর্ন ভগ্নপ্রায় একটি বাড়িতে কীভাবে নাচের স্কুল হতে পারে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না লিমন। পাশাপাশি কেউ যে বাড়িটাতে থাকবে, সেটাও বিশ্বাস করার মতো নয়। তাকে বিনে পয়সায় এই বাড়িতে থাকতে দিলে সে থাকত না। অথচ অভিভাবকরা ঠিকই নৃত্য শেখার জন্য এখানে সন্তানদের পাঠাচ্ছে। বিষয়টা কেন যেন সে ঠিক মেনে নিতে পারছে না।

বাড়ির নিচে একটি লোহার গেট আছে। গেটটি ভিতর থেকে বন্ধ। লিমন যখন চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবে তখন খুলে গেল গেটটি। কী ঘটে দেখার জন্য আবার চেয়ারে বসল।

বাড়ির ভিতর থেকে একটি মেয়ে বের হয়ে এলো। বয়স সতের আঠার হবে। সালোয়ার কামিজ পরা। সে রাস্তা পার হয়ে এলো গরম হোটেলে। লিমনের থেকে এখন দূরত্ব খুব বেশি হলে পাঁচ ফুট হবে। মেয়েটি যুবক বয়সী ক্যাশিয়ার মোবারককে ছয়টি রুটি, তিনটি ডিম এবং গরম ডাল দিতে বলল।

লিমন সামনে যে মেয়েটিকে দেখছে এই মেয়েটি আর গতকাল রাতে দেখা মেয়েটি আলাদা। কারণ গতকাল সে যাকে দেখেছিল সে ছিল লম্বা। আর এই মেয়েটি কিছুটা খাটো। তবে ফর্সা এবং দেখতে সুন্দর। এরকম মেয়েকে যে কেউ দেখলে পছন্দ করবে। মেয়েটির চলে যাওয়ার সময় ক্যাশে বসে থাকা মোবারক বলল, নুপূর আর কিছু লাগবে?

মেয়েটি ডানে বামে মাথা নেড়ে বিল দিল। তারপর রওনা দিল বাড়ির দিকে।

লিমন বুঝতে পারল মেয়েটির নাম নুপূর।

গতকাল মোবারকের সাথে পরিচয় হয়েছে লিমনের। বয়সে মোবারক তার থেকে কয়েক বছর বড় হবে। এজন্য ভাই বলে সম্বোধন করে। বিল দেয়ার সময় বলল, মোবারক ভাই, ঐ বাড়িটা কী নাচের স্কুল?

হু।

কারা নাচ শেখে ওখানে?

আশেপাশের মানুষজন। দূর থাইকাও আসে।

কখন হয় নাচ?

মোবারক এবার সরু চোখে তাকাল। তারপর বলল, ক্যান তুমি শিখবা?

একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেল লিমন। তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমি শিখব কেন? এই

জানতে চাচ্ছিলাম আর কী?

নতুন আইসা এই বাড়ি সম্পর্কে জানবার চাইতেছ, এইডা তো ভালো লক্ষণ না।

আসি মোবারক ভাই।

আর দাঁড়াল না লিমন। রাস্তায় নেমে এলো। বাড়িটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে একবার তাকাল। তারপর দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। সে অনুমান করল, মোবারক তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে।

কলেজে ব্যস্ত সময় কাটাল লিমন। তারপর গেল টিউশনি করতে। টিউশনি শেষ করে ফিরে আসতে বিকেল হয়ে গেল। বাড়িতে প্রবেশের আগে ঢুকল গরম হোটেলে। দুপুরে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে খেয়েছে। এখন এখানে বসেছে নাস্তা করতে। যদিও তার তেমন ক্ষুধা নেই তারপরও সে নাস্তা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। নাস্তার অর্ডার দিল পুরি, আর চা।

নাস্তার ফাঁকে ফাঁকে লিমনের চোখ বার বার পিয়া নৃত্য স্কুলের দিকে চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে সে বলতে পারবে না। কেমন যেন বাড়িটির প্রতি অজানা এক আকর্ষণ অনুভব করছে সে।

লিমন যখন পুড়তে কামড় দিল তখন পিয়া নৃত্য স্কুলের গেট খুলে গেল। ভিতরে থেকে বাইরে এলো এক শ্যামলা মেয়ে। বেশ লম্বা মেয়েটি। পরনে লাল রঙের সালোয়ার কামিজ কানে দুটো দুল থাকার কারণে খুব সুন্দর লাগছে দেখতে। তবে লিমন নিশ্চিত এই মেয়েকে সে গত রাতে দেখেনি। দেখেছে অন্য কাউকে।

মেয়েটি কাউন্টারে এসে একটি ফ্লাক্স এগিয়ে দিয়ে বলল, মোবারক ভাই, তিন কাপ চা আর ছয়টি পুরি।

তুমি দাঁড়াও ঝুমুর, আমি দিচ্ছি।

লিমন বুঝতে পারল মেয়েটির নাম ঝুমুর

হঠাৎ মেয়েটি ডান দিকে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে গেল লিমনের সাথে। লিমন তাড়তাড়ি চোখ সরিয়ে নিল। সত্যি সে লজ্জা পেয়েছে। এতক্ষণ একদৃষ্টিতে দেখছিল মেয়েটিকে। অথচ নিজেই বুঝতে পারছিল না যে মেয়েটির দিকে সে তাকিয়ে আছে। ভুল করে তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিয়ে গরমে জিহ্বা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। মুখ থেকে চা ফেলা সম্ভব নয়, তাই কষ্ট হলেও গিলে ফেলল।

তার অবস্থা দেখে ঝুমুর খিল খিল করে হেসে দিল। ঝুমুরের হাসি এত সুন্দর যে লিমনের কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা শুনল সে। এদিকে মোবরক বলে উঠল, ঝুমুর একটু সময় লাগবে। তোমারে গরম পুরি ভাইজা দিতেছি। তুমি একটু বসো।

ঝুমুর যা করল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না লিমন। ঝুমুর এসে বসল তার সামনের ফাঁকা চেয়ারে। অপরিচিত এমন এক সুন্দরী মেয়ে সামনে বসলে কখনো চা খাওয়া সম্ভব নয়। তার উপর শরীর থেকে চমৎকার পারফিউমের সুগন্ধ আসছে। লিমনের মাথা ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। তার মনে হতো লাগল সে বুঝি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে।

বিস্ময়ের ধাক্কা তখনো শেষ হয়নি। ঝুমুর তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি গরম চা খেয়ে ফেলেছেন। একটু পানি খান, তা না হলে জিহ্বা পুড়ে যাবে। হয়তো এতক্ষণে পুড়েও গেছে।

লিমন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

কাউন্টারের পাশে একটা ফ্রিজ আছে। সেই ফ্রিজে অনেকগুলো পানির বোতল রাখা। ঝুমুর নিজে উঠে গিয়ে পানির বোতল নিয়ে এলো। বোতলের মুটকিও খুলি দিল সে। তারপর এগিয়ে দিল লিমনের দিকে।

লিমন পানি মুখে দিতে মনে হলো এরকম পানিই তার প্রয়োজন ছিল। পর পর তিনবার পানি খেল সে। তারপর অস্পষ্টভাবে বলল, ধন্যবাদ।

মিষ্টি হাসল ঝুমুর। তারপর বলল, আপনি আমাদের পাশের বাড়িতে উঠেছেন, তাই না?

লিমন অস্পষ্টভাবে বলল, জ্বি। কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে?

গতকাল আপনাকে আমি বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেছি।

ও আচ্ছা।

তো এখন কী অবস্থা? পানি খাওয়ার পর কী কিছুটা ভালো লাগছে।

হ্যাঁ।

ঝুমুর টেনে টেনে বলল, এভাবে গরম চা খাবেন না।

না আর খাব না। আ… আপনি কী ঐ বাড়িতে থাকেন?

আপনি তো আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখেছেনই। তাহলে আর প্রশ্ন করছেন কেন?

ইয়ে.. মানে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

আপনার ধারণা সত্য। ঐ নাচের স্কুলের বাড়িটাতে আমরা থাকি।

আমরা মানে আপনারা কতজন?

আমরা তিনজন।

তিন জনা।

এর মধ্যে মোবারক চায়ের ফ্লাক্স আর পুরি নিয়ে এসেছে। পুরিগুলো একটা ঠোঙায় মোড়ান। ফ্লাক্স আর পুরি হাতে নিয়ে ঝুমুর বলল, আসি তাহলে, আবার দেখা হবে।

মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়াল ঝুমুর। তারপর ক্যাশে বিল দিয়ে আবার ফিরে তাকাল। বলল, আমি কিন্তু পানির দাম দিয়ে দিয়েছি। আপনি আবার দেবেন না।

আপনি পানির দাম দেবেন কেন?

বলতে গিয়েও বলতে পারল না লিমন। দ্রুত বের হয়ে গেছে ঝুমুর। এখন সে রাস্তা পার হচ্ছে।

মোবারক ফিরে বসল লিমনের সামনে। রহসম্যয় কণ্ঠে বলল, কী ব্যাপার, প্রথম দিনেই তোমার সাথে এত আলাপ কেন ঝুমুরের?

.. আমি বলতে পারব না।

তোমারে মনে হয় পছন্দ কইরা ফেলায়ছে।

পছন্দ করার কী হলো?

তুমি মানুষটা দেখতে সুন্দর, এক্কেবারে নিস্পাপ টাইপের। তোমারে পছন্দ করবারই পারে। তয় আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নাই।

আপত্তির বিষয় আসছে কেন?

আমি পছন্দ করি কারে, জানো?

কাকে?

নুপূররে। ঐ যে সকালে আইছিল। দেখতে ফর্সা। ঝুমুর তো নুপূরের মতো ফর্সা না। এইজন্য নুপূরই বেশি সুন্দর। তাই না?

জ্বিন।

আমি তারেই পছন্দ করি। সকালে ভাবছিলাম তুমি তার দিকে নজর দিছ। এইজন্য তোমারে হালকা ধমক দিছিলাম। নুপূরের দিকে তুমি চোখ ফেলবা না। বুঝছ?

জ্বি।

তয় ঝুমুররে নিয়া আমার কোনো কথা নাই। তুমি ইচ্ছা করলে তারে নিয়া ভাববার পারো, তার সাথে প্রেম ভালোবাসাও করবার পারো।

এখানে প্রেম ভালোবাসার কথা আসছে কেন?

মোবারক মাথাটা ঝাকি দিয়ে বলল, না, তোমারে এখন সবকিছু বলব না। তোমার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হই তারপর। এমনিতেই বেশি বইলা ফেলায়ছি।

এরপর মোবারক ক্যাশে গিয়ে বসল। লিমন তাকে বিল দিতে গেলেও আজ নিল না। তার মন ভালো। এজন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে লিমনের কাছ থেকে সে আজ টাকা রাখবে না।

লিমন বেশ অবাকই হলো। আজ বিকেলে সে বেশ কয়েকবারই অবাক হয়েছে। আর কতবার অবাক হতে হবে জানে না। তবে তার নিজের মধ্যেও কেমন যেন ভালোলাগার একটা অনুভূতি কাজ করছে। ভালো লাগার এই অনুভূতি গরম চায়ে জিহ্বা পুড়ে যাওয়ার জ্বালা পোড়াকে সত্যি প্রশমিত করে দিল।

রাতে লিমন নিজেই রান্না করল। মেন্যু ভাত, ডাল আর ডিম। সজল এলে তাকেও আমন্ত্রণ করল। দুজনে খেতে বসলে নানা কথার মাঝে লিমন নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল, পাশের বাড়িতে কী নাচের স্কুল, সজল ভাই?

সজল মুখে একটা লোকমা তুলে বলল, হ্যাঁ।

কবে থেকে শুরু হয়েছে?

জানি না। আমি আসার পর থেকেই দেখছি।

কিন্তু নাচ তো হয় বলে হয় না। সারাদিনেও দেখলাম না।

শুধু শুক্র শনিবারে হয়।

কেন?

অন্যদিনগুলোতে বাচ্চাদের স্কুল থাকে। এজন্য বন্ধের দিনে হয়। সকাল থেকেই তবলা, হারমোনিয়াম আর নুপূরের শব্দ পাবে।

আহারে! শিশুগুলো শুক্রবারও ছুটি পায় না।

সজল উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ। জীবন এখন একেবারে রোবটিক হয়ে গেছে। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। কোনো বিশ্রাম নেই। আমাদের জীবনে শিশু কিশোরকাল অনেক মজার ছিল। ফাঁকা মাঠে ছুটে বেড়াতাম, বিকেলে ফুটবল খেলতাম, সময় পেলে সবাই মিলে বন্ধুরা আড্ডা মারতাম, এগুলো এখন আর নেই।

আপনি ঠিকই বলেছেন।

এখন বাচ্চাদের নাচ, গান, ছবি আঁকা, অভিনয়, ফ্রেঞ্চ শেখা, কম্পিউটার শেখা আরও কত কিছু যে শুরু হয়েছে তার হিসেব নেই। যাইহোক এগুলো মেনে নিতে হবে, যুগ যেভাবে চলবে সেভাবেই চলতে হবে সবাইকে। তা না হলে নিজের অবস্থান ধরে রাখা যাবে না। এখন তোমার কথা বলো। গত রাতে ঘুম হয়েছিল?

হ্যাঁ ঘুম হয়েছিল।

চমৎকার। আগে যে রুবায়েত ছিল, শেষের দিকে কেন যেন রাতে ওর ঘুম হতো না। মাঝে মাঝেই দেখতাম, সকালে দীর্ঘ সময় ঘুমাচ্ছে। কিছুটা বিষণ্নও থাকত।

বিষণ্নতার কারণ কী ছিল?

আমি জানি না। জিজ্ঞেস করলে বলত, সবকিছু ঠিকই আছে। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানো?

কী মনে হয়?

ও আত্মহত্যা করেছে।

কী বলছেন!

হ্যাঁ।

এরকম ধারণা হওয়ার করণ।

রুবায়েত একবার আমাকে বলেছিল সে আর বেঁচে থাকতে চায় না। পৃথিবীকে নাকি বড় নিষ্ঠুর মনে হয়।

এমন কথা বলত কেন?

আমার ঠিক জানা নেই। ওকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। শেষের দিকে তো কথা বলাও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম ওর আচরণে। তারপর হঠাৎই সে হারিয়ে যায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খুঁজেছিলেন?

আমি নিজে খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাইনি। রুবয়েত যেন একেবারে হওয়ায় মিশে গেল। যাইহোক, বাদ দাও রুবায়েতের কথা। তোমার রান্না কিন্তু খুব সুন্দর।

চেষ্টা করেছি।

খেতে দারুন লাগছে। আসলে জীবনে ছোট ছোট আনন্দগুলো অনেক বড় ভালোলাগার। অথচ এই আনন্দগুলোকে আমরা গন্য করি না। যদি গন্য করতাম তাহলে সবাই অনেক বেশি সুখী হতাম।

আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।

না, মুখ দিয়ে বলতে বলতে হয়ে গেছে। তোমার দিন কেমন কাটল?

ব্যস্ততা ছিল।

ব্যস্ততা থাকা ভালো।

আপনার কী অবস্থা?

চলে যেতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি। তবে কেন যেন যেতে ইচ্ছে করছে না। পিছনের ঐ নদীর হাওয়াকে খুব মিস্ করব।

নদীর পাশে একটি বাড়ি ভাড়া নেবেন।

নদীর পাশে বাড়ি কী চাইলেই পাওয়া যায়? তবে পেলে নিয়ে নেব। তোমাকে দাওয়াতও করব। তুমি কিন্তু আসবে।

অবশ্যই আসব।

এরপর চারদিকে তাকিয়ে সজল বলল, তুমি দেখি সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছ।

গুছানোর তেমন কিছু নেই। কিছু বইখাতা আর জামাকাপড়।

একপাশে একটা ফুলদানিও রেখেছ দেখছি। নতুন কিনেছ? জ্বি।

চমৎকার। তোমার রুচি আছে। এজন্যই তোমাকে আমি এত পছন্দ করি।

আপনাকে ধন্যবাদ।

খাওয়া দাওয়ার পর সজল তার রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো। তারপর লিমনের দিকে দুটো কমলা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নাও?

কমলা কেন?

আজ কিনেছিলাম। কমলা খেতে আমার খুব ভালো লাগে। দুটো তোমাকে দিলাম। আরও লাগলে জানিও।

লিমন লাজুক ভঙ্গিতে বলল, এর কোনো কী প্রয়োজন ছিল?

আরে নাও। তোমার বড় ভাই তোমাকে দিচ্ছে।

লিমন কমলা নিলে সুজল চলে গেল। লিমন হাড়ি পাতিল গুছিয়ে ফেলেছে। রান্না করতে গেলে সময় বেশি নষ্ট হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল এখন থেকে একবার রান্না করে কয়েকবেলা খাবে। নতুবা গরম হোটেল থেকে খাবার এনে খাবে।

এরপর পড়ায় মনোনিবেশ করল লিমন। ঘন্টাখানেকের মাথায় পূর্বপাশে একটা শব্দ তার মনোনোবিশে ব্যঘাত ঘটাল। পূর্ব পাশের জানালাটা বন্ধ। কারণ ওপাশে পাশের বাড়ির জানালা। গতকাল ঐ জানালায় সে এক নারীকে দেখেছিল। আজ সন্ধ্যা থেকে ইচ্ছে করেই জানালাটা বন্ধ করে রেখেছে যেন ঐ দিকে চোখ না যায়। এতক্ষণ কোনো শব্দ হয়নি। এখন হঠাৎ শব্দ হলো। লিমন জানালা খুলবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল।

পর পর আবার দুবার শব্দ হতে কী ঘটছে দেখার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠল লিমন। এ এলাকায় নাকি প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটে। বাড়িওয়ালা তাকে সতর্ক করে দিয়েছে। ঐরকম কোনো চোর কিনা এরকম ভাবনা থেকে জানালা খোলার সিদ্ধান্ত নিল সে। প্রথমে ধাক্কা দিয়ে দুই পাল্লার মাঝের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল। না তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। এরপর পুরো জানালা খুলে ফেলল। কিছুই চোখে পড়ল না। পাশের বাড়ির জানালাটা খোলা। তবে ভিতরে অন্ধকার হওয়ায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেউ আছে বলেও মনে হলো না লিমনের কাছে।

লিমন এবার জানালা দিয়ে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করল। না নেই, কেউ নেই। নিচে ও ফাঁকা। তাহলে শব্দ হলো কীসের? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সে খুঁজে পেল না। তবে অনুমান করল পাশের বাড়ির কেউ জানালাটা খুলেছে। কিন্তু খুললে ভিতরে আলো নেই কেন? আর অত শব্দ হবে কেন? এই প্রশ্ন দুটোর উত্তর সে খুঁজে পেল না।

ফোন বেজে উঠায় ফোনের কাছে ফিরে এলো লিমন। ফোন করেছে তার ছাত্র রানির খালা। নাম ইমা। ইমা আগে তাকে ফোন করত না। ইদানিং ফোন করছে। কয়েকদিন ধরে তার সাথে কথাও বলছে বেশি। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী ইমা। দেখতে শুনতে ভালো, স্বভাবে কিছুটা চঞ্চল। লিমনের ধারণা ইমা তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। এই পছন্দটা প্রেম জাতীয়। ইমার আচার আচরণে সেরকমই মনে হচ্ছে। ইদানিং রনিকে পড়ানোর সময় ইমা নিজে তার জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। লিমন অবশ্য তেমন কিছু বলে না। নিজের মতো থাকে। টিউশনি করে চলে আসে।

ফোন রিসিভ করতে ইমা বলল, কেমন আছেন?

ভালো। আপনি কেমন আছেন?

জ্বি, ভালো আছি। কেন ফোন করলাম জানেন?

কেন?

আগামীকাল আমরা একটু ব্যস্ত থাকব। আপনার আসা দরকার নেই।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আপা বোধহয় আপনাকে ফোন করবে। আমি আগেই বলে দিলাম। কেন বললাম

জানেন?

না জানি না।

যেন আপনি একটু বেশি সময় পান। আপা কখন ফোন করবে তা তো আর বলতে পারি না। হয়তো আগামীকাল দুপুরে। এতক্ষণ টিউশনিতে আসবেন এরকম একটা চিন্তা আপনার মধ্যে কাজ করত। এখন আর করবে না। আপনি চিন্তামুক্ত, তাই না?

আপনাদের ওখানে আসা, না আসা নিয়ে আমার অতটা চিন্তা নেই। আপনার মধ্যে তো কোনোকিছু নিয়েই চিন্তা থাকে না।

মানে?

আশেপাশের কোনোকিছু লক্ষ্য করেন আপনি?

কেন করব না?

না করেন না। করলে আপনি অনেক কিছু বুঝতে পারতেন। কী বলছেন আপনি?

বুঝে নিন। সবকিছু বলতে হবে কেন? আর আপনি এত কম বুঝেন কেন? একটু বেশি বুঝতে পারেন না।

এরপর লাইন কেটে দিল ইমা। লিমন ফোনটা রেখে দিয়ে জানালার দিকে তাকাতে বিস্মিত হলো। পাশের বাড়ির জানালার ওপাশে আলো জ্বলছে। তার মানে কেউ একজন এসেছে। আর যে এসেছে সে যে এক নারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ শাড়ী পড়ে সে এদিক ওদিক হাঁটছে। ছায়াটা স্পষ্ট এসে পড়েছে জানালার পর্দায়।

লিমন আর দেরি করল না। ধীরে ধীরে টেনে দিল জানালার পাল্লা। শেষ মুহূর্তে তার মনে হলো ঐ নারী জানালার একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার দিকে তাকিয়ে আছে।

কয়েকটি দিন লিমনের ব্যস্ততায় কেটেছে। পরীক্ষা ছিল। আজ পরীক্ষা শেষে হলে বেশ ক্লান্ত অনুভব করছে সে। রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। তাই গরম হোটেলে রাতের খাওয়া দাওয়া করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পাশের বাড়ির বিষয়ে আর নতুন কোনো ঘটনা ঘটেনি। লিমন জানে ওখানে মোট তিনজন থাকে। দুজনের নাম নুপূর আর ঝুমুর। তৃতীয়জন পিয়া হবে বলে তার ধারণা। কারণ নাচের স্কুলের নাম ‘পিয়া নৃত্যু স্কুল’। পিয়াকে কখনো দেখেনি লিমন। তবে সে অনুমান করেছে রাতে যাকে সে কাপড় পালটাতে দেখেছিল সে-ই পিয়া হবে। সম্ভবত তিন তলায় থাকে সে। এ বিষয়ে একবার মোবারককে জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টেছে। বেশি আগ্রহ দেখালে মোবারক আবার তার মুখের উপর কিছু বলে বসতে পারে।

আর একটা বিষয় অনুমান করছে লিমন। আর তা হলো মোবারক আর নুপূরের সম্পর্ক। সে লক্ষ করেছে নুপূর যখন দোকানে কিছু কিনতে আসে দুজন দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলে, অকারণে হাসাহাসি করে। মাঝে মাঝে মোবারক মূল্য নেয় না নুপূরের কাছ থেকে। তাদের দুজনের মধ্যে যে বিশেষ এক সম্পর্ক গড়ে উঠছে এ বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত সে।

রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে লিমন। সেক্ষেত্রে আগে খেয়ে নিতে হবে। এজন্য গরম হোটেলে চলে এলো। হোটেলে এখন তেমন কোনো কাস্টমার নেই। মোবারক অলস ভঙ্গিতে বসেছিল। রাতের খাবারের অর্ডার দিলে মোবারক নিজে থেকেই বলল, কী খবর লিমন?

ভালো মোবারক ভাই।

এত তাড়তাড়ি খাইতেছ যে?

আজ রান্না করতে ভালো লাগছিল না।

ও আচ্ছা। তো নতুন বাড়িতে কেমন সময় কাটতেছে?

ভালো। আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

খুবই ভালো।

হঠাৎ এত ভালো যে!

তুমি বুঝবা না। ছোট মানুষ তো।

আমি ছোট না, ভার্সিটিতে পড়ি।

তা অবশ্য ঠিক। তোমার পাশে যে সজল ভাই থাকে হে কোথায়?

দুদিন হলো দেখছি না। গতকাল ফোন করেছিলাম, ধরেনি। আজও ফোন করলে প্রথমে সে ধরেনি। পরে কল ব্যাক করেছিল। আমি ধরতে পারিনি। সম্ভবত আশেপাশের কোনো জেলায় গেছে।

মানুষটা কিন্তু খুব ভালো।

আমার কাছে সেরকমই মনে হয়েছে।

মনও মেলা বড়।

হ্যাঁ। নিজে রান্না করে আমাকে খাইয়েছে। মাঝে মধ্যে ফল পাঠিয়ে দেয়। তার মধ্যে আন্তরিকতা আছে।

আমাকে সেদিন চকলেট দিল। আগে প্যাড কলম অনেককিছু দিছে। মন মলা উদার। যাইহোক, তোমার তো রান্না করতে কষ্ট হয়। এত কষ্ট কইরা রান্না করা দরকার কী? আমার এইখানে খাবার পার।

আপনার এখানে দাম বেশি।

তোমার জন্য দাম কমায় রাখব।

কেন কমাবেন?

আশেপাশের মানুষরে কম দামে দিতে হবে না? তোমরা হইতেছ প্রিয় মানুষ।

আর কাউকে কম দামে দেন নাকি?

হু দেই তো। তোমার পাশের বাড়ির সবাইরে কম দামে দেই। তাগো জন্য ত্রিশ পার্সেন্ট ছাড়। আর মাঝে মইধ্যে..

লিমন সরু চোখে বলল, মাঝে মধ্যে কী?

নুপূর আসলে পঞ্চাশ পার্সেন্ট ছাড় দেই। ফ্রিও দেই।

ফ্রি কেন?

মোবারক মিষ্টি হেসে বলল, তুমি বুঝবা না।

ও আচ্ছা। ঐ বাড়িতে আর কে কে থাকে?

তিনজন। নুপূর, ঝুমুর আর পিয়া আপা।

পিয়া আপা কে?

আছে। তারে বেশি দেখা যায় না। সে-ই বাসাডা ভাড়া নিছে। নাচের স্কুলও তার নামে।

আমি ঐরকমই অনুমান করেছিলাম। আপনার এখানে আসে না?

না আসে না। নুপূর আর ঝুমুর আসে।

বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই?

দেখি নাই। মাঝে মইধ্যে দুই একজন আসে। তারপর আবার চইলা যায়। মনে হয় যারা নাচ শিখে তাগো অভিভাবক। শুক্রবারে ভিড় বেশি থাকে। ঐ বিক্রি বাট্টাও বেশি হয়।

তাহলে তো ভালোই।

এর মধ্যে আর একজন কাস্টমার এলে তার সাথে কথা বলতে গেল মোবারক। লিমন খাবারে মনোনিবেশ করল। তার সত্যি ঘুম পাচ্ছে। কারণও আছে। পড়ার জন্য ভোর চারটায় উঠেছিল সে। দুটো পরীক্ষা ছিল আজ। এজন্য সারাদিন সে বিশ্রাম নিতে পারেনি।

খাবার শেষে লিমন যখন চলে যাচ্ছে দেখল নুপূর আসছে। সে অবশ্য দাঁড়াল না। সরাসরি বাসায় ঢুকে গেল।

নুপূর এসে বলল, কেমন আছেন মোবারক ভাই?

ভালো। দারুন ভালো। তুমি কেমন আছ?

ভালো, আপনার মতো দারুন ভালো।

হঠাৎ এত ভালো কেন?

নুপূর মিষ্টি হেসে বলল, আজ সাহস করে একটা কাজ করে ফেলেছি।

কী কাজ?

পিয়া আপুকে আপনার কথা বলেছি।

মানে?

আপনি সেদিন জানতে চেয়েছিলেন যে পিয়া খালা আপনাকে চিনে কিনা। আসলে সে আপনাকে চিনে

তাই নাকি?

নুপূর মাথা ঝাকিয়ে বলল, হু। আমি বলতেই বলল, ঐ দোকানে বসে থাকা সুন্দর চেহারার ছেলেটা। তার মানে সে আপনাকে ভালোমতো চিনে।

মোবারক আগ্রহ নিয়ে বলল, তারপর কী বলল?

তেমন কিছু না। তবে মনে হলো সে আপনাকে পছন্দ করে।

তাই নাকি? আমার ভাগ্য মনে হয় ভালো। তো এত রাতে কী মনে করে?

চা নিতে এসেছি। ভাবছি আজ রাতে ঘুমাব না। আর হ্যাঁ, আজ আমি আপনার জন্য একটি চিঠি লিখছি।

চিঠি?

হু।

কই?

নুপূর রহস্যময় দৃষ্টিতে বলল, এখনো শেষ করতে পারিনি। রাতে আপনাকে দিয়ে যাব। রাতে দিবা?

হু। আপনি দোকান বন্ধ করেন কটায়?

রাত বারোটায়।

ঠিক সাড়ে বারোটায় কেউ যখন থাকবে না তখন আপনি আমাদের গেটের সামনে থাকবেন। আমি আসব। চিঠিটা আপনার হাতে দেব।

সাড়ে বরোটা! এত রাতে!

আমার জন্য রাতে আসতে পারবেন না?

মোবারক তাড়াতাড়ি বলল, ..অ…অবশ্যই পারব।

তাহলে আমাদের রাতে দেখা হবে।

নুপূর এবার ডানে বামে তাকিল। তারপর ফিস্ ফিস্ করে বলল, একদম গোপনে আসবেন। কেউ যেন জানতে না পারে। আপনার দোকানের কর্মচারীরাও না। তাহলে কিন্তু

আমার বদনাম হয়ে যাবে।

না না কেউ জানবে না।

নুপূর এবার অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলল, তাড়াতড়ি চা দিন।

কয় কাপ দেব?

তিন কাপ।

তুমি তিন কাপ খাবে?

না আমরা তিনজনই খাব।

তাহলে তো কেউ ঘুমাতে পারব না।

সেটা নিয়ে আপনি ভাববেন না।

ও আচ্ছা।

ফ্ল্যাক্সে চা ভরা হলে নুপূর মিষ্টি হেসে বলল, আজ কিন্তু আপনাকে চায়ের টাকা দেব না। মোবারক তাড়াতাড়ি বলল, দরকার নাই, দরকার নাই।

আসি তাহলে। ঠিক সাড়ে বারোটায় আপনার জন্য অপেক্ষা করব।

এরপর মিষ্টি হেসে চলে গেলে নুপূর। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।

মোবারক বিড় বিড় করে বলল, নুপূর তোমার হাসি আসলেই সুন্দর। আমি আসব। আইজ রাইতে আসব। ঠিক সাড়ে বারোটায় এবং একলা। আর অবশ্যই গোপনে। কেউ কিছু টের পাবে না। আমি চাই না কোনোভাবে তোমার বদনাম হোক।

রাত সাড়ে নয়টা।

ঘুমাতে চাইলেও ঘুমাতে পারেনি লিমন। ঘুম আসছে না। তাই টেবিলে বসে পরের পরীক্ষার নোটগুলো গুছাচ্ছিল। দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকাল। দেখল দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করছে সজল। সে খানিকটা অবাক হয়ে বলল, আরে ভাইয়া, আপনি,

হু।

কয়েকদিন ধরে আপনার হদিস নেই। আমি তো চিন্তায় ছিলাম।

চিন্তার কারণ কী? আমি তো তোমাকে বলেছিলাম আমি আশোপাশের কোনো জেলায় থাকব। তোমার জন্য রসমালাই নিয়ে এসেছি। টাঙ্গাইলের রসমালাই।

টাঙ্গাইলের রসমালাই?

হু। যদিও বিখ্যাত কোনো দোকানের নয়, কিন্তু আমার খুব পছন্দের। হারু নামের একজন তৈরি করে। নিজের হাতে তৈরি করে বলে ভেজাল নেই। খেয়ে দেখবে, ভালো লাগবে।

এ তো দেখছি এক কেজি। একা খাব কীভাবে?

তোমার যে বয়স এখনই খাওয়ার সময়। না পারলে হবে কীভাবে? আর এখন চলো, একসাথে খাই।

লিমন রসমালাই নিয়ে বাটিতে ঢালতে লাগল। সজল বলল, তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে?

ভালো।

তুমি তো দেখি সারাদিন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। এত পড়লে হবে?

সারাদিন ব্যস্ত থাকি কোথায়? টিউশনিতে যেতে হয়। তারপর নিজের রান্না বান্না আছে। টুকটাক কাজ লেগেই থাকে।

এরপর কী করবে?

মানে?

পড়াশুনা শেষ হলে কী কাজ করবে?

চাকরি করব।

না, তুমি চাকরি করবে না।

তাহলে চলব কীভাবে? খাব কী?

সজল ঠোঁট কামড়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, চাকরিকে আমার কাছে চাকরের কাজ মনে হয়। তুমি ব্যবসা করবে। মূল আনন্দ ব্যবসায়। ব্যবসা একবার জমে উঠলে ঠেকায় কে? দেখবে দ্রুত বড়লোক হয়ে গিয়েছে।

ব্যবসার টাকা পাব কোথায়?

ব্যবসা করতে খুব বেশি টাকা লাগে না। কিছু জমিয়ে রাখো। ছোটখাট একটা ব্যবসা এখনই শুরু করে দিতে পার। তারপর টেনেটুনে বড় করবে।

লিমন রসমালাইয়ের বাটি সজলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনি এমনভাবে বলছেন যেন ব্যবসায় শুধু লাভ আর লাভ। মনে হয় বিষয়টা এত সহজ নয়।

সহজ যে নয়, তা ঠিক। তবে পরিশ্রম আর ভাগ্য সাথে থাকলে ঠেকায় কে? যাইহোক, বেশ কতাযেকদিন তো হয়ে গেল। কেমন লাগছে এখানে?

ভালো, তবে একেবারেই একা মনে হয় নিজেকে। আপনি থাকলে নিঃসঙ্গতা কাটত।

আসলে আমার চাকরির ধরনটাই এরকম। আর ছাদটা সত্যি নিরিবিলি।

পাশের নাচের স্কুল ছাড়া আর কিছু নেই।

হ্যাঁ। ঐ বাড়ির ছাদে কাউকে দেখেছ নাকি?

না কাউকে দেখিনি। কারা থাকে তাও ভালোমতো জানি না।

দুই তিনজন থাকে বোধহয়।

আমি দুজন মেয়েকে দেখেছি গরম হোটেল থেকে খাবার নিতে।

আমিও ঐ দুজনকে দেখেছি। সম্ভবত আর একজন আছে, নাম পিয়া, নাচের স্কুলটা চালায়। উনি বেশ সুন্দরী। তবে সবসময় তাকে দেখা যায় না। দুবার তাকে দেখেছি। আরও কেউ থাকতে পারে। নিশ্চিত না হয়ে বলতে পারব না।

আপনার সাথে কারো কথা হয়নি।

না ভাই। মেয়েদের থেকে আমি দশ হাত দূরে থাকি। আর বিশেষ করে পাশের বাড়ির ক্ষেত্রে..

কী?

আমি জানি না। ঐ বাড়ির সবার চলাচল যেমন কেমন রহস্যময়। মানুষের সাথে খুব একটা মিশে না। নিজেদের মতো থাকে।

কিছুটা মিশে বোধহয়। তা না হলে নাচের স্কুল চালাবে কীভাবে?

তারপরও কোথাও একটা খটকা আছে বলে মনে হয়।

কিসের খটকা?

আমি জানি না। তোমাকে আসলে ব্যাপারটা আমি বোঝাতে পারব না। যাইহোক, বাদ দাও এসব কথা। আমরা আমাদের মতো থাকি। রসমালাই কেমন লাগছে?

অসাধারণ ভাই।

মিষ্টি একটু কম।

কম মিষ্টিই ভালো লাগে।

টাঙ্গাইলে গেলে আমি এই রসমালাই নিয়ে আসি। তুমি যেহেতু পছন্দ করেছ এরপর গেলে প্রত্যেকবার তোমার জন্য নিয়ে আসব।

ঠিক আছে সজল ভাই।

আমি তাহলে যাই। তুমি পড়ো। রাতের খাবার খেয়েছেন?

হ্যাঁ খেয়েছি। আসি তাহলে।

সজল চলে গেলে লিমন বুঝতে পারল এত সহজে আজ তার ঘুম আসবে না। আগামীকাল সকালে তাকে কাপড় চোপড় ধুতে হবে। কিন্তু কাপড় কাচা পাউডার নেই। তাই পাউডার কিনল সে। কেনার পর ফিরে আসার সময় মোবারক ডাক দিল লিমনকে, এই লিমন,

লিমন

লিমন এগিয়ে এসে বলল, কী ব্যাপার মোবারক ভাই?

আরে আইসো, এক কাপ চা খাই।

এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না।

আরে আইসো না।

রাতে ঘুম হবে না। এমনিতেই ঘুম আসছে না।

আসবে আসবে। আর আইজ চায়ের দাম দিয়া লাগবে না। আমি তোমারে খাওয়াব।

লিমন চেয়ারে বসে বলল, আপনাকে খুব বেশি খুশি খুশি লাগছে।

গরম হোটেলে আইজ গরম খবর আছে।

কী খবর?

ভাবতেছি তোমারে বলব কিনা?

আপনার কথা তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

বুঝবা কীভাবে? আমি নিজেও বুঝতেছি না। কেমনে কেমনে যেন সব ঘইটা গেল। বড় অবাক হইতেছি। আজ বড় আনন্দের দিন আমার।

কীসের আনন্দ?

মোবারক অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলল, বলা নিষেধ আছে।

কে নিষেধ করেছে?

তাও বলা নিষেধ।

তাহলে আর আমাকে ডেকেছেন কেন?

আসলে আমি বড় বিপদে আছি।

লিমন চোখ কুচকে বলল, কী বিপদ!

আমার আনন্দের কথা কাউরে বলবার ইচ্ছা করতেছে, কিন্তু বলবার পারতেছি না। এইডাই কষ্ট।

এর মধ্যে চা চলে এলে লিমন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি আজ রাতে আনন্দে আছেন, কষ্টে আছেন, আবার বিপদেও আছেন। একজন মানুষের আনন্দ আর কষ্ট একইসাথে থাকে কীভাবে? আমার মনে হয় আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

মোবারক হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে বলল, আসলেই মনে হইতেছে আমার মাথা খারাপ হইয়া খেছে। শুধু খারাপই না, মাথা গরমও হইতেছে।

তাহলে চা না খেয়ে ঠান্ডা কিছু খান।

এইডা তুমি ঠিক বলছ।

এরপরই হাক দিল মোবারক, ঐই কুদ্দুছ, এক বোতল ঠান্ডা কোক নিয়া আয়।

লিমন কিছু বলল না, শুধু মুচকি হাসল। তবে চা শেষ করে সে যখন বের হয়ে এলো তখন বিস্মিত না হয়ে পারল না। কারণ মোবারক চা কিংবা কোক কিছুই খাচ্ছে না। তাকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছে। এরকম অস্থির তাকে আগে দেখেনি।

আজ আধঘণ্টা আগেই হোটেল বন্ধ করে দিয়েছে মোবারক। হোটেলের সবাই চলে গেলে সে চারপাশে তাকাল। না কেউ নেই। ঘড়ি দেখল মোবারক। রাত বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আর দেরি করল না। পা বাড়াল পিয়া নাচের স্কুলের গেটের উদ্দেশে।

গেটে ধাক্কা দিতে খুলে গেল গেট। বেশ অবাক হলো মোবারক। এত রাতে কোনো বাড়ির গেট খোলা থাকার কথা নয়। অথচ এই বাড়ির গেট খোলা। সে অনুমান করল গেটটি তার জন্যই খুলে রেখেছে নুপূর। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নুপূরকে দেখা যাচ্ছে না। পিছনে গেটের পাল্লা ধাক্কা দিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাল সে। না নেই, নুপূর নেই। এখন তার কী করা উচিত সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এত রাতে অপরিচিত কারো বাড়িতে প্রবেশ যে কতটা বিপদজনক সে জানে। তার উপর এই বাড়িতে শুধু তিনজন মেয়ে থাকে। কাজেই কেউ তাকে সন্দেহ করলে পরিত্রানের উপায় থাকবে না। কেউ বুঝতে চাইবে না যে সে নুপূরের আমন্ত্রণে এত রাতে এই বাড়িতে প্রবেশ করেছে।

ভিতরে প্রবেশের দরজাটিও খোলা। তবে সম্পূর্ণ নয়। পাঁচ ইঞ্চির মতো ফাঁকা রয়েছে দুই পাল্লার মাঝে। একবার ভাবল পাল্লার মধ্যে দিয়ে উঁকি দেবে সে। পরে বাদ দিল চিন্তাটা। কারণ সে বুঝতে পারছে কাজটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তবে মনকে মানাতে পারছে না। তাকে সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছে নুপূর। সে এসেছে দশ মিনিট পরে। হয়তো দরজায় দাড়িয়ে থেকে ভিতরে ঢুকে গেছে নুপূর, এরকম একটা ধারণা থেকে দরজার সামনে গিয়ে ভিতরে উকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

মোবারকের বুকটা দুরু দুরু করছে। মনে হচ্ছে নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। তারপরও ভয়কে উপক্ষো করে ভিতরে উকি দিল সে। ভিতরটা আধো অন্ধকার। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সাহস করে একটা পাল্লা ধরে টান দিল। এতে বুঝতে পারল ছোট্ট একটা বারান্দার মতো জায়গায় এসে পৌঁছেছে সে। ডান দিকে একটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সামনে একটা দরজা। সম্ভবত এই দরজাটি নাচের স্কুলে প্রবেশের দরজা।

কী করবে যখন ভাবছে মোবারক তখনই পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। সিঁড়ি দিয়ে কেউ একজন নিচে নামছে। তারপর দেখতে দেখতে পেল নুপূরকে। উপর থেকে নিচের দিকে নামছে। তবে যে নুপূরকে সে এতদিন দেখেছে এই নুপূর সেই নুপূর নয়। এই নুপূর যেন কেমন? পাতলা একটা সাদা শাড়ী পরেছে সে। এরকম পাতলা শাড়ি আগে কাউকে পরতে দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না মোবারক। ব্লাউজটাতেও যেন কাপড়ের স্বল্পতা রয়েছে। মনে হচ্ছে শরীর আবৃত করার দেখে অনাবৃত্তি অংশকে আকর্ষণীয় করে তোলায় ব্লাউজের দায়িত্ব। নুপূরের মুখে কেমন যেন অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি। শরীর থেকে সুন্দর পারফিউমের গন্ধ আসছে। চুলগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে ঘাড়ের উপর। চোখের চাহনিটা কেমন যেন বাঁকা, যেন কিছু ইঙ্গিত করছে। সবকিছু মিলিয়ে মোবারক একেবারে স্থবির হয়ে গেল। নড়ার শক্তিও যেন সে হারিয়ে ফেলল।

নুপূর এসে দাঁড়াল মোবারকের সামনে। পারফিউমের গন্ধটা এখন এতটাই তীব্র যে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো মোবারকের। সে কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। নুপূরই মুচকি একটি হাসি দিয়ে বলল, আপনি তাহলে এসেছেন। আমি কিন্তু বেশ অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম আপনার জন্য।

মোবারক তোতলাতে তোলাতে বলল, ইয়ে.. মানে.. দেরি হইয়া গেল।

তাতে অসুবিধা নেই, আসুন আমার সাথে।

কোথায়?

উপরে।

উপরে?

হু। আমার রুমে।

কি.. কিন্তু…

তাহলে কী নাচের স্কুলে বসবেন? আপনি চাইলে আমি…

কথাগুলো বলে রহস্যময় একটা হাসি দিল নুপূর। তারপর টেনে টেনে বলল, আপনার সামনে আজ নাচতেও পারি।

না না, তার দরকার নাই।

তাহলে আসুন আমার কক্ষে। ওখানে আমরা নিরিবিলি বসতে পারব। ওখানেই আপনাকে চিঠিটা দেব।

কেউ যদি দেখে ফেলে?

দেখবে না।

নুপূর এবার উলটো ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। মোবারক অবশ্য উঠল না, স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। নুপূর ফিরে এসে এবার মোবারকের হাত ধরল, তারপর ফিস্ ফিস্ করে বলল, চলুন আমার সাথে, ভয় পাবেন না। ভয় পাওয়ার মতো কেউ আমি নই। আপনাকে পছন্দ করেছি বলেই আজ আমি এখানে আসতে বলেছি। তা না হলে কখনোই বলতাম না।

..আ…আমি….

আর কোনো কথা নয়। সামনে পা রাখুন।

মোবারক সিঁড়িতে পা রাখল।

দোতলাটা আধো অন্ধকার। মাঝখানে সরু একটা বরান্দা। নীল আলো জ্বলছে। বারান্দার দুপাশে বেশ কয়েকটি কক্ষ। এরকমই একটি কক্ষের দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল নুপূর। তারপর বলল, এটা হলো আমার রুম। আমি এখানে থাকি। আসুন ভিতরে আসুন।

মোবারক ভিতরে প্রবেশ করল। রুমটা খুব বেশি বড় না। দশ ফুট বাই দশ ফুট হবে। রুমে একটি লম্বা খাট আর একটি আলমারি আছে। এক কোনায় একটি ছোট টেবিল, আর চেয়ার। কাপড়চোপড় রাখার জন্য একটি র‍্যাক আছে, তবে সেখানে তেমন কোনো কাপড় নেই। শুধু একটি তোয়ালে।

টেবিলের সাথে রাখা চেয়ারটা দেখি নুপূর বলল, ওখানে বসুন।

মোবারক বসলে নুপূর আবার বলল, আপনি কিন্তু বললেন না আজ আমাকে কেমন লাগছে।

মোটেও সুন্দর লাগছে না’, কথাটা বলতে গিয়েও বলল না মোবারক। যেভাবে নুপূর শাড়ি পড়েছে, এরকম শাড়ি পড়া তার পছন্দ নয়। সে শালীনতাকে পছন্দ করে, অশালীনতাকে নয়। এজন্য নুপুরকে আজ তার অতটা ভালো লাগছে না। কিন্তু কথাটা মুখের উপর বলা শোভনীয়তার পর্যায়ে পড়ে না দেখে সে মিথ্যা বলল, তোমাকে সুন্দর লাগতেছে।

ধন্যবাদ আপনাকে। এখানে আপনাকে কেন আসতে বলেছি জানেন?

একটা চিঠি দেবে বলে।

আবার রহস্যময় একটা হাসি দিল নুপূর। তারপর বলল, শুধু চিঠি না, এসেছি আপনার সাথে নিরিবিলি কিছুক্ষণ কথা বলার জন্য। আপনার হোটেলে কথা বলা যায় না। সবসময় মনুষ গিজগিজ করতে থাকে। এখানে কেমন লাগছে?

ভালো, ..তবে..

তবে কী?

ভয়ও করতেছে।

কিসের ভয়?

ঝুমুর কিংবা পিয়া আপু যদি দেইখা ফেলে।

তাদের কেউ আসবে না। দুজনেই ঘুমাচ্ছে।

তারপরও..

ওগুলো আমার উপর ছেড়ে দিন। এখন বলুন কী খাবেন?

আমার আসলে কিছু খাইতে ইচ্ছা করতেছে না।

সে কী! জীবনে প্রথম আমার রুমে এলেন, আর কিছু খাবেন না, তা কী হয়? আমি আপনার জন্য শরবত বানিয়ে রেখেছি। সাথে পায়েসও আছে। আশা করছি দুটোই আপনার ভালো লাগবে। আপনি বসুন, আমি নিয়ে আসছি।

কথা বলেই বের হয়ে গেল নুপূর।

মোবারক মোটেও স্বস্তি অনুভব করছে না। তার মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর এক ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু কী ফাঁদ সে জানে না। সে উপলব্দি করছে তার এখনই এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। তবে যাওয়াটা শোভনীয় হবে কিনা তা বুঝতে পারছে না। এজন্য দোটানায় পড়েছে।

মোবারকের ভাবনার মধ্যেই শরবত আর পায়েস নিয়ে এলো নুপূর। তারপর বসল খাটের উপর। খাটের উপর বসার পরই তার কাঁধ থেকে শাড়ীর আঁচল পড়ে গেলে। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না মোবারক। বিষয়টা যে নুপূরকে বলবে সেই উপায়ও নেই। ব্যাপারটা নুপূরের ইচ্ছেকৃত না অনিচ্ছাকৃত তাও সে বুঝতে পারছে না।

শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নুপূর চোখ পিটপিট করে বলল, এই নিন।

কিসের শরবত?

লেবু, চিনি আরও কিছু আছে।

কী আছে?

খেলেই বুঝতে পারবেন।

তুমি খাবা না?

নুপূর টেনে টেনে বলল, আজ আমি খাব কেন? আপনার ওখানে কেউ চা খেতে গেলে কী আপনি তার সাথে চা খান? না খান না। আজ আপনি আমার মেহমান। আপনাকে খেদমত করা আমার দায়িত্ব। নিন, ভালো লাগবে। আমি সুন্দর লেবুর শরবত বানাতে পারি। সবাই প্রশংসা করে। নিন।

মোবারক হাতে গ্লাস নিল। সত্যি কথা বলতে কী তার শরবত খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে সে পড়েছে না খেয়েও উপায় নেই। গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর চুমুক দিল। লেবুর স্বাদ জিহ্বা স্পর্শ করতে কিছুটা ভালোলাগার অনুভুতির সৃষ্টি হলো তার মধ্যে।

শরবত শেষ করতে পায়েসের বাটি এগিয়ে দিল নুপূর। তারপর বলল, পায়েস খেতে খেতে গল্প করি চলুন।

পায়েস কী তুমি রাধছ?

না।

তাহলে কে?

পিয়া আপু।

মোবারক চোখ বড় বড় করে বলল, উনি কী জানেন আমি এইখানে আসব?

জ্বি।

কী বলতেছ?

আমি তাকে বলেছি।

কী সর্বনাশ! কী মনে করবেন উনি।

কিছু মনে করবেন না। আপনার প্রতি যে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে তা আমি আমি তাকে বলেছি।

.. আ…

ইতস্তত করার কিছু নেই। আপু অনেক ভালো মানুষ।

তাই বলে..

আপনি এরকম করলে হবে কেন? খেয়েই দেখুন না পায়েস। খাওয়ার পর ঠিকই তার প্রশংসা করবেন। কারণ কী জানেন?

না জানি না।

কারণ আপু জানে পায়েসে কোন উপাদান কতটুকু দিতে হয়। আমি জানি না। এজন্য আমাদের বাসায় আপুই সবসময় পায়েস রাঁধে। খেয়ে দেখুন ভালো লাগবে।

মোবারক পায়েস মুখে দিল। সত্যি স্বাদের হয়েছে পায়েস। কিন্তু স্বাদটা মোবারক উপভোগ করতে পারছে না। কারণ তার মনের অস্থিরতা যাচ্ছে না। তাছাড়া চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঘোরাটে হয়ে আসছে। ঝিম ঝিম করছে মাথাটা। তার সামনে বসা নুপূরের চেহারা এখন অস্পস্ট হয়ে আসছে। কাঁধের উপর থেকে সরে যাওয়া নুপূরের শাড়িটা এখন বক্ষের উপর থেকেও সরে গেছে। নুপূরের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। একজন পুরুষের সামনে একজন নারীর নিজেকে এতটা উম্মুক্ত করে বসা উচিত নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিল নুপূরকে সে কথাটা বলবে। কিন্তু বলতে গিয়েও পারল না। মুখে কোনো শক্তি নেই। ঠোঁট ফাঁক করতে পারছে না সে। হাতও কেমন যেন কাঁপছে। মনে হচ্ছে পেয়ালাটা হাত থেকে পড়ে যাবে। নুপূরের দিকে তাকাতে মুচকি হেসে নুপূর বলল, দিন পেয়ালাটা আমাকে দিন।

নুপূর হাত থেকে পেয়ালা নিয়ে নিল। এদিকে নিজের উপর কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারছে না মোবারক। শরীর টলছে। চোখ ভরা যেন ঘুম। যে কোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে।

নুপূর উঠে এসে তার কাঁধ ধরল। তারপর কানের কাছে বিড় বিড় করে বলল, আপনার খুব ঘুম পেয়েছে, ঐ খাটের উপর শুইয়ে দেই চলুন।

মোবারক উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে তার দুই হাঁটু থর থর করে কাঁপতে লাগল। অনেক কষ্টে দাঁড়াতে পারল। খাটের পাশে গিয়ে পৌছাতে আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। পড়ে গেল বিছানার উপর। তরপর হারিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

নুপূর ঘুমন্ত মোবারকের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিল। যে কেউ দেখলে বুঝতে পারত এই মুচকি হাসি কতটা ভয়ংকর। তারপর সে ইশারা করতে দরজার ওপাশ দাঁড়িয়ে থাকা ঝুমুর ভিতরে প্রবেশ করল। সে মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুমিয়েছে?

নুপূর উপরে নিচে মাথা ঝাকিয়ে বলল, হ্যাঁ।

বেশি ঝামেলা করেছিল?

না, বুঝতে পারে নি। তবে মনে হচ্ছিল বের হয়ে যেতে যাচ্ছে।

ঝুমুর মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে বলল, আহা রে! বেচারা বুঝতে পারে নি যে আর কোনোদিন এখান থেকে বের হতে পারবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

আপু কোথায়?

আসবে।

তুমি তাকে বলেছ?

না বলিনি। বলতে যাচ্ছি।

এরপর ঝুমুর বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার পিয়া আর সে একসাথে প্রবেশ করল। পিয়া তাদের থেকে বয়সে বড়। এসে বসল খাটের উপর। তারপর মোবারকের হাত ধরে নাড়ী পরীক্ষা করল।

নুপূর আগ্রহ নিয়ে বলল, কী অবস্থা আপু?

সব ঠিক আছে। কফিনটা বের করো।

খাটের নিচ থেকে একটা কফিন বের করা হলো। এই কফিনটা সাধারণ কফিনের মতো নয়। কফিনের নিচে চাকা লাগানো, উপরের অংশ একেবারে নিচ থেকে খুলে ফেলা যায়। উপরের অংশ এখন খোলা। দেখলে মনে হবে বুঝি চাকাওয়ালা একটি কাঠ নিচে পড়ে আছে। মোবরককে ধরাধরি করে এনে নিচের অংশের উপর শুইয়ে দেয়া হলো। পা দুটো আটকে দেয়া হলো আংটার মাঝে। হাত দুটোকে রাখা হলো দুপাশে। তারপর উপরের অংশ দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো কফিন। উপরের অংশে দুপাশে কবুতরের খোপের মতো দরজা বা ফুটো আছে। ঐ ফুটো দিয়ে মোবারকের দুই হাত দুই দিকে বের হয়ে আছে। এখন ইচ্ছে করলেও সে হাত ভিতরে টেনে নিতে পারবে না। কারণ জায়গাটা খুব ছোট।

এরপর পিয়া নুপূরুরের দিকে তাকিয়ে বলল, কেউ কী কিছু টের পেয়েছে?

না আপু।

গরম হোটেলের কেউ?

না।

তুমি কী নিশ্চিত?

হ্যাঁ নিশ্চিত।

শেষ মুহূর্তে কী কিছু বলেছিল যে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে বা করবে?

না।

পিয়া লম্বা একটা শ্বাস নিল। তারপর বলল, আমরা তাহলে আমাদের সাধনা শুরু করতে পারি?

হ্যাঁ। কখন করবে?

রাত দুইটার সময়।

ঠিক আছে আপু।

আর হ্যাঁ, নুপূর তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি আবার একজনকে আমাদের সাধনার জন্য বন্দি করেছ। আগেরবার করেছিল ঝুমুর। তোমাদের দুজনের দক্ষতায় আমি মুগ্ধ। তোমাদের পুরস্কৃত করা হবে।

ধন্যবাদ আপু। আমরা আশা করব তুমি দ্রুতই তোমার মতো ক্ষমতা আমাদের মাঝে বিস্তৃত করবে।

অবশ্যই। তবে আরো কিছু পরীক্ষা তোমাদের দিতে হবে।

কীসের পরীক্ষা?

বিশ্বস্ততার পরীক্ষা

অবশ্যই দেব।

অবশ্য আমার বিশ্বাস সব পরীক্ষায়ই তোমরা উত্তীর্ণ হবে। কারণ তোমাদের মধ্যে দারুন ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। এই ইচ্ছাশক্তিই তোমাদের বিজয়ী করবে। যাইহোক, তোমরা প্রস্তুতি নাও। রক্ত সাধনালয়ে আসো। আমিও প্রস্তুত হয়ে আসছি।

এরপর পিয়া বের হয়ে গেল।

নুপূর আর ঝুমুর কফিনটিকে ঠেলে রক্ত সাধানালয়ে নিয়ে এলো। রক্ত সাধনালয় মাঝের একটি কক্ষ। কক্ষের মধ্যে তেমন কিছু নেই। তবে এই কক্ষের বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোনো

জানালা নেই। চারপাশটা বন্ধ। ভিতরে লাল, নীল, কমলা নানা রঙের বাতি রয়েছে। কফিনটিকে দরজার উলটোপাশে আড়াআড়িভাবে রাখা হলো।

ঝুমুর বলল, কী মনে হয়? এখন কী জেগে উঠবে?

মনে হয় না। কড়া ডোজ দেয়া হয়েছে।

হু, কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

এজন্য এখন আর কিছু করছি না।

ঠিক আছে।

স্যালাইনটা কোথায়?

আছে, ওপাশে রাখা আছে।

দুটো বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পিয়া সাধনালয়ে প্রবেশ করল। তারপর দরজা ঠেলে দিয়ে নীল আলো জ্বালিয়ে দিল। তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা উজ্জ্বল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সে একেবারে কফিনের কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। হাতে একটি স্যালাইনের সুই রাখল নুপূর। কফিনের বাইরে থাকা মোবারকের বাম হাতে সুইটি ঢুকিয়ে দিল পিয়া। আর তাতে স্যালাইনের তরল ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করল মোবারকের শরীরে। মোবারক কিছুই টের পেল না।

এবার হাত পাততে আর একটা সুই ধরিয়ে দেয়া হলো পিয়ার হাতে। এটা ব্ল্যাড ব্যাগের সুই। এই ব্যাগে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। সুইটি কফিনের বাইরে থাকা মোবারকের ডান হাতের ধমনীতে প্রবেশ করাল পিয়া। আর তাতে ধীরে ধীরে রক্তে ভরে উঠতে থাকল ব্যাগটি। ব্যাগের মধ্যে সে অতিরিক্ত তিনটি সুই প্রবেশ করিয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটির সাথে সরু টিউব লাগানো। টিউবগুলোর মধ্যে রক্ত আসতে তারা তিনজন পাশাপাশি বসে নিজেদের মুখে ঢুকিয়ে দিল টিউব। এতে রক্ত প্রথমে মোবারকের হাত থেকে ব্লাড ব্যাগে আসতে লাগল, তারপর পৌঁছাতে লাগল পিয়া, নুপূর আর ঝুমুরের মুখে। রক্ত জিহ্বা স্পর্শ করতে ভিন্ন এক মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তিনজন। তবে সবচেয়ে পরিবর্তন এলো পিয়ার শরীরে। তার ফর্সা মুখটা ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠতে লাগল। বোঝা গেল দারুনভাবে তৃপ্ত সে।

রক্তসাধনা শেষ হতে প্রায় ত্রিশ মিনিট লাগল। এরপর পিয়া কোনোরকম কথা বলা ছাড়াই চলে গেল তার কক্ষে।

পিয়া চলে যাওয়ার দশ মনিটের মাথায় নড়ে উঠল মোবারক। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। তার উপর ঝুকে আছে নুপূর আর ঝুমুর। সে কিছু বলতে গেলে নুপূর মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল, একদম চুপ, কোনো রকম শব্দ করবে না।

.. আমি কোথায়?

আপনি কফিনের মধ্যে।

আমি আমার দুই হাত মুক্ত করবার পারতেছি না কেন? আমার পা নাড়াবার পারতেছি না কেন?

আপনার পা আটকে রাখা হয়েছে। হাত দুটোকে কফিনের ফুটো দিয়ে বাইরে বের করে রাখা হয়েছে।

চোখ বড় বড় করে মোবারক বলল, কেন এমন করছ?

কারণ আপনর শরীরে স্যালাইন প্রবেশ করিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। আর আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আপনার রক্ত আমরা পান করব?

কী! কী বলতেছ তুমি!

সত্য বলছি। আপনি কোনোরকম চালাকির চেষ্টা করবেন না। আপনার বাকি জীবন কাটবে এই কফিনের মধ্যে।

না, আমি বাঁচবার চাই।

এখানে এই কফিনে যারা আসে তাদের কেউ কখনো বাঁচতে পারে না। তাদের একমাত্র পরিণতি মৃত্যু। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে মৃত্যুর জন্য। তবে ঝামেলা করবেন না। ঝামেলা করলে মৃত্যু ত্বরান্বিত এবং কষ্টদায়ক হবে। আর ঝামেলা না করলে আপনার এখানে অবস্থান হবে আরামদায়ক। আমরা আপনার যত্ন করব, দারুন যত্ন।

না, আমি বাইর হবার চাই। এই কফিনে থাকবার চাই না।

বেশ জোরেই বলে উঠল মোবারাক।

নুপূর ইশারা করতে ঝুমুর পাশ থেকে কাপড় নিয়ে এলো। তারপর বিড় বিড় করে বলল, জোরে কথা বলার শাস্তি এখন আপনি পাবেন। আমরা আপনার মুখ বেঁধে দিচ্ছি। এ জীবনে আপনি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না।

মোবারক ‘না না’ বলে কিছু বলতে গেল, কিন্তু বলতে পারল না। ঝুমুর আর নুপূর শক্ত করে তার মুখ বেঁধে ফেলল। এখন কোনোমতে উম.. উম.. শব্দ করতে পারছে সে, এর বেশি কিছু নয়। এই শব্দ কোনোদিনও রক্ত সাধনালয়ের বাইরে যাবে না। আর কফিন আটকে দিলে তো রুম থেকেও শোনা যাবে না।

মোবারকের মুখ বাঁধা শেষ হলে নুপূর হেসে বলল, আপনি আমার সাথে থাকতে চেয়েছিলেন। আমার সাথেই থাকবেন। তবে একটু ভিন্নভাবে। আজ থেকে আপনি আমার বন্দি, যতদিন পর্যন্ত না আপনার মৃত্যু হবে বন্দি হিসেবেই আমার সঙ্গী হয়ে থাকবেন। হি.. হি..হি..

আবার কিছু বলতে গেল মোবারক। কিন্তু পারল না।

নুপূর আর কোনো কথা বলল না। কফিনের উপরের ডালাটা নামিয়ে আনল নিচে। আর তাতে অন্ধকারে হারিয়ে গেল মোবারক।

এরপর নুপূর আর ঝুমুর দুজনেই বের হয়ে গেল সাধনালয় থেকে। বের হওয়ার আগে মোবারকের ডান হাত থেকে ব্লাড ব্যাগের সুইটা খুলে রাখতে ভুলল না তারা। অবশ্য ব্যাগ ভর্তি রক্ত তখনো আছে। এই রক্ত তারা বিশেষ কাজে লাগাবে।

সাধানালয়ে এখন সবকিছুই স্থির, শুধু ধীর গতিতে চলছে স্যালাইন। স্যালাইনের মধ্যে পানি, ভিটামিন, পুষ্টিকর উপাদান যা কিছু থাকার সবই আছে। এই উপাদানগুলো মরতে দেবে না মোবারককে। বাঁচিয়ে রাখবে বেশ অনেকদিন, যেন পিয়া, ঝুমুর আর নুপূর তার রক্তপানে তৃপ্ত হতে পারে।

লিমন সন্ধ্যায় নাস্তা খেতে গরম হোটেলে এলো। তার ইচ্ছে ছিল মোবারকের সাথে কিছু কথাবার্ত বলবে। কোথাও তাকে না দেখে ক্যাশে বসা হোটেল বয় ফরিদকে জিজ্ঞেস করল, মোবারক ভাই কোথায়?

জানি না। আইজ আসে নাই।

বাসায় আছে নাকি?

না।

তাহলে?

রাইত থাইকা নিখোঁজ

লিমন চোক কুঁচকে বলল, নিখোঁজ, রাত থেকে, কী বলছ?

হু, রাইতে বাসায় ফিরে নাই। কাইল রাইতে হোটেল বন্ধ করার পর থাইকা আর খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না। বাড়িতেও খোঁজ নেয়া হইছে। পাওয়া যায় নাই তারে।

পুলিশকে জানিয়েছ?

দুপুরের পর মালিক জানায়ছে। পুলিশ আইছিলও। তয় কাম হয় নাই। পুলিশ বলল, ভালো মতো খুঁইজা দেহেন, আত্মীয় স্বজনের বাসায় যাবার পরে। ঠিক কথাই বলছে পুলিশ, এত বড় মানুষ হারাবে ক্যামনে?

আমিও অবাক হচ্ছি।

হবাক হওয়ারই কথা। খুব ভালো মানুষ আছিল হে।

ফোন কোথায়? মোবাইল ফোন?

এই হোটেলেই আছে। রাইতে হে ফোন নেয় নাই।

কী অদ্ভুত! আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ এভাবে হাওয়া হয়ে যাবে, তা কী হয়? আমি ঠিক যেন মানতে পারছি না।

কেউই মানবার পারতেছে না। তো কী খাবেন স্যার?

ভেবেছিলাম এক কাপ চা খাব। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না।

খান স্যার খান। এই এক কাপ দুধ চা দে স্যাররে?

চা খাওয়া শেষে যখন চলে যাবে তখন ঝুমুরকে আসতে দেখল লিমন। ঝুমুর মেয়েটা শ্যামলা হলেও সৌন্দর্যে ধার আছে। আজ যেন মেয়েটিকে বেশি সুন্দর লাগছে। লাল রঙের একটি শাড়ি পরেছে। একই রঙের কানের দুল। চুল খোলা। খানিকটা লম্বা হওয়ার কারণে সৌন্দর্যটা যেন একটু বেশিই। সে আগের মতোই চা আর পুড়ি নিতে এসেছে। চোখাচোখি হতে মুচকি হেসে বলল, কেমন আছেন আপনি?

মোবারক তাড়াতাড়ি বলল, জ্বি ভালো।

আপনাকে পেয়ে ভালোই হলো। আপনার সাথে চা খেয়ে যাই।

জ্বি জ্বি, অবশ্যই।

আমি কিন্তু আজ আপনার টাকায় চা খাব?

আচ্ছা।

লিমন ঝুমুরের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। আসলে আজ দারুন সুন্দর লাগছে ঝুমুরকে। তার উপর পারফিউমের সুগন্ধ তো আছেই। সুগন্ধ আর সৌন্দর্য কেমন যেন ভিন্ন এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে ঝুমুরের মতো সুন্দরী এক মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা সত্যি কঠিন। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিল সে।

বিষয়টা ঝুমুরের চোখ এড়ায়নি। নিজে থেকেই বলল, আজ আপনি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছেন।

ইয়ে মানে.. সব ঠিকই আছে। অন্যমনস্ক নই।

যদি স্বাভাবিক থাকতেন তাহলে অবশ্যই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু আপনি বলছেন না। কী হয়েছে বলুন তো?

কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে লিমন তাড়াতাড়ি বলল, মোবারক ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তাই নাকি!

হু। দেখছেন না, সে ক্যাশে নেই।

হয়তো কোথাও গিয়েছে।

কোথায় যাবে?

তা আমি বলব কীভাবে? যুবক মানুষ। অনেক জায়গায়ই যেতে পারে। ওটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আসুন না আমাদের বাসায় একদিন।

.. আপনাদের বাসায়?

হ্যাঁ।

না না, আপনারা তো আমার পরিচিত কেউ না।

পৃথিবীতে সবাই সবার পরিচিত থাকে না। পরিচয় ধীরে ধীরে হয়। একদিন আসুন। আপনার সাথে বসে চা খাব। আজ আপনি খাওয়ালেন, ঐ দিন আমি খাওয়াব। আমি কিন্তু খুব সুন্দর চা বানাতে পারি।

তাই নাকি?

ঝুমুর মাথা ঝাকিয়ে বলল, হু। আমার চা কিন্তু স্পেশাল। দুধ, চিনি, চা পাতা ছাড়াও এলাচ দেই। এলাচের সুগন্ধ চাকে দারুন স্বাদের করে। সাথে আরও অনেককিছু দেই। একবার খেলে আপনি আমার চায়ের ভক্ত হয়ে যাবেন।

তাহলে এখানে চা কিনতে আসেন কেন?

সবসময় চা বানাতে ভালো লাগে না। আর স্পেশাল চা বানাই স্পেশাল মানুষের জন্য। আমি কী আপনার কাছে স্পেশাল কেউ?

অবশ্যই।

কেন?

সব প্রশ্নের উত্তর এখন দেব না? বাসায় আসুন তারপর দেব। কবে আসবেন?

আসব একদিন।

আজই আসুন।

না না।

কেন?

আগামীকাল আমার পরীক্ষা আছে। পরীক্ষা শেষ হোক, তারপর আসব।

ঝুমুর মুখ বাকিয়ে বলল, কবে আপনার পরীক্ষা শেষ হবে, আর কবে আপনি আসবেন! এভাবে জীবনেও আসতে পারবেন না। ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় বুদ্ধিমান, কিছু বোঝেন টোজেন। এখন দেখি বোকা কিসিমের। যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে। তবে একটা কথা কিন্তু সত্য।

লিমন কিছু বলল না, শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

ঝুমুর মিটি মিটি হেসে বলল, আপনি মানুষ ভালো, আপনার মনটাও ভালো। এজন্যই আপনাকে আমার ভালো লাগে, দারুন ভালো লাগে। আসি।

মাথাটা ডান দিকে ঝাকি দিয়ে চুলগুলো শূন্যে উড়িয়ে চলে গেল ঝুমুর। দৃশ্যটা এত সুন্দর ছিল যে লিমনের চোখে ঝুমুরের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা বার বার ভাসতে লাগল। সে সিদ্ধান্ত নিল একদিন সময় করে ঝুমুরদের বাসায় যাবে। একটা বিষয় সে বিশ্বাস করে, প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা জরুরী। প্রয়োজনে কাজে লাগে।

বিল দেয়ার সময় ফরিদ বলল, একটা কথা কই?

হ্যাঁ বলো।

আমার কী মনে হয় জানেন?

কী মনে হয়?

আপা আপনেরে পছন্দ করে।

কোন আপা?

ঝুমুর আপা।

কী বলছ তুমি?

সত্য বলতেছি।

এরকম মনে করার কারণ?

কারণ সহজ। আপা মেলা দিন ধইরা এই হোটেলতে চা নাস্তা নেয়, খাবার নেয়। কিন্তু কারো সাথে কথা বলবার দেখি নাই। খালি মোবারক ভাইজানরে বিল দিয়া চইলা যাইত। অথচ কয়েকদিনেই আপনের সাথে হে কথা বলা শুরু করছে। আপনের সামনে বইসা চা খাবার খাইছে।

হয়তো এমনিতেই খেয়েছে।

না স্যার। আমি নিশ্চিত হে আপনেরে পছন্দ করছে। তয় এইডা সত্য, আপায় দেখতে কিন্তু সুন্দর। মেলা সুন্দর। তাই না?

লিমন আর কথা বলল না। বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলো। আজ তার বেশ পড়া বাকি। আগামীকালের পরীক্ষার সিলেবাস অনেক বড়, শেষ করত হবে।

লিমন রুমে ঢুকে টেবিলে বসল। মাঝে খেয়ে নিয়ে যখন টেবিল ছাড়ল তখন রাত একটা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আগে বাতাস ছিল না। এখন আছে। এজন্য বৃষ্টির ফোঁটা দক্ষিণের জানালা দিয়ে তার রুমে এসে পড়ছে। এই জানালাটা সে সবসময় খোলা রাখে। কারণ নদীর বাতাস এখান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে রুমটাকে ঠান্ডা রাখে।

জানালা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে গেল সে। বিদ্যুতের ঝলকে সে স্পষ্ট দেখতে পেল পাশের বাড়ির ছাদে একজন নারী দঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে সে। লাল শাড়ী পড়া, শাড়ীটা ভিজে লেপটে আছে শরীরের সথে। চুল কোমর পর্যন্ত। এই নারীকেই সেদিন সে শাড়ি পরিবর্তন করতে দেখেছিল। অনুমান করল, সম্ভবত পিয়া হবে।

জানালা যখন সে প্রায় আটকে ফেলবে তখন দ্বিতীয়বারের মতো আকাশে বিদ্যুতের ঝলাকানি দিল। আর তাতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল পিয়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অথচ কিছুক্ষন আগে উলটো ফিরে ছিল। কীভাবে পিয়া টের পেল যে সে জানালার পাশে, ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। আর দেরি করল না, জানালা বন্ধ করে দিল মোবারক। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়ল চাদরের নিচে। কেমন যেন শীত শীত করছে তার, শরীরেও কেমন যেন বিশেষ অনুভূতি। বুঝতে পারল তাড়াতাড়ি তার ঘুমাতে হবে। তা না হলে মাথার মধ্যে থেকে পিয়ার চিন্তাটা তাড়াতে পারবে না। এরকম ভাবনা থেকে চোখ বুঝল, আর উলটোভাবে একশ থেকে এক পর্যন্ত গুনতে শুরু করল। এতে তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে।

১০

লিমন বুঝতে পারছে বাইরে বৃষ্টি আরও বেড়েছে। সাথে বাতাসও। ঘুম এসেও যেন আসছে না। তবে সে চোখ খুলছে না। এরকম তার মাঝে মাঝে হয়। যখন ঘুম আসে না তখন দীর্ঘসময় চোখ বন্ধ করে রাখলে ঘুম চলে আসে। তার বিশ্বাস আজও ঘুম আসবে, হয়তো একটু সময় লাগবে। একশ থেকে এক পর্যন্ত তার গোনা শেষ হয়েছে। আবারও গুনতে শুরু করল সে। যখন পঞ্চাশের ঘরে এলো, হঠাৎ ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনতে পেল লিমন।

শব্দটা দরজায় হচ্ছে। কেউ টোকা দিচ্ছে। এত রাতে কে টোকা দিতে পারে? অনুমান করল সজল। এছাড়া ছাদে কেউ আসে না। কিন্তু সজল হলে তার নাম ধরে ডাক দিত প্রত্যেকবারই সে এই কাজ করে। কিন্তু আজ করছে না। তার মানে কী? লিমন সিদ্ধান্ত নিল সে দরজা খুলবে না। কারণ সে নিশ্চিত বাইরে সজল নেই। তাহলে দরজায় টোকা দিল কে? বিষয়টি রহস্যজনক।

আবার ঠক্ ঠক্ শব্দ হলো।

লিমন এবার বলল, কে?

কোনো উত্তর নেই।

আবার বলল, কে?

এবারও কোনো উত্তর সে পেল না।

লিমন উঠে বসল। তারপর বেড সুইচে চাপ দিল। লাইট জ্বলল না। তার মানে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। টেবিলের উপর রাখা মোমবাতি জ্বালাল সে। ঘরের মধ্যে আধো অন্ধকার একরকম আলোর সৃষ্টি হলো। এর মধ্যে আবার শব্দ হলো দরজায়।

লিমন এবার দরজার কাছে গেল। তারপর বলে উঠল, কে?

ওপাশে অস্পষ্ট একটা শব্দ হলো।

লিমন সন্দিহান হয়ে পড়ল। কে হতে পারে? সজল হতে পারে। কিন্তু সে কথা বলছে না কেন? তাহলে কী সে বিপদে পড়েছে। কিন্তু কী বিপদ? আবার ভাবল চোর ডাকাত হতে পারে কিনা? সেই সম্ভাবনাও নেই। কারন তার রুমে এমন কিছু নেই যে চোর বিক্রি করে খুব বেশি লাভবান হবে। তাহলে কে?

এবার বেশ জোরে জোরে ঠক্ ঠক্ শব্দ হলো। সাথে দরজায় হালকা ধাক্কা। তারপর একটা নারীকণ্ঠ কানে এলো তার। বলছে, দরজা খোলো।

নারী কণ্ঠ শুনে খানিকটা পিছিয়ে এলো লিমন। এত রাতে এখানে কোনো নারী আসবে কোথা থেকে। নিশ্চয় কেউ কোনো না কোনো বিপদে পড়েছে। এজন্যই এখানে এসেছে। কিন্তু বিপদগ্রস্ত একজন নারীর তার এই বাসায় আসার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। হয় পুলিশ, নতুবা হাসপাতালে যাবে। অথচ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, কী অদ্ভুত!

এবার দরজায় আরো জোরে ধাক্কা পড়ল।

যা হয় হবে ভেবে দরজা খুলে দিল লিমন। দরজা খোলামাত্রই ভিতরে প্রবেশ করল এক নারী। পাতলা লাল শাড়ি পরা। সমস্ত শরীর ভিজে আছে। চুলগুলো লেপ্টে আছে প্রায় উম্মুক্ত পিঠের উপর। এই নারীকেই সে কিছুক্ষণ আগে পাশের ছাদে দেখেছে। সে আর কেউ নয়, পিয়া।

লিমন কিছু বলার আগেই পিয়া হালকা ধমকের সাথে বলল, তুমি দরজা খুলতে এত দেরি করলে কেন?

একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেছে লিমন। কথা বলার শক্তি তার নেই। শুধু স্থির দৃস্টিতে তাকিয়ে আছে পিয়ার দিকে।

পিয়া আগের মতোই ধমকের স্বরে বলল, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? একটা তোয়ালে দাও। দেখছ না পুরো ভিজে গেছি।

তোয়ালে..

হ্যাঁ।

লিমন তোয়ালে ব্যবহার করে না। একটা মোটা গামছা ব্যবহার করে। সেটাই এগিয়ে দিল পিয়ার দিকে। পিয়া তার ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল, কী বৃষ্টিই না হচ্ছে বাইরে!

হ্যাঁ।

তোমার কী উচিত ছিল জানো?

কী?

আমাকে যখন বাইরে বৃষ্টিতে দেখেছ তখনই আমিকে ভিতরে ডাকা।

.. আমি আপনাকে এখানে ডাকব কীভাবে?

পিয়া এবার পড়ার চেয়ারে বসে বলল, তুমি তো আমাকে ডাকতেই পারো। আমাকে ডাকার অধিকার তোমার আছে, কারণ আমি তোমার স্ত্রী।

কী বলছেন আপনি?

সত্য বলছি। আর.. হ্যাঁ কখনোই আমাকে আপনি বলবে না।

লিমনের মাথা খারাপ হওয়া মতো অবস্থা। তীব্র একটা ভয় কাজ করছে তার মধ্যে। যদি কেউ দেখে ফেলে যে তার রুমে পিয়া এসেছে, তাহলে কী ঘটবে আর সে চিন্তা করতে পারছে না। পাশের রুমে সজল আছে কি নেই জানে না সে। যদি থাকে আর সবকিছু জানে তাহলে সে আর মুখ দেখাতে পারবে না।

পিয়া এবার চুল ঝাকি দিয়ে বলল, তুমি অতটা ভয় পাচ্ছ কেন? সজল রুমে নেই। অন্য কেউও আসবে না। আর আসলেও বা কী? স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে কিছু যায় আসে না।

.. আমি আপনি স্বামী স্ত্রী হলাম কীভাবে?

পিয়া এবার সরাসরি তাকাল লিমনের চোখে। তারপর বলল, ধীরে ধীরে সবকিছু বুঝতে পারবে, জানতে পারবে। একবারে সবকিছু জানার চেষ্টা করো না।

লিমন খানিকটা অস্থির হয়ে বলল, .. আপনি এখান থেকে চলে যান প্লিজ।

আগে আমাকে ‘তুমি’ করো বলো। তারপর যাব।

এটা কোনো যুক্তি হলো?

অবশ্যই হলো। আর হ্যাঁ বলো তো, আমাকে কেমন লাগছে দেখতে?

লিমন ঢোক গিলল। তারপর বিড় বিড় করে বলল, ভালো লাগছে।

পিয়া আড়চোখে তাকিয়ে বলল, শুধু ভালো লাগছে।

দারুন অস্বস্তির মধ্যে আছে লিমন। পিয়ার কাপড় চোপড়ের যে অবস্থা তাতে তার দিকে তাকাতেই লজ্জা পাচ্ছে সে। আর মন্তব্য করবে কী? তারপরও বলল, খুব ভালো লাগছে।

ধন্যবাদ। তুমি আসলেই ভালো।

প্লিজ আপনি চলে যান।

না যাব না। আগে আমাকে ‘তুমি’ করে বলো।

ঠিক আছে, তুমি কলে বললাম। যাও, প্লিজ চলে যাও।

এই তো তুমি এখন আমার আপন হয়ে গিয়েছ। আপন মানুষকে কেউ তাড়িয়ে দেয়।

আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি না। শুধু বুঝাতে চাচ্ছি এত রাতে এখানে থাকা যৌক্তিক নয়।

তুমি এত চিন্তা করছ কেন? আমি একজন নারী। কেউ কিছু বললে আমার সম্পর্কেই বলবে। তোমার সম্পর্কে বলবে না, তোমাকে সন্দেহ করবে না। কারণ সবাই জানে তুমি একজন ভালো ছেলে।

একটু থেমে পিয়া আবার বলল, চা খাবে?

এত রাতে চা!

হু। বৃষ্টির রাতে চা দারুন লাগবে।

না খাব না।

কেন?

ইচ্ছে করছে না।

আমার যে চা খেতে ইচ্ছে করছে।

এত রাতে কোথায় চা পাবে? তোমার বাসায় চা পাতা নেই?

না নেই।

কী অবিশ্বাস্য, এ যুগে চায়ের পাতা বাসায় থাকে না এরকম মানুষ আছে নাকি। আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল। যাইহোক তোমার আমার যখন বিয়ে হয়েই গিয়েছে তখন তো আর কিছু করার নেই। তোমাকে আমার মতো করে গড়ে নিতে হবে। ঠিক বলেছি, তাই না?

আপনার আমার বিয়ে হয়নি।

আবার আপনি?

তোমার আমার বিয়ে হয়নি।

পিয়া এবার খিল খিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তুমি ঠিক বলো নি। আসলে তুমি অনেককিছু জানো না। তোমার আমার সম্পর্ক বহুদিনের। ধীরে ধীরে তোমাকে সবকিছু বলব। তুমি শুনলে অবাক হবে যে আমিই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। কেন জানো? না, আজ সবকিছু বলব না। অন্যদিন বলব। তুমি বরং এক কাজ করো। আজ আমার রুমে চলো।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, তো.. তোমার রুমে!

পিয়া মাথা ঝাকিয়ে বলল, হ্যাঁ আমার রুমে।

না না।

কেন?

আমি তোমার ওখানে যাব কেন?

কেন? স্ত্রীর রুমে কী স্বামী আসতে পারে না? অবশ্যই পারে। আর কয়েকদিন পর তোমার আমার রুম একটাই রুম হবে। আমরা একই ছাদের নিচে ঘুমাব।

কী যা তা বলছ!

আমি ঠিকই বলছি। চলো চলো।

না আমি যাব না।

তাহলে আমিও এখান থেকে নড়ব না। সারা রাত থাকব। সারা দিন থাকব। দিনের পর দিন থাকব। আজীবন থাকব।

কী সাংঘাতিক!

এটাই সত্য। এখন তুমি আমাকে চা খাওয়াবে।

.. আমি কোথা থেকে চা খাওয়াব। এত রাতে হোটেল, দোকান কিছুই খোলা নেই। আর এখানে চা নিয়ে আসার মতো ফ্লাক্স কিংবা ওরকম কিছু নেই।

তাহলে আর তর্ক করছ কেন? চলো আমার ওখানে চলো। আমি নিজ হাতে তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াব। আমি নিশ্চিত আমার হাতে চা খাওয়ার পর আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা আরও অনেক অনেক বাড়বে।

তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা!

হু। আমি জানি তুমি আমাকে দারুন ভালোবাসো। তাই না?

লিমন একেবারে চুপ হয়ে গেল। সে খুবই অস্বস্তিবোধ করছে।

পিয়া এবার উঠে দাঁড়াল। তারপর লিমনের হাত ধরে বলল, এসো আমার সাথে।

তোমার বাসায় কীভাবে যাব?

তোমার ছাদে একটা কাঠের পাটাতন আছে। আমার ছাদেও আছে। এর যে কোনো একটি দুই ছাদের মাঝে ফেলে দিলে একটা সাঁকোর মতো হয়ে যায়। ওটার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব। আমি এভাবেই এসেছি।

বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ল দুজন। লিমনের অস্বস্তি আরো বেড়েছে। কারণ পিয়া তার শরীরের সাথে একেবারে মিশে আছে। নিজেকে সে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছে না। পিয়া আবার তার কাছেই ঘেষে আসছে। চমৎকার মিষ্টি একটা সুগন্ধ আসছে পিয়ার শরীর থেকে। এই গন্ধটা যেন কেমন? লিমনের ভালো লাগছে না, আবার লাগছেও।

সত্যি দুই ছাদের মাঝে একটা কাঠের পাটাতন রাখা আছে। পিয়া কীভাবে যেন পাটাতনের উপর উঠে গেল। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল লিমনের দিকে। পিয়া টেনে তাকে পাটাতনের উপর তুলল। দু’কদম এগোতে এখন তারা পাটাতনের মাঝে। বেশ নিচে মাটি দেখা যাচ্ছে। এদিক ওদিক হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। নিচে পড়তে হবে দুজনকে। দুজনেই ঘুরে দাঁড়াল বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে। বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটা সত্যি ভালো লাগছে। শরীরে শীত শীত অনুভব হচ্ছে। এর মধ্যে পিয়ার কাছে আসাটা কেমন যেন উষ্ণতাও ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভালোলাগার একটা আবেশ ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলছে লিমনকে। কেন যেন তার ভালো লাগতে শুরু করেছে পিয়াকে। পিয়া তার আরও কাছে আসছে, আরো। অদ্ভুত রকম ভালো লাগছে লিমনের। সে মনে মনে কামনা করছে এই ভালোলাগাটা যেন দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু তা হলো না। হঠাৎই ভেঙ্গে পড়ল পাটাতনটা। আর দুজনে দ্রুত নিচে পড়তে শুরু করল।

হালকা একটা ধাক্কা অনুভব করল লিমন। চোখ মেলে তাকাতে দেখে সে বিছানার উপর থেকে নিচে পড়ে গেছে। আর বাইরের জানালাটা খোলা, সেখান দিয়ে বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটা ভিতরে আসছে।

লিমন ঘড়ি দেখল। ছয়টা বাজে। তার মানে সকাল হয়েছে। বুঝতে পারল পিয়াকে নিয়ে সে যা কিছু দেখেছে সবই ছিল স্বপ্ন। বাইরে এখনো ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। কীভাবে যেন দক্ষিণের জানালাটা খুলে গেছে। সেখান দিয়েই বৃষ্টির ঝাপটা ভিতরে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার বিছানা। তাড়াতাড়ি উঠে জানালা বন্ধ করল সে।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা স্বপ্ন ছিল, বোঝার পরও কেন যেন ভালো লাগার ভিন্ন আবেশ তার মধ্যে কাজ করছে। সে এবার পূর্বের জানালাটা খুলল। এই জানালা দিয়ে পিয়ার জানালা দেখা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। পিয়ার রুমের জানালা বন্ধ।

১১

পিয়া, ঝুমুর আর নুপূর রক্তসাধনালয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে তারা মোবারকের শরীর থেকে টিউবের মাধ্যমে রক্তপান শেষ করেছে। মোবারকের রক্ত তারা প্রতিদিন পান করে না। একদিন পর একদিন করে। এতে মোবারককে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে। একটা টিস্যু দিয়ে নিজের মুখ মুছে পিয়া নুপূরকে বলল, কতদিন হলো মোবারক এখানে আছে?

ছয় দিন।

কেউ কিছু টের পেয়েছে?

না আপু।

তোমাকে ধন্যবাদ। খুব সুক্ষভাবে কাজটি তুমি করতে পেরেছ। ঝুমুর কী কাউকে টার্গেট

করেছ?

ঝুমুর মাথা ঝাকিয়ে বলল, হ্যাঁ আপু।

কে সে?

পাশের বাড়ির লিমন। ছাদের উপর থাকে।

লিমন!

হ্যাঁ। আপনার নিশ্চয় রুবায়েতের কথা মনে আছে। আগেরবার তাকে টার্গেট করেছিলাম। পরে লাশটি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছিলাম।

পিয়া মনে হলো খানিকটা বিরক্ত হলো। একটু সময় নিয়ে বলল, না তুমি তাকে টার্গেট করতে পারবে না।

কেন আপু?

একই জায়গার মানুষদের বার বার টার্গেট করলে আমরা নিজেদের বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারব না। দূরের কাউকে টার্গেট করো। তাকে এখানে নিয়ে আসো। তারপর কী করতে হবে আর তো বলার দরকার নেই।

তাহলে লিমনকে কী টার্গেট করব না?

না। লিমনকে নিয়ে আমার ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

কী পরিকল্পনা আপু?

পিয়া এবার লম্বা শ্বাস নিল। তারপর বলল, তোমরা জানো আমরা যারা মানুষের রক্ত পান করি তাদেরকে আমরা রক্তপ বলি। এই রক্তপদের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব কম। রক্তপদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা এসেছে যে আমাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু কাজটা অত্যন্ত কঠিন। তারপরও করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো নিজেদের সংসার সৃষ্টি করা এবং সন্তান জন্মদান করা। এই সন্তানদের সবাই হবে রক্তপ। এজন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে। বিয়ের ক্ষেত্রে এমন কাউকে বেছে নিতে হবে যে আমার থেকে বয়সে ছোট এবং যাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এ উদ্দেশ্যে আমি একজনকে টার্গেট করেছি।

নুপূর চোখ কুচকে বলল, কে সে?

লিমন।

কী বলছেন!

হ্যাঁ সত্য। প্রাথমিকভাবে তাকে ভালো মনে হয়েছে। সে কিছুটা ভীতু। দলে টানতে সহজ হবে। তাকে আমরা ব্যবহার করতে পারব।

কিন্তু সে কী আমাদের মতো রক্তপান করবে?

না করার কোনো কারণ নেই। আমার রক্ত তার শরীরে থাকবে।

এই ঝুকি নেবেন?

হু নিতেই হবে। এই ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে। তাহলে আমি তার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারব। একইসাথে আমার জীবন বেশি নিরাপদ হবে।

কিন্তু তখন তো ধীরে ধীরে আপনি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবেন?

আমার ইচ্ছে তোমাদের সাথেই থাকার। আমি সেভাবেই উপরে জানাব। আমার বিশ্বাস, আমাদের মধ্যে বন্ধন আরো দৃঢ় হবে। হ্যাঁ, তবে এটা সত্য আমার সন্তানকে হয়তো দিয়ে দিতে হতে পারে। যেমন তোমরা আমরা সাথে আছো, তোমাদের আসল পিতামাতা কে তোমরা জানো না। তোমরা শুধু আমাকে চিনো। তোমরা দুজন বড় হয়েছ ভিন্ন দুই জায়গায়। তারপর কয়েক বছর ধরে আছো আমার সাথে। তোমরা পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারলে আমার মতো ক্ষমতাবান হবে। জানি না কবে তোমাদের ডাক পড়বে। ডাক পড়লে তোমাদের যেতেই হবে। হয়তো আমার মতো কেউ হবে তোমরা। সেজন্য সাধনা করতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এখন আমরা একটি পরিবার হিসেবে বসবাস করছি। তোমাদেরও একসময় আমার মতো পরিবার হবে। তখন তোমরা হবে আরো সুখী, এখন যেমন আমি। যাইহোক, আমার মূল টার্গেট লিমন। লিমনকে আমাদের পরিবারের সদস্য করার জন্য যা কিছু করার সবকিছু করবে তোমরা। ঠিক আছে?

কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে?

আমি তাকে তৃষ্ণার্ত করে তুলব।

সত্যি আপনার জীবন ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

সমস্যা নেই। মানুষ তার জীবনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমি বিশ্বাস করি লিমনও তার জীবনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে। এজন্য সে এত সহজে আমার জন্য ঝুকিপূর্ণ হবে না।

তারপরও..

না ভয়ের কোনো কারণ নেই। ‘রক্তপ’দের নির্দেশনা আমাকে মানতেই হবে। বৃদ্ধি করতে হবে আমাদের সংখ্যা।

আপনি যেভাবে বলবেন আমরা সেভাবেই কাজ করব।

ধীরে ধীরে আমি তোমাদের পথ দেখিয়ে দেব। সেই পথে তোমরা এগোবে। দেখবে পৃথিবীটা বড় আনন্দের।

আচ্ছা।

আর হ্যাঁ, নাচের স্কুলেল ছাত্র ছাত্রী যারা এসেছিল তাদের কে কী চা খাইয়েছিলে?

ঝুমুর উপরে নিচে মাথা ঝাকি দিয়ে বলল, হ্যাঁ।

রক্ত ছিল চায়ের মধ্যে?

ছিল।

কত ফোটা ছিল?

প্রত্যেক কাপে দুই ফোটা।

কিছু টের পেয়েছে?

না কেউ কিছু টের পায়নি।

যারা নাচতে এসেছিল তারা?

অভিভাবকরা অনেকেই বাচ্চাদের চা খেতে দিতে চায় নি। তবে যারা খেয়েছে সবাই পছন্দ করেছে। দুজন অভিভাবক দু’বার চা নিয়েছে।

চমৎকার। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে অভিভাবকদের চা খাওয়াবে। চায়ের মধ্যে দুই থেকে তিন ফোটা রক্ত দেবে। যারা এরকম চা পছন্দ করবে তাদের চিহ্নিত করতে হবে আমাদের। ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করবে চায়ে রক্তের পরিমান। যদি তারা পছন্দ করে একসময় তাদেরকে আমাদের দলে নিয়ে আসার চেষ্টা করব। এভাবেও আমরা আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারব। পারবে না?

নুপূর এবং ঝুমুর দুজনেই মাথা ঝাকিয়ে বলল, অবশ্যই পারব।

একসময় আমাদের সংখ্যা হবে অনেক। তখন আমাদের দিনগুলো আরও উজ্জ্বল এবং আনন্দময় হবে। সেই দিনগুলোর অপেক্ষায় আছি আমি। যাইহোক, নুপূর তুমি মোবারকের প্রতি লক্ষ রেখো। আমি চাই না সে খুব দ্রুত মৃত্যুবরণ করুক।

ঠিক আছে।

এপর উঠে গেল পিয়া।

পিয়া চলে গেলে ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আপু লিমনকে বিয়ে করবে, সিদ্ধান্তটা কেমন হলো?

নুপূর ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘রক্তপ’দের নির্দেশনা। উপেক্ষা করার উপায় নেই।

কিন্তু..

কিন্তু কী?

আমি নিজে তাকে টার্গেট করেছিলাম।

এ বিষয়ে আর কথা বলে লাভ হবে না। আপুর পছন্দই বড়। তার বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

আমি তা বলছি না। আমাকে আবার নতুন কাউকে খুঁজতে হবে।

এটা বড় কিছু নয় আমাদের জন্য। রাস্তার নানা মানুষকে নানাভাবে প্রলোভিত করে গোপনে এখানে নিয়ে এলেই হলো। আগে তো আমরা এই কাজ করেছি। আর হ্যাঁ, আশেপাশের মানুষকে এখানে না আনাই ভালো। আমার কী মনে হয় হয় জানো?

কী?

মানুষজন আমাদের সন্দেহ করতে শুরু করেছে।

ঝুমুর ভ্রূ কুঁচকে বলল, হঠাৎ এরকম মনে হওয়ার কারণ?

সকালে পুলিশ এসেছিল নাচের স্কুল সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে।

জানি। আগেও একবার এসেছিল পুলিশ। আমরা কী করি, কীভাবে চলি, নানা প্রশ্ন

করেছিল।

এবার মনে হলো সন্দেহটা আগের থেকে বেশি। এজন্য আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত তুমি কী চাচ্ছ বাড়ি পালটাতে?

বিষয়টা ওরকমই।

আপুর সাথে কথা বলতে হবে। দেখি উনি কী বলেন।

এরপর ঝুমুর উঠে গেল।

নুপূর এবার ধীরে ধীরে কফিনের উপরের ডালা খুলল। ভিতরে মোবারক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার বাম হাতে স্যালাইন চলছে। নুপূরকে দেখে কিছু বলার চেষ্টা করল মোবারক। কিন্তু পারল না। তার মুখটা শক্ত করে বাঁধা।

নুপূর হাঁটু গেড়ে বসল কফিনের পাশে। তারপর মোবারকের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি দুঃখিত, তোমার জন্য আসলে কিছু করতে পারছি না। এমন কী তোমার মৃত্যুও যে ত্বরান্বিত করব সেই ক্ষমতাও আমার নেই। কারণ তুমি রক্তপদের নিয়ন্ত্রনের চলে এসেছ। তোমার রক্ত বড় স্বাদের। পিয়া আপু খুব পছন্দ করেছে। এজন্য তোমাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে বলেছেন। কেন জানো? দীর্ঘ দিন ধরে বড় তৃপ্তির সাথে তোমার রক্ত পান করা যাবে।

কথাগুলো শুনে মোবারকের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

নুপূর বলে চলল, একদিক দিয়ে সৌভাগ্যবান। তুমি বেশিদিন বেঁচে থাকবে। তোমার রক্ত পছন্দ না হলে আপু দ্রুতই তোমার রক্ত নিঃশেষ করে ফেলতেন। সেক্ষেত্রে এই কফিনে তোমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটত অল্প কয়েকদিনে। যাইহোক, ভয় পাবে না। ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ তোমার এখানেই মৃত্যু লেখা আছে। তোমার লাশ ডুবে যাবে বুড়িগঙ্গায়। এর ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। আর হ্যাঁ, কিছুটা কষ্ট তো হবেই। একভাবে এভাবে মূর্তির মতো শুয়ে থাকা বড় কষ্টের। তৃষ্ণাও নিশ্চয় পেয়েছে। হয়তো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কিন্তু কিছু করার নেই। তোমার মুখের বাঁধন খোলা যাবে না। খুলে যদি পনি দেই সেটা হবে আরও বিপদজনক। কারণ পানির পিপাসা তোমার বাড়তেই থাকবে। স্যালাইন থেকে যে পানি তোমার শরীরে যাচ্ছে ঐ পানিই তোমার তৃষ্ণা মিটাবে। কাজেই কষ্ট হলেও সহ্য করতে হবে। তবে একটা কথা সত্য, তুমি বড় শান্ত এবং ভালো। আগেরজন খুব বিরক্ত করত। খুব ছটফট করত। বেশ যন্ত্রণা দিয়েছিল আমাদের। এজন্য তার মৃত্যুটাও হয়েছিল যন্ত্রণাময়। আশা করছি তোমার মৃত্যু যন্ত্রণাময় হবে না। হবে শান্তির, একেবারেই শান্তির। আজ তাহলে বিদায়। ভালো থেকে।

মুচকি একটা হেসে উপরের ঢাকনাটা নিচে নামিয়ে আনল নুপূর। এতে মোবারক আবার হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

১২

সন্ধ্যার পর লিমন টিউশনিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মন তার ভালো। পরীক্ষাগুলো মনের মতো হচ্ছে। রেজল্টটা আশানুরূপ হবে বলে তার বিশ্বাস। আগামী তিন দিন কোনো পরীক্ষা নেই। এজন্য চাপ কম।

লিমন ঘড়ি দেখল। সাড়ে ছয়টা বাজে। মাগরেবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তার আজ বিকেলে টিউশনিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার ছাত্র কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। এজন্য ছাত্রের মা সাড়ে সাতটার সময় যেতে বলেছেন। হাতে সময় আছে। এখান থেকে ছাত্রের বাসায় যেতে খুব বেশি সময় লাগে না।

মোবাইল ফোন বেজে উঠলে লিমন দেখল ছাত্রের খালা ইমা ফোন করেছে। ইদানিং ইমা তাকে প্রায়ই ফোন করে। লিমন ঠিক করেছে ইমাকে সে ফোন করতে নিষেধ করবে। কিন্তু বলা হয়নি। কেন যেন আবার বলতেও ইচ্ছে করে না। মেয়েটা আসলে যেমন সুন্দর তেমনি ভালো। এরকম একজন মেয়েকে নিষেধ করা যায় না।

ফোন ধরতে ইমা বলল, কেমন আছেন?

জ্বি ভালো।

আপনি কখন আসছেন?

সাড়ে সাতটায়।

আজ আপনার ছুটি।

ছুটি!

হ্যাঁ। আমাদের বাইরে থেকে ফিরতে দেরি হবে।

তাহলে কী আরও পরে আসব?

শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন? আপনার পড়া আজ আমি পড়িয়ে দেব। আপনাকে ছুটি দিয়ে দিলাম।

আপনার আপা জানেন?

হ্যাঁ জানে। আপাই বলেছে আপনাকে ফোন করতে। আপার ফোনে চার্জ নেই।

ও আচ্ছা।

ইমা মিষ্টি হেসে বলল, একটা ধন্যবাদ তো দেবেন। এত সুন্দর একটা সংবাদ দিলাম।

ধন্যবাদ।

আমার কিন্তু মন খারাপ।

কেন?

আজ সকালে আপনার জন্য একটা খাবার বানিয়েছিলাম। কিন্তু আপনাকে খাওয়াতে পারলাম না। কষ্টটা আমার বৃথা গেল। আপনার জন্য কিছু করতে চাইলে সেগুলো কেন যেন হয় না। কোথা থেকে যেন একটা বাধা আসে। কেন বলুন তো?

.. আপনি এভাবে বলছেন কেন?

আমি জানি না। বলতে ইচ্ছে করছে তাই বলছি।

আপনার সাথে এত কথা বলা ঠিক না। আপনার আপা জানলে কী মনে করবেন?

কিছু মনে করবে না। তাছাড়া আপা জানতে পারবে না। আপার কাছ থেকে আমি দূরে আছি।

তা আছেন। তবে বিষয়টা যৌক্তিক না।

কেন যৌক্তিক নয়?

আমি আপনাদের বাসায় টিউশনি করি। কাজেই আপনার সাথে আমার কথা বলার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আপনি আমার ছাত্রী নন।

ছাত্রী না হলে কী হয়েছে? অন্য কিছু তো হতে পারি।

লিমন অপ্রস্তত ভঙ্গিতে বলল, অন্যকিছু..ইয়ে.. মানে… কী বলতে চাচ্ছেন?

আমি যা বলছি সত্য বলছি। আপনি তো ছোট মানুষ নন। সবকিছু বুঝতে পারেন। বুঝেও কেন না বুঝার ভান করেন। এটা কী ঠিক? ইচ্ছে করে আপনি আমাকে কষ্ট দেন? এটা কী অন্যায় নয়?

ইমা, আমি রাখি।

না রাখবেন না।

কেন?

আপনার সাথে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আপনি ফোন কেটে দিলে আমি আবার ফোন করব, তারপর আবার। দেখব কতক্ষণ আপনি আমার ফোন না ধরে থাকতে পারেন।

আপনি ভুল করছেন।

ভুল না সঠিক, তা আমি ভালো বুঝি। আর হ্যাঁ, আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলেন কেন? আপনার থেকে আমি বয়সে ছোট। এখন থেকে তুমি করে বলবেন।

এর কী প্রয়োজন আছে?

সেটা আমি বুঝব।

আমি তো কোনো কারণ দেখছি না।

সবকিছুর মধ্যে এত কারণ খুঁজেন কেন? আপনি সবকিছু সহজভাবে নেবেন। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?

হ্যাঁ পেরেছি। তবে আপনার..

আবার আপনি বলছেন। ‘তুমি’ করে বলুন।

আপনি..

না না, ‘তুমি’ করে বলুন। তা না হলে আজ ফোন ছাড়ব না।

আচ্ছা ঠিক আছে, ‘তুমি’ করে বললাম। কিন্তু এগুলো পাগলামি ছাড়া কিছু না।

আপনার জন্য আমার পাগলামি করতে ভালে লাগে। কেন লাগে তা জানি না। এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমি আপনার জন্য যা কিছু করার সবকিছু করব। হোক তা পাগলামি কিংবা অস্বাভাবিক। যাইহোক, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। আপনি আমাকে ‘তুমি’ করে বলেছেন। আমার মনে হচ্ছে জীবনে সবচেয়ে সুন্দর সময়টা এখন পার করছি। খুব ভালো লাগত যদি সামনাসামনি আপনাকে দেখতে পারতাম এবং আপনার কাছ থেকে ‘তুমি’ সম্বোধন শুনতে পারতাম। যাইহোক, আজ রাখি, ভালো থাকবেন।

এরপর ইমা লাইন কেটে দিল।

লিমন ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ইমা যে তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে এই বিষয়ে সে নিশ্চিত। ইমাকে যে তার নিজেরও ভালো লাগে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তবে ইমার প্রতি আগ্রহী হওয়া যে ঠিক হবে না তা সে ভালোমতোই জানে। এ কারণে নিজে খুব সতর্ক সে। তাই আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকল লিমন। আর তা হলো, ইমার সাথে সাধারণ কথাবার্তা বলে যাবে, কিন্তু ইমার প্রেমে মগ্ন হবে না। কারণ তার আর ইমার সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য আকাশ পাতাল। তাদের দুজনের যে কোনোদিন মিল হবে না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কাজেই অহেতুক অন্যকে কষ্ট দেয়া কিংবা নিজের কষ্ট পাওয়ার যে কোনো অর্থ হয় না তা সে উপলব্দি করে। এই উপলব্দির কারণেই চূড়ান্তভাবে নিজেকে সংবরণ করার সিদ্ধান্ত নিল সে।

টিউশনিতে যেতে হবে না এই সংবাদটি পাওয়ার পর তার অন্যরকম ভালোলাগার সৃষ্টি হয়েছে। আসলেই তার আজ টিউশনিতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। পরীক্ষার কারণে দুই দিন যেতে পারেনি, এজন্য যাওয়াটা আজ জরুরী ছিল। যেহেতু ছাত্রের পক্ষ থেকে যেতে নিষেধ করা হয়েছে আর কোনো সমস্যা নেই। এখন সে মুক্ত।

লিমন রুম থেকে বের হয়ে এলো। সজলের রুম তালা দেয়া। প্রায় চারদিন হলো সজলের সাথে তার দেখা নেই। তাই ফোন করল সজলকে। প্রথবার ফোন ধরল না। দ্বিতীয়বার ফোন করতে ধরল সে। বলল, কী খবর লিমন?

আমি ভালো আছি সজল ভাই, আপনি কোথায়?

মানকিগঞ্জে।

কী করছেন ওখানে?

ফিল্ড ভিজিটে এসেছি। তবে খারাপ লাগছে না। অবশ্য তোমাকে বলে আসা উচিত ছিল। কিন্তু পারিনি। প্রাইভেট চাকরি তো, যা হুকুম করে তাই মানতে হয়। তো কী মনে করে?

ভেবেছিলাম আপনি ফিরে এলে একসাথে খাব।

না আজ ফিরব না।

কবে ফিরবেন?

ঠিক নেই। এখানে কাজ শেষ হলে কোম্পানী হয়তো বলবে নরসিংদী যাও, নতুবা গাজীপুর যাও। যাইহোক, সুযোগ পেলেই চলে আসব। এমনিতে কোনো অসুবিধা নেই তো?

না নেই।

পরীক্ষা কেমন হলো তোমার?

ভালো হয়েছে। এখনো শেষ হয়নি। আরও কয়েকটা আছে।

আশা করি ভালো করবে। তবে প্রাইভেট চাকরি করবে না। একেবারে গাধার খাটুনি। হয় সরকারী চাকরি করবে, তা না হলে ব্যবসা। ব্যবসা বেশি ভালো। একটা ব্যবসার লাইন বের করো।

আমি কীভাবে করব?

তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে। চেষ্টা করলে পারবে। দুজনে একসাথে করব।

আপনি তো গাজীপুর চলে যাবেন বলছিলেন।

তা অবশ্য ঠিক। তবে অসুবিধা নেই। ব্যবসা গাজীপুর আর ঢাকা দুই জায়গায়ই হবে। তুমি পরিকল্পনা করো। ফিরে এসে দুজনে আলোচনা করব। এখন রাখি।

আচ্ছা ভাইয়া।

কথা বলতে বলতে লিমন ছাদের একেবারে কোনায় এসে দাঁড়িয়েছিল। কথা শেষ হতেই পিছন থেকে এক নারীকণ্ঠ বলে উঠল, কার সাথে কথা বলছিলে?

লিমন চমকে উঠে যাকে দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। পাশের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পিয়া। তার থেকে দূরত্ব মাত্র পাঁচ ফিট হবে। পিয়াকে সে এত কাছ থেকে আগে কখনো দেখেনি।

১৩

পিয়া, অপূর্ব সুন্দরী পিয়া। লিমন জীবনে বহু নারীকে দেখেছে। কিন্তু পিয়ার মতো কাউকে দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না। নীল শাড়ীতে কাচা হলুদের মতো গায়ের রঙের পিয়াকে যেন অজানা দেশ থেকে আসা এক পরীর মতো মনে হচ্ছে। কানের ছোট্ট দুলও নীল, নীল হাতের চুড়িগুলোও। এ যেন সত্যি এক নীল পরী। কোমর পর্যন্ত নেমে যাওয়া উড়ন্ত চুলগুলো যেন তার সৌন্দর্যকে কয়েকগুন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। লম্বাও কম না, লিমন অনুমান করল পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হবে। মুখে হালকা একটা হাসি, কেমন যেন রহস্যময়। আর টান চোখ, একেবারে অদ্বিতীয়। দৃষ্টির গভীরতা যেন একেবারে হৃদয় ছুয়ে যায়। পিয়ার এই রূপ যে একবার দেখবে, বার বার দেখতে চাইবে। লিমনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না, সে তাকিয়ে থাকল পিয়ার দিকে।

পিয়া আবার প্রশ্ন করল, কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?

এবার যেন বাস্তবে ফিরে এলো লিমন, বলল, সজল ভাইয়ের সাথে। পাশের রুমে থাকে। কোথায় আছেন উনি?

মানিকগঞ্জে।

আসবেন কবে?

ঠিক বলতে পারছেন না।

পিয়া মাথা ঝাকিয়ে রহস্যময় হাসিটা খানিকটা বিস্তৃত করে বলল, তার মানে তুমি একা। হ্যাঁ একা।

আমিও কিন্তু একা।

মাথাটা খানিটকা বামে ঘুরিয়ে বলল, পিয়া।

লিমন একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। পিয়া কী বলছে তার যেন ঠিক মাথায় ঢুকছে না।

এদিকে লিমনের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে পিয়া খিল খিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তোমার সাথে মজা করছিলাম। শোনো, আমার নাম পিয়া। এ বাড়িতেই থাকি। একটা নাচের স্কুল চালাই। তোমাকে বেশ কয়েকদিন ছাদের উপর দেখেছি। পরিচয় হয়নি আমাদের। তবে ঝুমুরের কাছ থেকে তোমার কথা শুনেছি। তোমার নাম লিমন, তাই না?

জ্বি।

ঝুমুর তোমার খুব প্রশংসা করেছে। বলেছে তুমি খুব ভালো। আমারও কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে।

লিমন কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না।

পিয়া আবার নিজে থেকেই বলল, তোমার সাথে আর কে থাকে?

কেউ না, আমি একা।

তোমার বাবা মা, ভাই বোন?

কেউ নেই।

নেই কেন?

আসলে আমি বড় হয়েছি একটি এতিমখানায়।

পিয়া চোখ কুঁচকে বলল,

এতিমখানায়?

হ্যাঁ, আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আমাকে রাস্তায় এক ভদ্রলোক খুঁজে পায়। তারপর এক এতিমখানায় দিয়ে দেয়। ওখানেই বড় হয়েছি আমি।

তার মানে তোমার বাবা-মা, ভাই বোন কেউ নেই?

না নেই।

কী অবিশ্বাস্য! আপন কেউ ছাড়া মানুষ বাঁচে কীভাবে? তোমার তো আপন কেউ দরকার। তাই না?

সজল ভাই আছে।

তোমার সজল ভাই কবে আসবে কিছু বলতে পারছ না। এটা কেমন কথা? আপন মানে এমন কেউ যে কিনা সবসময় তোমার খোঁজ খবর রাখবে, সময়ে অসময়ে তোমার সাথে সুখ দুঃখের বিষয়গুলো ভাগাভাগি করবে, পারস্পরিক আনন্দগুলো উপভোগ করবে, তোমার বিপদে এগিয়ে আসবে, প্রয়োজনে সাহায্য করবে। অথচ তোমার সজল ভাই কবে আসবে তা তোমাকে জানাচ্ছে না। এটা কেমন হলো?

লিমন কথা হারিয়ে ফেলল। সে শুধু উপরে নিচে মাথা দুলাল।

পিয়া এবার টেনে টেনে বলল, তুমি চাইলে আমি তোমার আপন কেউ হতে পারি।

ইয়ে.. মানে….

এতে ইতস্তত করার কিছু নেই। আজকাল ছেলে মেয়েরা বন্ধু হচ্ছে না।

আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়…

বয়স কোনো বিষয় না। দেখবে মানুষটা কেমন। আমাকে কী তোমার খারাপ মনে হচ্ছে? আমি আসলে তা বলছি না।

তাহলে সমস্যা কোথায়? তোমাকে আমার সত্যি ভালো লেগেছে। তোমাকে দেখে অন্তত আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি তুমি অত্যন্ত ভালো ছেলে এবং আমার ক্ষতি করবে না। তো আসো না একদিন আমার বাসায়।

তোতলাতে তোতলাতে লিমন বলল, ....পনার বাসায়?

হু। আসো, তোমাকে পায়েস খাওয়াব। আমি খুব ভালো পায়েস রাঁধতে পারি। তুমি পায়েস পছন্দ করো?

আমি আসলে…

বুঝেছি তুমি লজ্জা পাচ্ছ। লজ্জার কিছু নেই। কবে আসবে?

আ… আ.. আমি ঠিক….

আচ্ছা তুমি আমাকে বিশ্বাস না করলে তুমি নিজেই সময় সুযোগ বুঝে এসো।

না না, আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি।

তাহলে ইতস্তত করছ কেন? আমি কিন্তু সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসি। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, আমি তোমাকে বলেছি। ভালো না লাগলে বলতাম তোমাকে ভালো লাগেনি। আচ্ছা আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করি?

জ্বি করুন।

একটু সময় নিয়ে পিয়া বলল, আমাকে তোমার কেমন লেগেছে?

ইয়ে.. মানে..

এই যে আমাকে দেখলে, আমার সাথে কথা বললে, আমি তোমার প্রশংসা করলাম। তারপর আমার বাসায় আমন্ত্রণ করলাম। খুব সহজ হয়ে গেলাম তোমার সাথে, তাই না?

জ্বি জ্বি, ভালো লেগেছে।

শুধুই ভালো, নাকি বেশি ভালো?

রহস্যময় হাসি হেসে প্রশ্নটা করল পিয়া।

লিমন ঢোক গিলে বলল, বেশি ভালো।

কিন্তু তুমি কিন্তু তোমার আচরণে সেটা আমাকে বুঝতে দাওনি। আমার প্রতি যথেষ্ট সৌজন্যতা প্রদর্শন করোনি।

কী বলছেন আপনি?

চোখ বড় বড় করে বলল লিমন

পিয়া এবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলল। তারপর টেনে টেনে বলল, এই যে আমি

তোমাকে আমার বাসায় আমন্ত্রণ করলাম। তোমার উচিত ছিল না আমাকেও তোমার বাসায়

আসতে বলা।

আসলে আমার এখানে তো কেউ নেই।

তাতে কী? তুমি তো আছ?

বিষয়টা আসলে কেমন হয়ে যায় না? কে কী মনে করবে?

পিয়া এবার খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, তুমি যে কী বলো না? আমি তোমার বাসায় যাব। আমি যদি কিছু মনে না করি তাহলে কে কী মনে করবে? পাশাপাশি বাসায় আমরা থাকি। একজন তো অন্যজনের বাসায় আসতেই পারি। তাই না?

জ্বি।

তাহলে তোমার রুমে এসে আমি চা খাব। চা বানাতে পার তো? হ্যাঁ পারি।

আর কী কী পারো আমি কিন্তু দেখব।

লিমন কী বলবে বুঝতে পারল না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

আবারও খিল খিল করে হেসে উঠল পিয়া। তারপর বলল, আমার বিশ্বাস তোমার অনেক যোগ্যতা আছে। সেটাই আমি দেখতে চাই। যাইহোক এখন বলো, কবে আসব তোমার ওখানে?

আপনি.. আমার.. এখানে…

তুমি তো আমার বাসায় আসার তারিখ সময় কিছুই বললে না। তোমার ওখানে আসার সময়টা আমাকে বলো।

মহাবিপদে পড়ল লিমন। কী বলবে সে। না বললে আবার পিয়া কী মনে করবে? একজন তার বাসায় আসতে চাইছে, তাকে না করবে কীভাবে? শেষে কৌশলে বলল, আপনার যখন ইচ্ছে তখন আসবেন।

পিয়া এবার মুচকি হেসে বলল,

ঠিক তো? উপরে নিচে মাথা দুলাল লিমনা।

তোমার আমন্ত্রণ আমি উপেক্ষা করব না। অচিরেই এসে হাজির হব। এখন যাই, কিছু কাজ আছে, শেষ করতে হবে।

মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে পিয়া ঢুকে গেল তার কক্ষে। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। এদিকে বিস্ময়ের ধাক্কাটা যেন সামলে উঠতে পারছে না লিমন। সে স্বপ্নে যা কিছু দেখেছিল, যতটুকু বিস্মিত হয়েছিল, তার থেকে আজকের ঘটনা এবং বিস্ময় অনেক অনেক বেশি। এ মুহূর্তে পা দুটোও যেন স্থবির হয়ে গেছে তার। হেঁটে যে নিজের কক্ষে যাবে সেই শক্তিটুকুও যেন নেই। তাই সে স্থির দাঁড়িয়েই থাকল। এরকম অবস্থা তার আগে কখনো হয়নি, এই প্রথম।

১৪

রাতে গরম হোটেলে খেতে এলো লিমন। হোটেল বয় ফরিদ এখনো ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছে। খাওয়া শেষ হলে মোবারকের খবর জানতে লিমন নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল, ফরিদ, কোনো খবর পাওয়া গেল মোবরক ভাইয়ের?

না স্যার।

এটা কেমন কথা?

সবাই এইরকমই বলতেছে। কেউ কিছু বুঝবার পারতেছে না।

পুলিশ কী বলছে?

দুইবার আইছিল। আর খোঁজ নাই।

এভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল মানুষটা।

আমরা নিজেরাও বিস্মিত হইছি। ভাবছিলাম কোনো জায়গায় হয়তো গেছে। দুই একদিনের মইধ্যে ফিরা আসবে। কিন্তু মেলা দিন পার হইয়া গেল, খবর নাই।

উনার আত্মীয় স্বজনের বাড়ি খবর নিয়েছ?

সব জায়গায়। কোথাও পাওয়া যায় নাই। এইডা কোনো কথা হলো।

কিছুই বুজবার পারতেছি না। চা খাবেন? চা দিব?

না খাব না। আজ চা পাতা কিনেছি। রুমে চা বানাব।

ও আচ্ছা। এহন কিছু লাগবে?

না লাগবে না। তোমরা মোবারক ভাইকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। বড় ভালো মানুষ ছিল সে। সবার সাথে মিশত। আর ছিল হাসিখুশি। সে না থাকলে হোটেলটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার লাগে।

হঁ স্যার ঠিক কইছেন। গরম হোটেলের যেন আর প্রাণ নেই। সবাই একই কথা কয়। তয় আমার বিশ্বাস..

কী বিশ্বাস?

আইজ হোক, কাইল হোক হে ফিরা আসবেই। এই হোটেলের টান থাইকা দূরে থাকবার পারবে না।

তাই যেন হয়।

এরপর বিল দিয়ে বের হয়ে এলো লিমন। বাসার নিচে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। উপরে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যার ঘটনাটা তাকে দারুনভাবে প্রভাবিত করেছে। ছাদের উপর পিয়ার সাথে কথা বলার ঘটনাটা একেবারে স্বপ্নের মতো। তবে আজকের কথপোকথন যে স্বপ্ন ছিল না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। আর এজন্যই সে ভয়ে আছে। সত্যি যদি পিয়া তার রুমে চলে আসে তখন কী হবে? সে চা খেতে চাইবে। এজন্যই সে চা পাতা, দুধ, চিনি সবকিছু কিনেছে। কিন্তু এরকম কেনাটা কী যৌক্তিক হয়েছে? এই প্রশ্ন নিজেকে করে নিজেই উত্তর খুঁজতে লাগল সে। উত্তর একটাই পাচ্ছে, পিয়া তাকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু কীভাবে? পিয়া অসাধারণ সুন্দরী এজন্য? নাকি খুব সুন্দর করে কথা বলে এজন্য? নাকি অন্য কিছু। সঠিক উত্তর সে আসলে খুঁজে পাচ্ছে না। এজন্য একরকম অস্থিরতায় ভুগছে সে। এ মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে রুমে না গিয়ে অন্য কোথাও গেলে ভালো হয়। কিন্তু কোথায় যাবে? যাওয়ার মতো জায়গা যে তার নেই। শেষে যা হয় হবে ভেবে উপরের দিকে পা বাড়াল।

রুমে ফিরে আসার পর অস্বস্তি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল লিমনের। পূর্ব পাশের জানালাটা বন্ধ আছে। এই জানালা দিয়ে পিয়ার রুম দেখা যায়। দক্ষিনের জানালাটা খোলা। এই জানালার ওপাশে ছাদের খানিকটা জায়গা। তারপর নদী। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল লিমন। নদীর হালকা বাতাস মুখে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে। কিন্তু কেন যেন তার জানালা খুলে রাখতে ইচ্ছে করছে না। তাই বন্ধ করে দিল।

লিমন অনুধাবন করছে তার এখন ঘুমানো খুব প্রয়োজন। গত কয়েকদিন পড়াশুনার বেশ ধকল গিয়েছে। কিন্তু তার শুতে ইচ্ছে করছে না। তার ধারণা শোয়ার সাথে সাথে পিয়াকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখবে। এখন তাহলে কী করা যায়? সজল আসতে পেরে এরকম একটা ভাবনা থেকে সজলের রুমের সামনে এলো। রুম তালা মারা।

শেষে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিল সজল। মাথায় হালকা ঝিমঝিমানি ভাব আছে। লম্বা ঘুম হলে এই ভাবটা কেটে যাবে। তখন এমনিতেই ভালো লাগবে।

শোয়ামাত্র দরজায় টোকার শব্দ হলো। লিমনের বুকটা তার দুরু দুরু করে উঠল। কিছু বলার আগে আবার দরজায় টোকা পড়ল। এবার সে বিছানা থেকে উঠে বলল, কে?

আমি।

একজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেল।

অবাক হলো লিমন। এত রাতে কে আসবে? আবার প্রশ্ন করল,

সাব ইন্সপেক্টর হাফিজ। থানা থেকে এসেছি। দরজা খুলুন।

আমি কে?

থানা থেকৈ একজন সাব-ইন্সপেক্টর এত রাতে এসেছে শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গেল লিমন। তবে সে দরজা খুলল। দেখল পুলিশের পোশাক পরা অল্পবয়সী এক ব্যক্তি। বলল, ভিতরে আসুন।

ভিতরে এসে চেয়ারে বসলে লিমন বলল, এত রাতে আপনি?

আসলে এই থানায় আমি নতুন। প্রথমেই দুটো কেস পেয়েছি। এজন্য এসেছি আপনার কাছে। দিনেও এসেছিলাম। কিন্তু আপনি ছিলেন না। এ কারণে রাতে আসতে হলো।

কীসের কেস?

দুজন ব্যক্তি নিখোঁজ। একজন রুবায়েত। অন্যজন মোবারক। আগে এই দুটো কেস যে দেখত সে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। এখন এসে পড়েছে আমার উপর। তাই এলাম। এই রুমেই তো রুবায়েত থাকত। তাই না?

আমি শুনেছি।

তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কোনোকিছু আপনার জানা আছে?

না নেই।

ও আচ্ছা। কেস ডকেট পরে জানলাম পাশেরর রুমে সজল নামে কেউ একজন থাকে।

সে কোথায়?

মানিকগঞ্জ আছে।

আসলে আমার সাথে একটু কথা বলতে বলবেন। এই যে আমার নম্বর এখানে রেখে গেলাম। আমার বিশ্বাস উনি কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাকে দিতে পারবেন।

আমি তাকে বলব। তবে আমার তেমন কিছু জানা নেই।

আপনি জনবেন না স্বাভাবিক। আপনি নতুন এসেছেন। সজল সাহেব তো আগে থেকেই ছিলেন। তাই না?

জ্বি।

মোবারকের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

সাধারণ সম্পর্ক।

কারো সাথে তাকে মিশতে দেখেছেন?

যারা হোটেলে আসতো সবার সাথেই সে কথা বলত।

আমি হোটেলের কথা বলছি না। বাইরের কারো সাথে তার কোনো সখ্যতা ছিল কিনা। এই যেমন ধরুন কোনো মেয়ে, কিংবা বান্ধবী।

আমার ঐ রকম জানা নেই।

কারো প্রতি কী সে আগ্রহী কিংবা দুর্বল ছিল?

নুপূরের কথা বলার ইচ্ছে হলেও নিজেকে সংবরণ করল লিমন। বলল, না।

একই জায়গা থেকে দুজন মানুষের হারিয়ে যাওয়া খুবই রহস্যময়। আচ্ছা, মোবারক আর রুবায়েতের মধ্যে কোনো যোগযোগ ছিল?

আমি জানি না। আমি আসলে এখানে নতুন এসেছি। তবে থাকতে পারে। কারণ এই এলাকায় হোটেল একটাই। রুবায়েত যেহেতু ব্যাচেলর ছিল খাওয়ার জন্য তাকে নিশ্চয় হোটেলে যেতে হতো। সেক্ষেত্রে পরিচয় থাকাটাই স্বাভাবিক।

আপনার কথায় যুক্তি আছে।

একটু সময় নিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ আবার বলল, আমার কী মনে হয় জানেন? কী মনে হয়?

এখানে একটি চক্র কাজ করছে।

কীসের চক্র?

জানি না। বের করতে হবে। তবে এই চক্রের কারণেই মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে এবং..

এবং কী?

আরো মানুষ নিখোঁজ হবে।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, তাই নাকি!

হু। ঢাকা শহরে ইদানিং নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কোথায় কীভাবে নিখোঁজ

হচ্ছে বুঝতে পারছি না আমরা। যাইহোক একসময় হয়তো বোঝা যাবে। তবে একটা কথা?

কী কথা?

আপনি সাবধানে থাকবেন।

কেন?

এই বাড়ি থেকে এবং এই বড়ির সামনে থেকে যেহেতু মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, আবারও হতে পারে।

কী বলছেন আপনি!

খুব স্বাভাবিক। এমনও হতে পারে যে আপনি নিজেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন।

লিমন ঢোক গিলে বলল, কী অবাস্তব কথা বলছেন? আমার তো কোনো শত্রু নেই।

হয়তো এটাই আপনাকে টার্গেট করার কারন হতে পারে। যাইহোক, সবই অনুমান থেকে বললাম। ভয় পাওয়ার কিংবা ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। আমরা সবসময় আপনাদের সাথে আছি। আসি তাহলে?

চা খাবেন?

চা!

হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে চা পাতা কিনে এনেছি।

আমার সত্যি খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে। তবে আজ খাব না। অন্যদিন। আসি লিমন সাহেব।

লিমন চোখ কুঁচকে বলল, আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?

আগের সাব-ইন্সপেক্টর সবকিছুই মামলার ফাইলে লিখে গেছেন। আপনার সম্পর্কেও লিখেছেন। তবে ভালো লিখেছেন। আসি তাহলে, ভালো থাকবেন। আর যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবেন।

দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ। লিমনের অবশ্য সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজকে ভালোই লেগেছে। কারণ তাকে আপনি করে সম্মান করে কথা বলেছে, একবার লিমন সাহেবও বলেছে। পুলিশের ব্যবহার সাধারণত ভালো হয় না, সবাইকে অপরাধী ভাবে। সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমটা কিছুটা হলেও ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি করল লিমনের মনে।

১৫

পুলিশের উপস্থিতি একরকম মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্ট করল লিমনের মনে। নিজেকে বড় একা মনে হচ্ছিল তার। সা-ইন্সপেক্টর হাফিজ আসায় সেই একাকিত্বটা চলে গেছে। কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলতে পেরেছে সে। কিন্তু সে যে বিষয়গুলো বলেছে সেটা আবার অস্বস্তিকর। নিখোঁজ ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য নিয়েছে এবং জানিয়েছে আরো মানুষ নিখোঁজ হতে পারে। বিষয়টা খুব অস্বাভাবিক। একটি জায়গা থেকে মানুষ নিখোঁজ হয়ে যেতে থাকবে, তাদের কোনো হদিস পাওয়া যাবে না, এই বিষয়টা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। লিমনও মেনে নিতে পারছে না। এজন্য অস্বস্তির পাশাপাশি হালকা ভয়ও কাজ করছে তার মধ্যে। আসলে এরকম একটা বাড়ির ছাদে একা থাকা সত্যি ভয়েরই ব্যাপার। সজল থাকলে এই ভয়টা হয়তো তার লাগত না। কিন্তু সজল আসবে না। এজন্য একাই থাকতে হবে তাকে। কিন্তু এভাবে একা থাকা তার জন্য দুঃসহ হয়ে পড়বে। এই উপলব্দিটা কেন যেন তার মধ্যে কাজ করছে। অথচ আগে তার মধ্যে এরকম উপলব্দি ছিল না। এখন সে যেটা বুঝতে পারছে তার একজন সঙ্গী দরকার যার সাথে সে কথা বলতে পারবে, সময় কাটাতে পারবে, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। যদি এরকম কাউকে পাওয়া যায় তাহলে হয়তো এই ছাদের নির্জন কক্ষে তার অবস্থানটা আনন্দময় এবং উপভোগ্য হবে।

কী করছ?

প্রশ্ন শুনে দরজার দিকে তাকাল লিমন। তারপরই চমকে উঠল। দাঁড়িয়ে আছে পিয়া। এখন সে লাল রঙের শাড়ি পড়েছে। কানের দুলও লাল রঙের। অথচ সন্ধ্যায় ছিল নীল রঙের। তখন তাকে মনে হচ্ছিল নীল পরি, আর এখন মনে হচ্ছে লাল পরি।

লিমন অপ্রস্তত ভঙ্গিতে বলল, ইয়ে.. না কিছু না। আপনি এখানে, এত রাতে!

তোমার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলাম।

.. আমার আমন্ত্রণ!

হু, তুমি না চা খাওয়াবে বলেছিলে। তাই চলে এলাম।

এত রাতে!

এত রাত কোথায়? কেবল তো এগারোটা বাজে।

কথা বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করল পিয়া। তারপর গিয়ে বসল লিমনের বিছানার উপর। পিয়া রুমে প্রবেশের সাথে সাথে চারপাশে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বিশেষ কোনো পারফিউমের। গন্ধটা খুব সুন্দর। প্রত্যেক শ্বাসে উপলব্দি করছে লিমন। তবে তার অস্বস্তিটা বেড়েছে। এত রাতে তার ঘরে একজন নারী, এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।

পিয়া এবার প্রশ্ন করে বলল, তোমার এখানে পুলিশ দেখলাম।

হ্যাঁ, সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ এসেছিল।

পিয়া সরু চোখে বলল, কী জন্য? তুমি কোনো অপরাধ করেছ?

লিমন তাড়াতাড়ি বলল, না না, তদন্তের কাজে এসেছিল।

কিসের তদন্ত?

রুবায়েত নামে যে আগে এই রুমে ছিল তার নিখোঁজ হওয়ার তদন্ত করতে। ঐ তদন্তভার তার উপর পড়েছে। একই সাথে হোটেলের মোবারক ভাইয়ের তদন্তও করছে সে। তাদের বিষয়ে জানতে এসেছিল।

এতদিনে যখন কোনো সন্ধান পায়নি, আর পাবে বলে মনে হয় না।

তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তুমি আবির এসবের মধ্যে জড়িও না।

না না, আমি জড়াব কেন?

পুলিশের ঠিক ঠিকানা নেই, কাকে কোন জায়গা থেকে জড়িয়ে দেয় বলা মুশকিল। নিজেকে সবসময় পুলিশ থেকে দূরে রাখবে।

ঠিক আছে।

এখন বলো, তোমার চা কই?

এত রাতে চা খাবেন?

খাওয়ার জন্যই তো এসেছি। চা নিয়ে বাইরে খোলা ছাদে বসব। তারপর গল্প করব।

লিমন অবাক হয়ে বলল, এত রাতে বাইরে বাসবেন!

তুমি শুধু এত রাত, এত রাত করছ কেন?

না মানে এমনি বললাম। আর একটি কথা…

কী কথা?

.. আপনি এলেন কীভাবে?

তুমি বোধহয় লক্ষ্য করোনি তোমার আর আমার, দুই ছাদেই কাঠের পাটাতন আছে। দুই বাড়ির ছাদের মাঝে যে ফাঁকা জায়গা তার উপর পাটাতনটা ফেলে দিলেই হয়। তোমাকে দেখিয়ে দেব। এখন চা বানাও, না তুমি পারবে না। আমি বানিয়ে দিচ্ছি। কই চা পাতা কই, দুধ কই, চিনি…

লিমন সবকিছু এগিয়ে দিলে পানি গরম দিল পিয়া। তারপর বলল, তোমার রুমটা দেখি বেশ অগোছাল। গুছিয়ে রাখো না কেন?

আমি চেষ্টা করি।

সময় করে এসে আমি গুছিয়ে দেব।

না না, দরকার হবে না।

হবে না কেন? তোমার জন্য কী আমি এটুকু কাজ করতে পারি না?

আমি বলছিলাম..

তোমাকে কিছু বলতে হবে না। তুমি বড় লাজুক ছেলে। এতটা লাজুক হলে এ যুগে চলতে পারবে না। অনেক স্মার্ট হতে হবে। অবশ্য তোমাকে আমার খুব পছন্দ। কেন জানো?

না।

তুমি খুব সহজ সরল।

কথাটা বলে জোরে মাথা ঝাকি দিল পিয়া। এতে পিয়ার লম্বা কিছু চুল মুখ ছুয়ে গেল লিমনের। আর তাতে নিজের মধ্যে ভিন্ন এক অনুভূতির সৃষ্টি হলো লিমনের মাঝে। এই অনুভূতিটা কেমন সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তবে অস্বস্তিটা এখনো কাটেনি, বরং বাড়ছেই।

রুমে চায়ের কোনো কাপ নেই। খানিকটা লজ্জায়ই পড়ল লিমন। পিয়া অবশ্য বিষয়টিকে আমলে নিল না। দুটো মগে দুজনের জন্য চা নিল। তারপর বলল, চলো, ছাদে গিয়ে বসি।

কোথায় বসব, চেয়ার নেই তো?

তোমার এই রুমের পিছনে কতগুলো ইট রাখা আছে। ওখানে বসব।

ইট আছে? আমি তো লক্ষ করে নি।

আমি করেছি। এসো আমার সাথে।

লিমন বাইরে এসে দেখলে তার রুমের দক্ষিণে জানালার ঠিক পাশে কতগুলো ইট আছে। এমনভাবে রাখা মনে হবে বুঝি নিচু কোনো বেঞ্চ। ঐ ইটের উপর বসে চায়ে চুমুক দিল পিয়া। তারপর নিজে থেকেই বলল, কই তুমি বসো?

আপনার পাশে বসব?

হ্যাঁ। তা না হলে কোথায় বসবে?

জায়গা খুব অল্প।

তাতে কী? আমি বসতে বলছি, বসো।

বিষয়টা কেমন হবে?

আহা, এখানে কী দেখার কেউ আছে? শুধু তুমি আর আমি। এসো বসো।

লিমন পিয়ার পাশে বসল। জায়গাটা আসলেই ছোট। শরীরের সাথে শরীর লেগে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে লিমন জীবনে আগে কখনো পড়েনি। দারুন অস্বস্তিতে ভুগছে সে।

পিয়া এবার বলল, চা কেমন হলো, বললে না তো?

লিমন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, সুন্দর হয়েছে।

আজকের চা অতটা সুন্দর হয়নি। আমার বাসার চা তোমার আরও বেশি সুন্দর লাগবে। কেন জানো?

না জানি না।

আমি স্পেশাল কিছু মশলা দেই চাতে। ঐ মশলার চা অসাধারণ। তুমি খাওয়ার পর

আমার ভক্ত হয়ে যাবে।

কথাগুলো বলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে লিমনের দিকে তাকাল পিয়া। লিমন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিতে পিয়া বলল, তুমি চোখ সরিয়ে নিচ্ছ কেন? কেউ যদি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা না বলে আমি অপমানিত অনুভব করি।

লিমন আবার তাকাল পিয়ার চোখে। পিয়ার মাথার চুলগুলো এমনভাবে মুখের দুপাশে এসে পড়েছে যে দারুন লাগছে দেখতে। তার নিজেরও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে পিয়ার দিকে। কিন্তু বিষয়টা শালীনতার সীমাকে অতিক্রম করবে বিধায় সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না।

পিয়া এবার হঠাৎই চোখ বন্ধ করল। তারপর চোখ খুলে টেনে টেনে বলল, আমাকে

তোমার কেমন লাগছে?

লিমন লক্ষ করেছে পিয়া এই প্রশ্নটা সরাসরি করে। অথচ মেয়েদের এরকম প্রশ্ন সাধারণত করার কথা নয়। সে কিছু বলল না, শুধু চোখ সরিয়ে নিল।

খিল খিল করে হেসে উঠল পিয়া। বলল, বলছি বন্ধু হিসেব আমাকে কেমন লাগছে?

ভালো।

মনে হয় না। তুমি কেমন যেন ঘাবড়ে গেছ।

উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে অকপটে স্বীকার করল লিমন।

পিয়া এবার লিমনের আরও কাছে এসে বসল। তারপর বলল, তোমার মধ্যে একরকম জড়তা আছে। এই জড়তা আমি কাটিয়ে দেব। আগামীকাল রাতে তুমি আমার বাসায় আসবে।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, আগামীকাল রাতে!

হ্যাঁ আজকের মতো। ঠিক রাত এগারোটায়। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।

কী বলছেন আপনি!

হু, সত্য বলছি। আজ থেকে তুমি আর আমি বন্ধু।

আপনি আমি বন্ধু হব কীভাবে? দুজনের বয়স..

বোকার মতো কথা বলছ তুমি। সন্ধ্যায়ও এরকম কথা বলেছ তুমি। বন্ধু হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স কোনো বিষয় নয়। বন্ধুত্ব হচ্ছে মনের। তুমি কী আমাকে পছন্দ করো না?

হ্যাঁ করি।

তাহলে এই পছন্দই যথেষ্ট। অন্য কোনোকিছু নিয়ে ভাববে না। এখনকার যে যুগ তাতে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে বন্ধু হতেই পারে। তোমার আমার ক্ষেত্রেও দোষের কিছু নেই। কয়েকদিন পরে দেখবে এই বন্ধুত্বকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আজ আসি।

কথা বলে উঠে দাঁড়াল পিয়া। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে বলল, আমি কী আমার মগটা ধুয়ে দিয়ে যাব?

না না।

মগে কিন্তু লিপস্টিক লেগে গেছে। কিছু মনে করো না আবার।

কথাটা বলেই মুচকি হেসে ছাদের প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল পিয়া। ওখানে দুই ছাদের মধ্যে কাঠের পাটাতন রাখা। একপাশে কয়েকটি ইটও আছে। সেই ইটে পা রেখে পাটাতনে উঠে গেল পিয়া। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবে চলে গেল তার ছাদে। যাওয়ার পর পাটাতনটিকে নামিয়ে রাখল। তারপর ফিরে তাকাল লিমনের দিকে। মুচকি হেসে হাত নেড়ে ঢুকে গেল রুমের মধ্যে।

লিমন স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল পিয়ার চলে যাওয়ার পথের দিকে। তারপর তাকাল পিয়ার মগে। দেখল সত্যি মগের এক পাশে লাল রঙের লিপস্টিক লেগে আছে।

১৬

লিমন টিউশনিতে এসেছে। বাসায় শুধু ছাত্র আর তার খালা ইমা। অন্যদিন পড়ার মাঝে নাস্তা দেয়া হয়। আজ পড়ান শেষ হলে নাস্তা নিয়ে এলো ইমা। নাগেটস্, নুডুলস্ হলো আজকের নাস্তা। ছাত্র এগুলোর কোনোটাই খায় না বলে চলে গেল পাশের ঘরে। নাগেটস্ এগিয়ে দিতে লিমন বলল, আজ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

কেন?

ক্ষুধা নেই।

ইমা অবাক হয়ে বলল, এটা কোনো কথা হলো। আমি আজ আপনার সাথে নাস্তা করব বলে অপেক্ষা করছি। আর আপনি নাস্তা করবেন না। নিন, নিন I

লিমন নাগেটস নিল।

ইমা বলল, আজ কিন্তু বুয়াকে কিছু বানাতে দেইনি। নাগেটস্ এবং নুডুলস্ দুটোই আমি বানিয়েছি। কেমন হয়েছে?

নুডুলস্ এখনো খাই নি। নাগেটস্ চমৎকার ভাজা হয়েছে। আপনি..

আপনি আবার আমাকে ‘আপনি’ করে বলছেন। আমি বলেছি আমাকে আপনি ‘তুমি’ করে বলবেন। গতকাল কিন্তু বলেছেনও।

তা বলেছি, কিন্তু বাধ্য হয়ে বলেছি।

এখন থেকে বাধ্য হয়ে নয়, এমনিতেই বলবেন।

এবার জোরে শ্বাস নিল লিমন। তারপর বলল, পিয়া, তুমি আমার সাথে যে আচরণ করছ তা স্বাভাবিক না। তোমাকে বুঝতে হবে আমি এখানে টিউশনি করি। তোমাকে আমাকে এভাবে কথা বলতে দেখলে তোমার আপু কী ভাববে বুঝতে পারছ?

বাসায় কেউ নেই। বুয়া আছে শুধু। সে এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না।

ঠিকই ঘামায়। তুমি বুঝতে পার না।

ঘামালে ঘামাবে। আমার যা ভালো লাগে আমি তাই করব। তাতে অন্যের কী?

সমাজটা এরকম না।

সামজটা কী রকম?

লিমন অস্থির হয়ে বলল, সমাজ সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। সমাজের কিছু নিয়ম কানুন আছে।

কী নিয়ম কানুন?

একজন শিক্ষক পড়াতে এসে ছাত্রের খালার হাতে তৈরি নাগেটস্ আর নুডুলস্ খেতে পারে না, তাকে ‘তুমি’ করে বলতে পারে না, তার সাথে গল্প করতে পারে না।

আপনি যেরকম কথা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবকিছুতে নিষেধাজ্ঞা আছে। নিন, নুডুলস্ নিন।

আমি আর খাব না।

নুডুলস্ আপনাকে খেতে হবে। এরপর আপনি চা খাবেন, তারপর যাবেন।

লিমন খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলল, তুমি তো দেখি নাছোড়বান্দা!

ইমা এবার সরাসরি তাকাল লিমনের চোখে। তারপর বলল, হ্যাঁ আমি নাছোড়বান্দা, তা শুধু আপনার জন্য।

কী বলতে চাচ্ছ তুমি?

আমি কী বলতে চাচ্ছি আপনি বুঝতে পারছেন না?

না।

আমি যা বলতে চাচ্ছি তা আমি মুখে বলতে পারব না।

যা বলতে পারবে না, তা নিয়ে টানটানি করে লাভ কী?

লাভ আছে।

কীভাবে বুঝলে লাভ আছে?

ইমা এবার মিষ্টি হেসে বলল, লাভ আছে এ কারণে যে, আপনি জানেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। মানুষের একটা বয়স থাকে যখন মানুষ অনেককিছু বুঝতে পারে। আপনি আমি সেই বয়সে আছি।

তু.. তুমি..

আমি কিছুই না। সাধারণ একজন মানুষ।

তুমি সাধারণ মানুষ নও। তুমি অনেক বড়লোকের মেয়ে। আমি সাধারণ। একেবারেই সাধারণ। পথের মানুষ বলতে পারো। আমার কেউ নেই, নেই বাবা মা, অর্থ বিত্ত কোনোকিছু।

তা নেই। কিন্তু…

কিন্তু কী?

ইমা এবার খানিকটা সামনে ঝুকে এলো। তারপর বলল, আপনার তো সুন্দর একটা মন আছে, তাই না?

লিমন চুপ হয়ে গেল, কিছু বলল না।

ইমা টেনে টেনে বলল, আপনি বোধহয় জানেন না, মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সুন্দর একটি মন। এই মহামূল্যবান সম্পদটি আপনার আছে। আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। আমার আর কিছু দরকার নেই। শুধু সুন্দর একটি মন হলেই চলবে।

লিমন মাথা নেড়ে বলল, না ইমা, তুমি ভুল করছ। শুধু মন মানুষকে তৃপ্ত করতে পারে না। মানুষের আরও অনেককিছু দরকার।

তা দরকার। তবে সেগুলো খুব বেশি না। সামান্য হলেই চলে। আপনার সেই সামান্যটুকু আছে। আছে শিক্ষা, ভদ্রতা, সামাজিকতা, সৌজন্যতা সবকিছু। আর কী দরকার?

তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলছ ইমা।

আমি জানি না আমি কী বলছি। তবে কী জানেন? আপনার সাথে আমার পৃথিবীটা বড় সুন্দর! বড় ভালোলাগার।

তুমি এভাবে বলবে না।

কেন?

আমি ভুল করে ফেলতে পারি।

আমাকে নিয়ে চললে আমি আপনাকে ভুল করতে দেব না।

কীভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছ?

ইমা চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। তারপর মিষ্টি হেসে বলল, আমার মনে জোর আছে। আমার কী মনে হয় জানেন?

কী মনে হয়?

আমি আমার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি।

ঠিকানা?

হু। আর তা কোথায় জানেন?

না।

আপনার মধ্যে।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, আমার মধ্যে!

হ্যাঁ।

এরপর চোখ সরিয়ে নিল ইমা। মাথা নিচু করে কী যেন ভাবতে লাগল। চুলের কারণে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। লিমন কী বলবে বুঝতে পারছে না। ভালো লাগা না লাগার এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ছেয়ে ফেলেছে। তার এ মুহূর্তে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে, আবার করছেও না। খুব ইচ্ছে করছে ইমার দিকে তাকাতে, আবার সাহসও পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে দু একটি ভালোলাগার কথা ইমাকে বলতে, কিন্তু বলতে পারছে না। এ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি, যার বর্ননা কিংবা ব্যাখ্যা কোনোকিছুই প্রকৃতিতে নেই।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ইমাই মাথা তুলল। তারপর হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, নিন নুডুলস্ খান।

ইমা যে কাঁদছিল বুঝতে পারেনি লিমন। তার মনটা একেবারে নরম হয়ে গেল। কথা বলার ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে। সে নুডুলস্ নিলে ইমা উঠে গেল। দুই মিনিট পর ফিরে এলো চায়ের কাপ নিয়ে।

চা মুখে দিলে ইমা বলল, রাতে খাওয়া দাওয়া করেন কোথায়?

বাসায় নিজে রাধি, না হলে হোটেলে খাই।

আমি যদি একদিন আপনাকে খাবার দিয়ে দেই, নেবেন।

লিমন উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল, নেব।

ইমা এবার মিষ্টি একটা হাসি দিল। তারপর বলল, আপনি আসলেই খুব ভালো। চা কেমন হলো, বললেন না তো?

খুব সুন্দর হয়েছে।

আমি আগে ভালো চা বানাতে পারতাম না, এখন শিখেিেছ।

তুমি ইদানিং অনেককিছুই শিখছ মনে হয়।

এই শেখাটা আমার ভালো লাগে।

এরপর লিমন আর কিছু বলল না। নীরবে চা শেষ করল। যাওয়ার সময় বলল, আজ

আসি।

যাবেন?

হ্যাঁ।

ইমা এবার সরাসরি তাকাল লিমনের চোখে। তারপর ইতস্তত করে বলল, যদি কিছু মনে

না করেন…

কী?

এই খামটি রাখুন। আপনাকে লেখা আমার একটি চিঠি। বাসায় গিয়ে খুলবেন।

লিমন খামটি নিতে আর দাঁড়াল না ইমা। ভিতরের রুমে চলে গেল।

ধীর পায়ে ছাত্রের বাসা থেকে বের হয়ে এলো লিমন। তবে সে রিকশা নিল না। হেঁটে একটা পার্কে এলো। তারপর বেঞ্চের উপর বসে খুলল চিঠিটা। ইমা গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে,

প্রিয় লিমন,

জীবনটা বড় সুন্দর! মনে হয় আমার পৃথিবীটাই সবচেয়ে সবচেয়ে আনন্দের। এই পৃথিবীতে আমার মতো সুখী আর কেউ নেই। কেন এমন মনে হয়, জানো? কারণ তুমি আছো। তোমার উপস্থিতি আমার জীবনকে আলোকিত করেছে, জুগিয়েছে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা। তোমাকে ছাড়া আমি এখন আর কিছু ভাবতে পারি না, চাইতে পারি না, কল্পনা করতে পারি না। শুধু ভাবতে ভালো লাগে, তুমি আমার পাশে আছো, আমার মাঝে আছো, আমার হৃদয়ে আছো, আর আমি আছি তোমার পাশে। দুই পথে দুজন এসে আমরা একে অন্যের হাত ধরেছি, একে অন্যের মাঝে হারিয়ে গেছি। এখন আমাদের পথ একটাই, তা সোজা, একেবারেই সোজা। সোজা এই পথটিতে আমি তোমাকে পেতে চাই, তোমার মাঝে থাকতে চাই, তোমার মাঝে বাঁচতে চাই। চলার পথে হয়তো বাধা বিঘ্ন আসবে, থাকবে চড়াই উৎড়াই, কিন্তু আমরা জানি সেগুলো মোকাবেলা করার কিংবা পার হওয়ার সাহস আমাদের আছে। কারণ তুমি আমি এখন যে আর আলাদা কেউ নই। আমরা আর দুজন নই, একজন, শুধুই একজন।

তোমার
ইমা।

লিমন চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকল। ইমা তাকে এই চিঠিতে ‘তুমি’ করে সম্বোধন করেছে। ইমা কী চায় বুঝতে আর বাকি নেই লিমনের। কিন্তু কেন যেন ভালোলাগার পাশাপাশি তীব্র এক কষ্টে ভুগতে শুরু করল লিমন। এই কষ্টের কারণ সে জানে না।

১৭

সারাটি দিনই অস্থির হয়ে ছিল লিমন। সন্ধ্যার পর থেকে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। পিয়া আজ রাত এগারোটায় তাকে আমন্ত্রণ করেছে। এই আমন্ত্রণে সে যেতে চাচ্ছে না। এত রাতে কোনো নারীর বাসায় তার যাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে। পারছে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাবে না। যদি না যায় পরে পিয়াকে কী উত্তর দেবে সেটাও একটা প্রশ্ন। পাশাপাশি থাকে, পরিচয় যেহেতু হয়েছে, কথাবার্তা হবেই। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকবারই তাকে বিব্রত হতে হবে। অবশ্য তাতে তার কিছু যায় আসে না, পিয়াকে সে এড়িয়ে যাবে এটাই তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এটা সত্য পিয়া সুন্দরী, দারুন সুন্দরী। যে কেউ দেখলে তাকে পছন্দ করবে, তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপরও সৌন্দর্যের মধ্যে কোথায় যেন খুঁত আছে। এই খুঁতের কারনে পিয়ার উপস্থিতি একরকম অস্বস্তির সৃষ্টি করে। ঐ অস্বস্তির মধ্যে আর পড়তে চায় না সে। একবার ভেবেছিল আজ রাতে বাইরে কোথাও থাকবে। কিন্তু থাকার মতো তেমন কোনো জায়গা নেই তার। সায়হাম নামে তার এক বন্ধু মেসে থাকে। সেখানে যাওয়া যেত, কিন্তু আজ সায়হাম মেসে নেই। একদিনের জন্য বাড়িতে গেছে। এজন্য তাকে তার বাসায়ই থাকতে হচ্ছে।

লিমন রাত সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়ল। ইচ্ছে আগেই ঘুমিয়ে পড়া। জানালা দরজা সব বন্ধ করে দিয়েছে যেন ঘুমের ব্যঘাত না ঘটে। লাইটও বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ঘুম তার এলো না। এগারোটা বাজতে নিজের মধ্যে নতুন এক অস্বস্তির সৃষ্টি হলো। অস্থিরতাও বাড়ছে ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে সে বুঝল তার ঘুম আসবে না। নিজের উপরই রাগ হতে লাগল তার।

হঠাৎই জানালার ওপাশে পিয়ার কণ্ঠ শুনতে পেল। ‘লিমন, লিমন’ বলে ডাকছে পিয়া।

লিমন বুঝল পিয়া নাছোড়বান্দা। তার পিছু ছাড়বে না। তবে তার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকায় সে কোনো উত্তর দিল না।

পিয়া আবার ডেকে উঠল, লিমন লিমন।

লিমন এবার উঠে বসল। সে বুঝল উত্তর তাকে দিতেই হবে। তাই ধীরে ধীরে জানালা খুলল। পিয়ার রুমের লাইট বন্ধ। তবে বোঝা যাচ্ছে সে দাঁড়িয়ে আছে। লিমনকে জানালায় দেখে বলল, কই লিমন, তুমি এলে না? তোমার অপেক্ষায় আছি আমি।

লিমন টেনে টেনে বলল, শরীরটা ভালো নেই।

কী হয়েছে?

হালকা জ্বর আর মাথা ব্যথা।

অবাক হয়ে পিয়া বলল,

কী বলছ?

হ্যাঁ। এজন্য শুয়ে আছি।

তো আগে বলবে না।

আসলে বেশি খারাপ লাগছিল এজন্য বলা হয়নি।

কোনো ওষুধ পাঠাব?

প্যারাসিটামল খেয়েছি। আশা করছি ঘুম ঠিকমতো হলে কেটে যাবে।

জ্বর তো ভালো লক্ষণ না।

সকালে কমে যাবে।

বুঝলে কীভাবে?

আশা করছি। সন্ধ্যা থেকেই খারাপ লাগছিল। দুবার প্যারাসিটামল খেয়েছি। এখন কমতে

শুরু করেছে।

তাহলে আজ তুমি আর আসছ না?

না।

আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তাহলে বিশ্রাম নাও। দেখি তোমার জন্য কী করতে পারি।

আচ্ছা।

এরপর আবার বিছানায় ফিরে এলো লিমন। সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আজ রাতে আর পিয়ার ওখানে যেতে হবে না, এটা তার জন্য অনেক বড় স্বস্তি। এতক্ষণ ঐ চিন্তাই তাকে কাবু করে ফেলেছিল। জানালাটা অবশ্য এখানো খোলা। বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু পিয়ার মুখের উপর বন্ধ করাটা সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না। তাই করে নি। আবার পিয়া এতক্ষণ জানালায় দাঁড়িয়ে আছে কিনা তাও সে জানে না।

মাত্র কয়েক মিনিট পার হয়েছে। এর মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল। সাথে সাথে চমকে উঠল লিমন। বিছানায় উঠে বসে বলল, কে?

আমি, পিয়া।

এত রাতে আপনি!

তোমাকে দেখতে এলাম, দরজা খোলো।

বুকটা ধুক্ ধুক্ করছে লিমনের। তার মনে হচ্ছে সে বুঝি শূন্যে ভাসছে। কী অবিশ্বাস্য! পিয়া চলে এসেছে। কল্পনাতেও ভাবতেও পারেনি।

লিমন লাইট জ্বালাল। তারপর দরজা খুলে দিল। পিয়া সাথে সাথে ভিতরে প্রবেশ করে বলল, হঠাৎ এ অবস্থা হলো কেন তোমার? বলো তো? আমি তো চিন্তায় মরি। তাই চলে এলাম।

লিমন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, না না, ঠিক হয়ে যাবে।

লিমনের অপ্রস্তুত হওয়ার আর একটা কারণ হলো পিয়ার সাজসজ্জা। পিয়াকে আগে সে বেশ কয়েকবার দেখেছে। কিন্তু আজকের মতো দেখেনি। নীল রঙের শাড়ি পড়েছে সে, সাথে স্লিভলেজ খোলা গলার একটা ব্লাউজ। তাতেও কাপড়ের স্বল্পতা লক্ষণীয়। উপরের শাড়িটা নেটের হওয়ায় ঘনত্ব কম, কোনো অন্তর্বাসকেই আবৃত করতে সমর্থ হচ্ছে না। বরং যেন আরো বেশি উদ্ভাসিত করে তুলছে। চুলগুলো আগের মতোই খোলা। ফ্যানের বাসাতে এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে কড়া পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে রুমের মধ্যে। ভিতরের বাতাস এখন আর সাধারণ নেই। শ্বাস প্রশ্বাসে পারফিউমের গন্ধ প্রত্যেকবারই ধাক্কা দিচ্ছে তার মস্তিষ্ককে।

এদিক পিয়া বলল, দেখি জ্বর কতটুকু?

বলেই লিমনের কপালে হাত রাখল পিয়া। তারপর বলে উঠল, কই! কোনো জ্বর নেই। বরং তোমার শরীর বেশ ঠান্ডা মনে হচ্ছে।

লিমন কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। শেষে কোনোমতে বলল, ইয়ে.. মা…নে বোধহয় ওষুধের জন্য কমে গেছে।

মাথা ব্যথার কী অবস্থা?

মাথা ব্যথা আছে। খুব বেশি।

হ্যাঁ বেশিই।

তাহলে চলো চা খাই। চা খেলে কমে যাবে।

এখন চা খাবো?

হ্যাঁ, চায়ের মধ্যে ক্যাফেইন থাকে, এই ক্যাফেইন মাথা ব্যথা কমিয়ে দেয়। তোমার জন্য চা তৈরি করে রেখেছি। এসো আমার সাথে।

কোথায়?

আমার ওখানে।

এত রাতে!

তাতে কী? আমিই তো তোমাকে আমন্ত্রণ করেছি। তুমি আমার আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছে। সুস্থ থাকলে অবশ্যই যেতে। তাই না?

হ্যাঁ।

তাহলে সমস্যা কোথায়? আগে তোমার জ্বর ছিল। এখন নেই। এসো এসো, আমার সাথে।

কথাগুলো বলেই লিমনের হাত ধরল পিয়া, তারপর টান দিল।

লিমন ইতস্তত করতে হালকা ধমকের স্বরে বলল, এসো তো! এত দ্বিধা থাকলে হবে। আমি কী তোমার পর কেউ, তোমার শত্রু?

না না।

তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো না?

করি, অবশ্যই করি।

তুমি কী আমার বন্ধু না?

হ্যাঁ, .. বন্ধু।

আমি কী তোমার ক্ষতি করব মনে হয়?

না মনে হয় না।

তাহলে আমার সাথে আসতে সমস্যা কোথায়?

শুধু শুধু আপানাকে কষ্ট দেব।

কী বলছ তুমি! আমি কষ্ট পাব কেন? বরং তুমি আমার সাথে গেলে আমি খুশি হব। আমি তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি, তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছি। আমার বাসায় তোমার উপস্থিতি আমার জন্য কতটা আনন্দের জানো। এসো। আর আমি নিশ্চিত তোমার মাথ্য ব্যথা আমি কমিয়ে দিতে পারব।

আমি.. আসলে..

আর কোনো কথা নয়। এসো আমার সাথে।

এরপর আর লিমন কিছু বলতে পারল না। ছাদ পার হয়ে কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে সে পিয়াদের ছাদে এলো। তার হৃদস্পন্দন এখন অনেক বেশি। এখনই তার ইচ্ছে করছে ফিরে যেতে, কিন্তু পারছে না। আসলে সে যা করতে চায়, পিয়ার সামনে তা করতে পারে না। পিয়ার মধ্যে তাকে প্রভাবিত করার বিশেষ ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতা সে উপক্ষো করতে পারে না। এজন্য তার মনে হচ্ছে সে ধীরে ধীরে পিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা তার ভালো লাগছে না। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে যদিও সে বের হতে চাচ্ছে, কিন্তু কোনোভাবেই পারছে না। পারছে না বলে তার উপলব্দি সে ভয়ংকর এক শিকলে আবদ্ধ হচ্ছে। এই শিকল ভেঙ্গে সে আর কখনো বের হতে পারবে না।

১৮

পিয়ার রুমটা বেশ বড়। রুমের একপাশে একটি বড় খাট আছে। খাটের পাশে একটি ইজি চেয়ার। তারপর একটা আলমারি। ছোট্ট একটা আলনাও আছে একপাশে। অন্যপাশে গোল একিট টেবিল, দুপাশে দুটো চেয়ার। রুমের মধ্যে যা কিছু আছে সবই আজ নীল। এমন কী রুমের মধ্যে যে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে সেটাও নীল।

রুমে ঢুকে পিয়া বলল, বলো তো আমার রুমটা কেমন?

সুন্দর। মৃদ স্বরে বলল লিমন।

নিজের রুমটাকে আমি নিজের মতো করে রাখি। তোমার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ।

তুমি দেখি রোবটের মতো কথা বলছ। একটার বেশি শব্দ বলছ না, কেন? ..শরীর খারাপ তো.. এজন্য…

পিয়া একটু দূরে ছিল। খানিকটা এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলল, আসলে তোমার শরীর খারাপ ছিল না। তুমি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলে। তাই না?

না না..

আমি কিন্তু সব বুঝতে পারি।

আপনার ধারণা ভুল।

মোটেও ভুল না। তুমি চাচ্ছ আমাকে এড়িয়ে যেতে। কিন্তু পারবে না। কেন পারবে না জানো?

লিমন কিছু বলল না। স্থির চোখে শুধু তাকিয়ে থাকল।

পিয়া আগের মতোই হেসে দিয়ে বলল, পারবে না আমার বন্ধুত্বের কারণে। আমার বন্ধুত্ব দিয়ে তোমাকে আমি এমনভাবে আকড়ে ধরব যে তুমি আর সেখান থেকে বের হতে পারবে না। তখন দেখবে আমার উপস্থিতিই তোমার ভালো লাগছে, ভালো লাগছে আমার সান্নিধ্য। যাইহোক, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো বসো।

লিমন গোল টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসল।

টেবিলের উপর ছোট দুটো বাটিতে পায়েস ছিল। একটা লিমনের দিকে এগিয়ে দিলে অন্যটা পিয়া নিল। তারপর বলল, আমার নিজের হাতে বানানো। উপরে কাজু বাদামের কুচি আছে। ভালো লাগবে। খেয়ে দেখো।

আমার এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

পিয়া আড়চোখে তাকিয়ে বলল, চা নিশ্চয় খাবে। তার আগে পায়েসটা খাও। তা না হলে আমি মনে কষ্ট পাব।

লিমন উপায় না দেখে ভদ্রতার খাতিরে পায়েস মুখে দিল। পায়েসটা হালকা ঠান্ডা। তবে খেতে ভালো লাগছে।

পিয়া বলল, তুমি কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলে না।

কী জিজ্ঞেস করব?

নুপূর ঝুমুরের কথা।

ওরা কোথায়?

খিল খিল করে হেসে উঠল পিয়া। আসলে কী জানো, তুমি এখনো জড়তা কাটাতে পারো নি। এজন্য কথা খুঁজে পাচ্ছ না। যাইহোক, ওরা দোতলায় থাকে। আমি থাকি এই তিনতলায়। পাশে আর একটা রুম আছে। তার পাশে সিঁড়ি। ঐ সিঁড়ি দিয়েই নিচে নামি।

ছাদের এই রুমে একা একা থাকতে আপনার ভয় করে না?

কিসের ভয়? পাশে তুমি আছো না? তুমি আমাকে রক্ষা করবে।

খুব রহস্যময়ভাবে কথাগুলো বলল পিয়া।

আমি আসলে কী করব?

এত ভেবো না। আমার কিছু হবে না। আমার নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতা আমি কীভাবে পেয়েছি জানো?

না জানি না।

পিয়া ঠোট কামড়ে বলল, না এখন বলব না। ধীরে ধীরে তোমাকে সবকিছু বলব। আমার সম্পর্কে নিশ্চয় তোমার জানতে ইচ্ছে করে?

হ্যাঁ করে।

জানবে, সব জানবে। আমার জীবনে আমি কতটা সংগ্রাম করেছি তাও তুমি জানবে। নুপূর আর ঝুমুরের সাথে আপনার পরিচয় কীভাবে? ওরা আপনার কী হয়?

আবারও খিল খিল করে হেসে উঠল পিয়া। তারপর বলল, আমরা একসাথে থাকি। অবশ্যই আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কী সম্পর্ক জানো?

না জানি না।

পিয়া এবার অনেকটা সামনে ঝুকে এলো। তার চুল এখন মাথার দুপাশ দিয়ে সামনের দিকে এসে পড়েছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। টানা টানা চোখ। তবে দৃষ্টিটা কেমন যেন রহস্যময়। সেই রহস্যময় দৃষ্টিতে টেনে টেনে সে বলল, রক্তের সম্পর্ক।

রক্তের সম্পর্ক!

হু। আমাদের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ক। এজন্য আমরা খুব আপন, খুব কাছের। যাইহোক, তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।

উঠে যাওয়ার সময়ে পিয়া এমনভাবে বের হলো যে পিয়ার শাড়ীর আচল লিমনের মুখের উপর এসে পড়ল। আর ঐ সময়ে পারফিউমের গন্ধটা এতটাই তীব্র হলো যে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল লিমনের। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল।

পিয়া রুমের বাইরে বের হতে লিমনের মনে হলো সে ছুটে বের হয়ে যায়। কিন্তু কাজটা করা যে ঠিক হবে না তা উপলব্দি করল সে। তার আসলে এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। রুমটিকে কেমন যেন ভৌতিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্বপ্নের এক নীল জগত যেখানে অশরীরীয় কিছু একটা আছে। কিন্তু কী আছে তা সে জানে না। তবে এই অশরীরীয় কিছু যে তার জন্য শুভ নয়, তা সে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে বলেই এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিল সত্যি সে বের হয়ে যাবে। এরকম একটা ভাবনা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শরীরে কেন যেন শক্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে হাটু দুটো বুঝি কাঁপছে। চাইলেও সে এখন হাঁটতে পারবে না।

এর মধ্যে পিয়া চা নিয়ে এলো। আর তাতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনাটা আর বাস্তবায়ন করতে পারল না লিমন।

পিয়া একটা কাপ এগিয়ে দিল লিমনের দিকে, আর একটা কাপ নিজে নিল। তারপর আগের চেয়ারে বসে বলল, আমি নিশ্চিত তুমি চা পছন্দ করবে এবং এই চা খাওয়ার পর মাথা ব্যথা চলে যাবে।

লিমন একবার চা আর একবার পিয়ার দিকে তাকাতে লাগল। মুখে সে কিছু বলল না। পিয়া অদ্ভুত একটা হাসি দিল। তারপর নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, খাচ্ছ না কেন?

আবারও চায়ের দিকে তাকাল লিমন। তারপর তুলে নিল কাপ। হালকা একটা চুমুক দিল। বুঝতে পারল চায়ের স্বাদ সত্যি অসাধারন।

কেমন হয়েছে?

জিজ্ঞেস করল পিয়া।

ভালো।

বলেই লিমন আর একবার চুমুক দিল কাপে।

পিয়া অবশ্য এবার কিছু বলল না। লিমনের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগল।

লিমন আগের মতো আবার চুমুক দিল কাপে। তারপর মাথাটা ঝাকি দিল ডান বামে। কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। পিয়ার চেহারাটা সে এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। কেমন যেন বাঁকা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। বিকৃত চেহারার পিয়াকে দেখতে ভয়ংকর লাগছে। সে যতই মাথা নেড়ে সুন্দর পিয়াকে দেখতে চেষ্টা করছে ততই যেন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে পিয়া। লিমন হঠাৎই উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। প্রায় পড়ে যাচ্ছিল সে, পিয়া পাশ থেকে তাকে ধরে ফেলল। তারপর টেনে টেনে বলল, তোমার এখন হাঁটার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। এসো, আমার সাথে এসো।

পিয়া লিমনের একটা হাত নিজের কাঁধে নিয়ে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। তারপর তাকে নিয়ে গেল বিছানায়। শুইয়ে দিতে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল লিমন। পিয়া এবার ডেকে উঠল, নুপূর, ঝুমুর। তোমরা ভিতরে এসো।

বাইরেই অপেক্ষা করছিল নুপূর আর ঝুমুর। ভিতরে প্রবেশ করতে পিয়া বলল, প্রাথমিক কাজটা শেষ হয়েছে। এখন আমাদের চূড়ান্ত পর্ব শুরু করতে হবে।

নুপূর বলল, আপু, আপনি কী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন?

উপরে নিচে মাথা ঝাকিয়ে পিয়া বলল, লিমনের বিষয়ে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা করার সুযোগ নেই।

আর একটু সময় নিয়ে লিমনের পরীক্ষা নিলে ভালো হতো না?

আমাদের হাতে সময় কম। আর তাছাড়া তাকে বশে রাখার দায়িত্ব আমার। তোমারা এটা নিয়ে ভাববে না। এখন কাজ শুরু কর। সময় কম।

বড় ঝুকি নিচ্ছেন আপনি। নিজের জীবন অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

এটাই আমাদের নিয়ম।।

পিয়া ইজি চেয়ারে বসে বসে লম্বা শ্বাস নিল। ঝুমুরের হাতে একটা ব্লাড ব্যাগ ছিল। ব্যাগের টিউবের সাথে লাগান সুইটা সে প্রবেশ করিয়ে দিল পিয়ার শরীরে। তাতে রক্তে দ্রুত ভরে যেতে লাগল ব্যাগটি। ব্যাগের অর্ধেক রক্তে ভরে গেলে পিয়া বলল, আর প্রয়োজন নেই। এখন খুলে ফেল।

পিয়ার শরীর থেকে সুই খুলে ফেলার পর ব্ল্যাডব্যাগটি নিয়ে পিয়া কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। তারপর নতুন একটা সুই প্রবেশ করিয়ে দিল লিমনের হাতে। সুইটি টিউবের সাথে সংযুক্ত। টিউবের অপর প্রান্ত ব্ল্যাডব্যাগের সাথে আগেই সংযুক্ত ছিল। ব্ল্যাড ব্যাগ থেকে পিয়ার রক্ত এখন ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে লিমনের শরীরে। রক্তের এরূপ সঞ্চালন দেখে নিজের মধ্যে ভিন্ন ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে পিয়া। তবে সে তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে।

রক্ত সঞ্চালন শেষ হলে কয়েক ফোটা রক্ত রয়ে গেল টিউবের মধ্যে। টিউবটিকে মাঝখান থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলল পিয়া। ডান হাত দিয়ে চাপ দিতে লিমনের মুখ কিছুটা ফাঁক হয়ে গেল। সেই ফাকের মধ্যে টিউব থেকে তিন ফোটা রক্ত লিমনের মুখের মধ্যে ফেলল পিয়া। তারপর আত্মতুষ্টির একটা হাসি দিল।

টিউবটি ঝুমুরের হাতে দিয়ে বলল, আমাদের কাজ শেষ।

আমরা কী তাহলে মোবরকের রক্ত পান করতে পারি।

পিয়া উপরে নিচে মাথা দুলাল।

ঝুমুর আর নুপূর যখন চলে যাচ্ছিল তখন সে টেনে টেনে বলল, আমি এক পেয়ালা মোবারকের রক্ত চাই।

নুপূর বলল, আমি নিয়ে আসছি।

কিছুক্ষণ পর নুপূর এক পেয়ালা রক্ত দিয়ে গিলে পিয়াকে। পিয়া সেই রক্ত ধীরে ধীরে পান করতে লাগল। তার দৃষ্টি অবশ্য লিমনের দিকে। লিমন এখন তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, লিমন তার জীবনের সঙ্গী, লিমন তার চিন্তা চেতনার সবকিছু। এখন থেকে লিমনের যেমন দায়িত্ব হবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা, তেমনি তার দায়িত্ব হবে লিমনকে বাঁচিয়ে রাখা। তা না হলে তারা দুজনই বিপদগ্রস্ত হবে।

রাত সাড়ে তিনটার দিকে লিমন উঠে বসতে পারল। বিছানার উপর শোয়া দেখে সে চমকে উঠল। বলল, আমি এখানে কেন?

পিয়া মৃদু হেসে বলল, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে।

খুবই বিব্রতভঙ্গিতে লিমন বলল, ..আমি আমার রুমে যেতে চাই।

এখনই যাবে।

হ্যাঁ।

শরীর ভালো লাগছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ লাগছে।

চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

পিয়া লিমনকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ফিরে আসার সময় বলল, শরীর খারাপ লাগলে আমাকে বলবে। কারণ আমি জানি কীভাবে তোমাকে সুস্থ সবল রাখতে হবে। অন্য কেউ কিন্তু বিষয়টা জানে না। আসি।

যাওয়ার সময় পিয়ার মুখে অদ্ভুত একটা হাসি দেখতে পেল লিমন। পিয়ার এই হাসিটা তার ভালো লাগল না। তবে ভালো না লাগার এই অনুভূতিটা তার মধ্যে বেশিক্ষণ থাকল না। কারণ পায়েস ও চায়ের মধ্যে থাকা ঘুমের ওষুধের প্রভাব এখনো কাটেনি। তাই অল্পক্ষণেই হারিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

১৯

সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকল লিমন। সে বিশ্বাস করতে পারছে না গত রাতে কী ঘটেছে। স্বপ্নের মতো মনে হলেও সে জানে কিছুই স্বপ্ন না। সব ছিল সত্য। রাতে সে কীভাবে পিয়ার রুমে গিয়েছিল ভেবে নিজেই বিস্মিত হচ্ছে। তারপর সেখানে গিয়ে আবার জ্ঞান হারিয়েছিল। বিষয়টা ঠিক যেন মেনে নিতে পারছে না। এক নারীর রুমে গিয়ে জ্ঞান হারান অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। তার ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। কিন্তু কেন? এই কারণটা সে জানে না।

লিমন অনুভব করল তার ডান হাতের কুনুইতে হালকা চিনচিনে একটু ব্যথা আছে। এই ব্যথার কারণ তার জানা নেই। তবে চামড়ার উপর ছোট্ট একটা লাল ক্ষত দেখা যাচ্ছে। সাধারণত পিপড়ায় কাঁমড়ালে এরকম হয়। এই বাসায় তেলাপোকা, পিপড়া সবই আছে। অনুমান করল রাতে হয়তো কোনো পিপড়া তাকে কামড়িয়েছে।

হাত মুখ ধোয়ার পর লিমন গরম হোটেলে গিয়ে নাস্তা খেল। তারপর ফিরে এলো রুমে। একরকম অস্থিরতা তার মধ্যে কাজ করছে। এই অস্থিরতার মূল কারণ পিয়া। সে অনুভব করছে সুস্থমতো বাঁচতে হলে তাকে পিয়ার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হবে। কারণ পিয়ার আচরণ স্বাভাবিক না। একজন নারী মাঝ রাতে একজন পুরুষের ঘরে আসতে পারে না বা তাকে নিজের ঘরে আমন্ত্রণ জানাতে পারে না। এরকম আচরণ সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। সে নিশ্চিত পিয়া আবার আসবে এবং তাদের আবার দেখা হবে। এই দেখা হওয়া থেকে সে মুক্তি চায়। এজন্য সে যেটা করতে পারে তা হলো বাসা পরিবর্তন। বিষয়টা তার জন্য অত্যন্ত কঠিন। কারণ ব্যাচেলরদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। সেক্ষেত্রে মেসে উঠতে হবে। কিন্তু মেসে এরকম নির্জন কিংবা পড়াশুনার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যায় না। উপরন্তু নানা প্রতিকূলতার মুখোমখি হতে হয়।

শেষ পর্যন্ত লিমন সিদ্ধান্ত নিল সে বাসা পরিবর্তন করবে। এরকম চিন্তা থেকে বাসা খুঁজতে বের হলো। কিন্তু বাসা সে পেল না। কয়েকটা মেসেও গেল সে, অধিকাংশ জায়গায় সিট খালি নেই। দুটো মেসে সিট খালি হলেও পরিবেশ পছন্দ হলো না তার। বাকি মেসগুলোতে নাম লিখিয়ে এলো। দুই তিন মাস পর ডাক পড়তে পারে।

বিকেলে লিমন অনুভব করল তার শরীরটা কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগছে। এরকম আগে তার মনে হয়নি। তাই সে বিছানায় শুয়ে থাকল। আজ তার টিউশনিতে যাওয়ার কথা, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। না যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ পরীক্ষার জন্য গত কয়েকদিন নিয়মিত হতে পারেনি। সামনে আবার পরীক্ষা আছে, তখনো যেতে পারবে না। এজন্য এখন যেতে না পারলে পরে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে তাকে।

ছাত্রের আম্মাকে ফোন করে সে জানিয়ে দিল যে সে আসতে পারবে না। এর পনের মিনিট পরই ইমার ফোন পেল লিমন। আজ বেশ কয়েকবার ইমার কথা মনে পড়েছে লিমনের। ইমা মেয়েটিকে সত্যি ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। তবে সে জানে এই ভালোলাগাটা স্থায়ী করা যাবে না। কারণ ইমার পরিবার আর তার নিজের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এজন্য ইমার কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার জরুরী।

মনটা খারাপ ছিল লিমনের। ইমার ফোন দেখে কিছুটা হলেও ভালো লাগছে। ফোন রিসিভ করতে ওপাশ থেকে ইমাকে খানিকটা উচু কণ্ঠে বলতে শোনা গেল, তোমার নাকি শরীর খারাপ?

উত্তর দেয়ার আগে লিমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ইমা তাকে ‘তুমি’ করে বলছে। আগে কখনো ‘তুমি’ বলেনি। বলল, হ্যাঁ….

কী হয়েছে?

জ্বর আর মাথা ব্যথা।

ওষুধ খেয়েছ?

হু। প্যারাসিটামল।

কী মুশকিল? এখন জ্বর হবে কেন তোমার?

বুঝতে পারছি না।

তুমি আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে।

চিন্তার কিছু নেই। কেবল তো ওষুধ খেলাম। আশা করছি কমে যাবে।

আমার তো মনে হচ্ছে, আমি এখনই চলে আসি।

না না, কী ভয়ংকর কথা?

ভয়ংকরের কী হলো? তুমি অসুস্থ হলে আমি কী আসতে পারি না?

না পারো না।

কেন?

এর কোনো প্রয়োজন নেই।

ইমা জোর দিয়ে বলল, অবশ্যই আছে।

তুমি ফোন করেছ এতেই আমি খুশি। তোমাকে অনেককিছু বুঝতে হবে ইমা। এভাবে হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না। আর তোমার আমার অবস্থানগত পার্থক্যটাও দেখতে হবে। আমাকে প্রলোভিত করো না। আমি যেমন আছি, তেমন থাকতে চাই।

খানিকটা ধমকের স্বরে ইমা এবার বলল, এসব তাত্ত্বিক কথাবার্তা আমাকে বলবে না। আমি যা বলছি সব চিন্তা ভাবনা করে বলছি, যা কিছু করছি সব ভেবে চিন্তে করছি। কাজেই তোমার ঐ সব তাত্ত্বিক কথাবার্তা আমার কাছে মূল্যহীন। যাইহোক, রাতে খাবে কীভাবে?

হোটেল থেকে দিয়ে যাবে।

দুপুরে কোথায় খেয়েছ? হোটেলে।

সকালে?

হোটেলে।

নাম কী হোটেলের?

গরম হোটেল।

এই হচ্ছে তোমার সমস্যা। আজেবাজে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করবে আর অসুস্থ হবে। হোটেলের ভাত তরকারির কথা না হয় বাদই দিলাম, পানিতে যে পরিমান জীবনু থাকে তাতে আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। এখন থেকে আর বাইরের খাবার খাবে না।

আচ্ছা খাব না।

আমি এক ঘণ্টা পর আবার ফোন করব।

না না, আর ফোন করার দরকার নেই।

অবশ্যই আছে। আর হ্যাঁ, তোমার ছাত্রকে নিয়ে কোনো চিন্তা করো না, আমি ওকে পড়িয়ে দিচ্ছি।

আপা কী আমার উপর রাগ করেছেন। আমি আসতি পরি নি এজন্য?

আরে ধূর, ওসব আমার উপর ছেড়ে দাও। সবকিছু আমি ম্যানেজ করব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

রাতে কী খাবে?

জাউ ভাত আর আলু ভর্তা।

পাবে কোথায়?

রুমে রান্না করছি।

এটা ঠিক করছ। বাইরের খাবারের থেকে হাজার গুনে ভালো। একবারে বেশি করে রান্না করতে পার না? দুই বেলা খেয়ে নিলে।

ভবিষ্যতে তাই করব। এখন রাখি।

আচ্ছা ঠিক আছে।

কথা শেষ হলে লিমনের সত্যি ভালো লাগতে শুরু করল। ভালোলাগার কারণেই সে ইমার চিঠিটা বের করল। তারপর বেশ কয়েকবার পড়ল। অতঃপর রেখে দিল টেবিলের উপর।

রেখে দেয়ার কারণ আবার তার মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। জ্বরটাও বাড়ছেই। তার কাছে একটা থার্মোমিটার ছিল। সেটা দিয়ে মেপে দেখে জ্বর একশ দুই ডিগ্রী। বছর দশেক আগে একবার তার এরকম জ্বর হয়েছিল। তখন সে এতিমখানায় থাকত। এতদিন পর আবার জ্বর উঠছে। এজন্য কিছুটা হলেও ভয় ভয় করছে তার।

লিমন রাতে কোনোমতে সাদা জাউ খেল। তাও অল্প পরিমান। আলুভর্তা করার ইচ্ছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত করতে পারেনি। কারণ শরীরে হঠাৎ হঠাৎ কাপুনি হচ্ছে। এজন্য নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। রাত এগারোটার দিকে এমন অবস্থা হলো যে হাঁটাও তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। এ মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে সত্যি যদি কেউ পাশে থাকত তাহলে এতটা কষ্ট হয়তো সে পেত না।

দরজা খোলার শব্দ শুনে লিমন মাথা তুলে তাকাল। দেখল পিয়া ভিতরে ঢুকছে। পিয়াকে সে মোটেও আশা করেনি। আজ অতিরিক্ত অসুস্থতার কারণে দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল সে। এজন্য পিয়া ভিতরে ঢুকতে পেরেছে।

পিয়া কালো রঙের একটি শাড়ি পড়েছে আজ। কানের দুল পর্যন্ত কালো। তবে আজকে তার পোশাকে শালীনতার মাত্রা অনেক বেশি। শৈল্পিকতার ছোঁয়া যেন বেশি। কালো শাড়ির মাঝে ফর্সা পিয়াকে যে কারো ভালো লাগবে। কিন্তু লিমনের ভালো লাগছে না। বরং ভয় করছে। পিয়া দিনে দিনে তার কাছে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এটা আশাপ্রদ নয়।

লিমন শুয়েই ছিল। পিয়া এসে চেয়ারে না ব েবিছানার উপর বসল। তারপর লিমনের কপালে হাত রেখে বলল, কেমন আছ?

লিমন ঢোক গিয়ে বলল, ভালো না।

হ্যাঁ বুঝতে পারছি। জ্বর অনেক বেশি। অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে?

শরীরটা দুর্বল।

কেটে যাবে।

মনে হয় না। তোমাকে ওষুধ খেতে হবে।

খাচ্ছি।

পিয়া অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলল, তোমার ওষুধে কাজ হবে না। আমার ওষুধ লাগবে।

আপনার ওষুধ মানে?

আমি তোমাকে দুটো ট্যাবলেট দিয়ে যাব। দেখবে খাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে সব অসুস্থতা চলে গেছে। তবে নিয়মিত তোমাকে এই ট্যাবলেট খেতে হবে।

লিমন ভ্রূ কুঁচকে বলল, কেন?

কারণ এই ট্যাবলেট ছাড়া তুমি চলতে পারবে না।

কেন পারব না?

রহস্যময় একটা হাসি হাসল পিয়া। তারপর টেনে টেনে বলল, কারণ আমি এখন তোমার মাঝে। আমার যে বৈশিষ্ট্য তা তোমার মধ্যেই বিস্তৃত হয়েছে। এজন্য এতদিন আমি যা করেছি, তোমাকেও তা করতে হবে।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, আ… আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

ধীরে ধীরে তু….তুমি সবই বুঝতে পারবে। তবে মনে রাখবে যা কিছু করবে আমার সম্মতি নিয়ে করবে। তা না হলে…

তা না হলে তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে না। যাইহোক, আমি পানি নিয়ে আসি। পানি কোথায়?

কথা বলে উঠে পড়ল পিয়া। তারপর টেবিলের উপরে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে লাগল। আর তখনই তার চোখ পড়ল টেবিলের উপর রাখা ইমার চিঠিটার উপর। চিঠিটা হাতে নিতে লিমন বলে উঠল, আপনি চিঠি পড়বেন না, প্লিজ পড়বেন না। চিঠিটা আমার ব্যক্তিগত।

পিয়া পাত্তাই দিল না লিমনের কথার। বরং এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল চিঠিটা। তারপর পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আগের জায়গায় এসে বলল, চিঠিটা কার?

ইমা লিখেছে আমাকে।

ইমা কে?

আমার ছাত্রের খালা।

তোমাকে চিঠি লিখবে কেন?

আমি জানি না।

অবশ্যই জানো। সে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি জানি না।

অবশ্যই জানো। এটা ঠিক না। তুমি বোধহয় জানো না তোমাকে আমি পছন্দ করেছি। আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি ছাড়া তুমি আর কোনো মেয়ের সাথে মিশতে পারবে না, কাউকে পছন্দ করতে পারবে না। কেন বলছি জানো?

না।

পিয়া এবার ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর টেনে টেনে বলল, আমি যা বলছি তা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আমি খুব স্পষ্ট করে বলব। আমি তোমাকে পছন্দ করেছি তোমাকে বিয়ে করব বলে। বিষয়টা আর এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ গতকাল তোমার শরীরে আমার রক্ত প্রবেশ করিয়েছি। তার মানে আমি এখন তোমার মাঝে, আমার সবকিছু এখন তুমি। এ ধরনের সুযোগ আমরা জীবনে একবারই পাই। কাজেই তোমাকে আমার করে পাওয়ার জন্য যা কিছু করার সবকিছু করব। আমার রক্তের বৈশিষ্ট্য এখন তোমার রক্তের বৈশিষ্ট্য। আমার যেমন তৃষ্ণা পায় তোমারও সেরকম তৃষ্ণা পাবে। কিসের তৃষ্ণা তা এখন জানতে চেও না। ধীরে ধীরে জানতে পারবে। তবে এটা সত্য, এখন থেকে তুমি আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে গন্য করবে। আর আমি তোমাকে গন্য করব আমার স্বামী হিসেবে। এভাবেই আমরা বসবাস করব। কোনো এক অমাবস্যায় আমরা একে অন্যকে বিয়ে করব। এটাই আমাদের নিয়ম। আমরা সবসয় অমবস্যার রাতে বিয়ে করি।

কথাগুলো শোনার পর লিমন শোয়া থেকে উঠে বসতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। পিয়া লিমনের কপালে চাপ দিয়ে রেখে বলল, এখন উঠতে যেও না। বিশ্রাম নাও। তোমার শরীর এখন তৃষ্ণার্ত। এজন্য তুমি অস্থিরতায় ভুগছ, তোমার জ্বর হয়েছে। এই ট্যাবলেট খেলে কমে যাবে। নাও খেয়ে নাও।

.. টা কীসের ট্যাবলেট!

এত প্রশ্ন করো না। যা বলেছি তাই করো।

বেশ কড়া কণ্ঠে বলল পিয়া।

লিমন বেশ ভয় পেয়ে গেল। সে শুয়ে থেকেই ট্যাবলেটটা গিলে ফেলল। পিয়া পানি এগিয়ে দিলে পানি খেল সে। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারল না। বলেই ফেলল, .. আমি আপনাকে বিয়ে করতে যাব কেন?

এই প্রশ্ন আর কখনো করবে না। আর আমিকে কখনো আপনি করে বলবে না, ‘তুমি’ করে বলবে।

এটা কেমন কথা?

এটাই সত্য কথা। আমরা যাকে পছন্দ করি তারা আমাদের জীবনসঙ্গী হয়।

আপনারা পছন্দ করেন মানে?

আবার ‘আপনি’ বলছ কেন? ‘তুমি’ করে বলো?

লিমন কিছু বলল না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

পিয়া বলে চলল, এখন থেকে আমার কথা মতো চলবে। এ কথা যেন আর দ্বিতীয়বার আমাকে বলতে না হয়। যদি না চলো, তাহলে তোমাকে ভয়ংকর পরিনতি বরণ করতে হবে। আর আমরা কারা তা এখন তোমার না জানলেও চলবে। শুধু মনে রাখবে, আমরা মানুষ, তবে আমাদের মাঝে কিছুটা ভিন্নতা আছে। কী ভিন্নতা তা ধীরে ধীরে জানতে পারবে। এখন ঘুমাও। আমি চলে যাচ্ছি।

পিয়া উঠে পড়তে লিমন বলল, আপনি চিঠিটা নিয়ে যাচ্ছেন কেন?

পিছন ফিরে পিয়া টেনে টেনে বলল, আগুনে পুড়াব, এজন্য।

লিমন কিছু বলল না, একেবারে চুপ হয়ে গেল। তার চুপ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ পিয়ার দৃষ্টি। দৃষ্টিটা স্বাভাবিক ছিল না। মনে হচ্ছিল ঐ দৃষ্টিতে ভয়ংকর এমন কিছু আছে যা মুহূর্তের মধ্যে তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারে।

২০

সকাল নয়টার দিকে সজলের ডাকে ঘুম ভাঙল লিমনের। সজল ভিতরে ঢুকে বলল, কী ব্যাপার, রাতে দরজা বন্ধ করোনি?

লিমন উঠে বলল, হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এজন্য..

তাই বলে দরজা না লাগিয়ে ঘুমাবে? এটা ঠিক না।

আর হবে না। আপনি কখন এসেছেন?

মাঝরাতের পর। আজ অবশ্য চলে যাচ্ছি।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলছেন!

হ্যাঁ। যাই যাই করে যাওয়া হয়নি। আজ যেতে হচ্ছে। কোম্পানীর চূড়ান্ত আদেশ পেয়েছি।

কখন রওনা দেবেন?

এখনই। সব গোছগাছ শেষ। তোমার মুখটা ফোলা ফোলা লাগছে কেন? রাতে ঘুম হয়নি?

এতক্ষণ পিয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল লিমন। সজলের প্রশ্নে মনে পড়ল গত রাতে কী ঘটেছিল। ঘটনাগুলো মনে হতে আবার একরকম অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করল সে। অবশ্য উত্তরে বলল, না না ঘুম হয়েছে।

চলো একসাথে গরম হোটেলে নাস্তা করি। শেষ নাস্তাটা আমি তোমাকে করাতে চাই।

কী যে বলেন। আমার উচিত আপনাকে নাস্তা করানো।

না না, তুমি আজ আমার মেহমান। চটপট তৈরি হয়ে নাও। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

লিমনের প্রস্তুত হতে সময় লাগল না। মনের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও শারীরিক অবস্থা তার ভালো। গত রাতে সত্যি সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল শুধু জ্বরই বুঝি কাবু করে ফেলবে। পিয়ার দেয়া ট্যাবলেট খাওয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে।

গরম হোটেলে নাস্তা খেতে বসে মোবারককে নিয়ে আলোচনা হলো লিমন আর সজলের মধ্যে। এক পর্যায়ে সজল বলল, বড় ভালো মানুষ ছিল মোবারক?

হ্যাঁ।

কোথায় হারিয়ে গেল?

আমি সত্যি বিস্মিত। তবে আমার বিশ্বাস সে ফিরে আসবে।

তাই যেন আসে।

আপনি চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব।

সমস্যা হবে না। আবার নতুন কেউ চলে আসবে।

কিন্তু আপনার মতো তো ভালো হবে না।

মৃদু হেসে সজল বলল, পৃথিবীর সবাই ভালো। নিজেদের মতো করে মানিয়ে নিতে হয় এই আর কি? নতুন যে আসবে আমি নিশ্চিত তুমি তার সাথে আরো আনন্দময় সময় কাটাতে পারবে। এর বড় কারণ হলো তুমি ভালো এবং সহনশীল। যে কেউ তোমার সাথে থাকতে পারবে। যাইহোক, তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?

ভালো।

পড়াশুনাটা ভালোমতো করবে। পড়াশুনার কোনো বিকল্প নেই। তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন কী, জানো?

কী স্বপ্ন?

বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারী চাকরি করবে। যদিও তোমাকে ব্যবসার কথা একদিন বলেছিলাম আজ সরকারী চাকরীর কথা বলছি। কেন জানো?

না।

মানুষের অনেক উপকার করা যায়। তুমি যেহেতু ভালো মানুষ, মনটাও একেবারে স্বচ্ছ, আর সংগ্রাম করে জীবনে বড় হয়েছ, তোমার কাছ থেকে মানুষ অনেক সেবা পাবে।

আমি এভাবে ভাবিনি।

সময় খুব দ্রুত চলে যাবে লিমন। এখন থেকেই প্রস্তুতি নাও।

ঠিক আছে সজল ভাই।

কী কী বই পড়তে হবে তোমার কী জানা আছে?

এখনো বিস্তারিত জানি না।

আমার মনে হয় বিসিএস পরীক্ষার জন্য একটি কোচিং এ ভর্তি হয়ে যাও। যদিও আমি মনে করি কোচিং এর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু যুগটা এরকম হয়ে গেছে। ওখানে তুমি ভালো গাইডলাইন পাবে।

শুধু শুধু টাকা খরচ হবে।

টাকা তো কিছু লাগবেই। প্রয়োজনে তুমি আমার কাছ থেকে নিও

কী বলছে সজল ভাই। আমি আপনার কাছ থেকে টাকা নেব কেন?

আরে, আমি তো ওভাবে বলছি না। মনে করো ধার নিলে। পরে সুবিধামতো শোধ করে দিলে। তোমার আপন বড় ভাই থাকলে তুমি তার কাছ থেকে ধার নিতে না?

হ্যাঁ নিতাম।

আমাকে তুমি তোমার বড় ভাইয়ের মতো মনে করতে পার। সুখে দুঃখে আমাকে সবসময় পাশে পাবে। খালি এই ভাইটাকে মনে রাখবে।

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিমন বলল, আপনি সত্যি অসাধারণ। আপনার চলে যাওয়াটা আমার জন্য দারুন কষ্টের।

পৃথিবীতে সবাইকেই চলে যেতে হয়, কেউ আগে, আবার কেউ পরে। তবে তোমার কাছ থেকে আমার এই চলে যাওয়াটা বড় কিছু নয়। গাজীপুরে থাকব। খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটা। যে কোনো সময় চলে আসবে। তোমার উপস্থিতি আমার জন্য অনেক অনেক আনন্দের হবে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি তোমাকে আমার ছোট ভাইয়ের মতোই জানি। যে কয়েকটা দিন এখানে তোমার কাছে থেকেছি বেশ আনন্দে থেকেছি। তাছাড়া বাড়িটার প্রতিও একরকম টান হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ছিলাম তো!

আপনার যখন মনে হবে চলে আসবেন।

তা তো আসবোই।

ভাবীকে নিয়ে আসবেন।

অবশ্যই আসব। স্মৃতিময় এই বাড়িটাকে দেখানোর জন্য তাকে একদিন না একদিন নিয়ে আসব।

নাস্তা শেষ হলে এরইমধ্যে চা নিয়ে এলো বয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সজল বলল, এখানে আসার আর এক কারণ থাকবে এই চা। একেবারে খাটি দুধ দিয়ে চা বানায়।

আপনি ঠিকই বলেছেন।

তুমি কী জানো গারম হোটেলের এই চা খাওয়ার জন্য অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন আসে।

আগে জানতাম না। কয়েক দিন আগে শুনেছি।

এই চা এর একটা টান আছে। টান টা কঠিন টান। উপেক্ষা করা যায় না। দেখবে তুমি যখন এখান থেকে চলে যাবে এই চা তোমাকে আবার টেনে নিয়ে আসবে।

আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণই একমত।

এখানে প্রতিদিন যত টাকা বিক্রি হয় তার প্রায় তিনি ভাগের এক ভাগ এই চা। আমার একবার কী মনে হয়েছিল জানো, এই হোটেলের চা বানানো শিখব। তারপর সেই চা বাইরে বিক্রি করব। এই পরিকল্পনা থেকে দেখে দেখে চা বানানো শিখেওছিলাম। কিন্তু রুমে যখন বানাতাম তখন আর এরকম স্বাদের হতো না। কয়েকবার চেষ্টা করেছি, প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছি। আসলে কী জানো, সবাই সবকিছু পারে না। সবাইকে সবকিছুর জন্য তৈরি করা হয় নি। আমাকে তৈরি করা হয়েছে অন্যের চাকরি করার জন্য। তাই করছি।

আপনাকে কিছুটা হতাশ মনে হচ্ছে।

অতটা নই। তবে চাকরি ভালো লাগে না, কিন্তু করছি। শুধু করছিই না, গরুর মতো খাটুনি খাটছি। নিজের সময় বলতে কিছু নেই। মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানো?

কী মনে হয়?

আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেও অনেকে হয়তো ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি।

আপনি কিন্তু খুব চমৎকর একটা কথা বলেছেন।

কীভাবে বললাম জানি না। তবে এটা সত্য। বিষয়টা হয়তো এরকম, আমার কেউ পরিপূর্ণ স্বাধীন নয়।

পরিপূর্ণ স্বাধীনতা কী আমাদের সকলের কাম্য?

জানি না।

লিমন বলল, মনে হয় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের সকলের কাম্য নয়। আমরা যখন একেবারে স্বাধীন হয়ে যাব তখন আপন বলতে আমাদের কেউ থাকবে না। আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ব। থাকুক না আপনজনদের অধীন কিছু পরাধীনতা, কিছু ভালোবাসা ভালোলাগার বন্ধন, প্রিয়জনের দাবী পূরণের চাপ কিংবা গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কর্তব্য। এগুলো আছে বলেই আজ জীবনে গতি আছে। আমার কেন যেন মনে হয়, পরিপূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা আনন্দের নয়, বরং নিরানন্দেরই।

সজল হো হো করে হেসে দিয়ে বলল, তুমি তো দেখছি আমার থেকেই সুন্দর কথা বলো। চমৎকার, চমৎকার। এখন চলো, উঠি।

সজলের মালামাল আগেই তার অফিসের এক কর্মচারী মিনি ট্রাকে নিয়ে গেছে। সজল রওনা দিল এক সিএনজিতে। যাওয়ার সময় গরম হোটেলকে পিছনে রেখে দুজনে সেলফি তুলল। তারপর একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরল। কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না।

চলে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাল লিমন। তারপর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকাল পিয়াদের বাড়িটির দিকে। এই বাড়িটির ভয়ে এখন সত্যি সে ভীত।

২১

লিমন রাতে তার বন্ধু সায়হামের কাছে ছিল। সায়হাম মেসে থাকে। সকালে এসেছে ভার্সিটিতে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কয়েকদিন আর বাসায় ফিরবে না। বাসার কথা মনে হইে তার বার বার পিয়ার কথা মনে করে। পিয়ার প্রতি তার একরকম ভয় ঢুকে গেছে। এজন্য তাকে এড়িয়ে চলার চিন্তা করছে সে। একই সাথে ইমাকেও এড়িয়ে চলছে সে। ঐ দিন রাতে তার অসুস্থতার কথা জানার পর ইমা অনেকবার ফোন করেছে। কিন্তু একবারও সে ফোন ধরেনি। বার বার মেসেজও দিচ্ছে ইমা। মেসেজগুলোর প্রত্যেকটিই আবেগে পরিপূর্ণ। উত্তর দেয়ার খুব ইচ্ছে করলেও উত্তর দিচ্ছে না লিমন।

এগারোটার দিকে যখন ইমা ক্রমাগত ফোন করতে লাগল তখন আর না ধরে পারল না। লিমন কিছু বলার আগেই ইমা বলল, কী খবর তোমার, তুমি ফোন ধরছ না কেন?

শরীর ভালো ছিল না।

তা জানি। তাই বলে ফোন ধরবে না। শুধু শুধু আমাকে কষ্ট দেবে। তুমি কোথায়?

আমি ভার্সিটিতে।

আমিও তোমার ভার্সিটিতে।

কী বলছ! এখানে কেন?

তোমাকে খুঁজতে এসেছি। আমি বাইরের গেটের পাশে যে চায়ের দোকানটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি বাইরে এসো।

লিমন সত্যি বিস্মিত হলো। সে তাড়াতাড়ি বাইরে এলো। ইমা এই পর্যন্ত চলে এসেছে ভাবতেই পারছে না। বাইরে এসে দেখে সত্যি ইমা দাঁড়িয়ে আছে। লাল রঙের একটি থ্রি পিস পরেছে সে। এজন ফর্সা ইমাকে আরও ফর্সা দেখাচ্ছে।

লিমন কিছু বলার আগেই ইমা বলল, তুমি সুস্থ হয়ে গেছ, আমাকে জানাও নি কেন?

ভুল হয়ে গেছে। তবে এখনও সুস্থ..

না ভুল হয়নি। তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে জানাওনি I

লিমন বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, এভাবে বলো না।

অবশ্যই বলব। তুমি আসলে আমাকে মূল্যায়ন করো না। এজন্য এসেছি চূড়ান্তভাবে কথা বলার জন্য। আমি সত্য জানতে চাই।

কী সত্য?

এখানে বলব না।

তাহলে কোথায় বলবে?

ইমা ঠোঁট কামড়ে বলল, নৌকায় বসে বলব।

লিমন বিস্মিত কণ্ঠে বলল, নৌকায়!

হ্যাঁ নৌকায়। এখন তুমি আমাকে বুড়ীগঙ্গার তীরে নিয়ে যাবে। একটা নৌকা নেবে। নৌকায় আমি তোমার সাথে সাথে ঘুরব আর কথা বলব। কী ঠিক আছে?

সারাদিন! কী বলছ! সামনে আমার পরীক্ষা।

তাহলে অন্তত দুই ঘণ্টা। চলো।

বলেই ইমা নিজে একটা রিকশা ডাকল। তারপর উঠে বসে লিমনকে বলল, এসো। লিমন ইতস্তত করতে ইমা আবার বলল, দেরি করলছ কেন?

লিমন রিকশায় উঠল। লিমনের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অস্বস্তির পাশাপাশি দারুন ভালোলাগার একটা অনুভূতি কাজ করছে তার মধ্যে। জীবনে কোনো মেয়ের সাথে সে এভাবে রিকশায় বসেনি। আজ প্রথম। মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসে লাগছে তার। প্রত্যেক মেয়েরাই বোধহয় একরকম মিষ্টি পারফিউম ব্যবহার করে, অনুমান করল সে।

কিছু বলছ না যে?

ইমার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলো লিমন। বলল, কী বলব খুঁজে পাচ্ছি না।

কেন খুঁজে পাচ্ছ না?

তোমার সামনে আমি কোনো কথা খুঁজে পাই না।

ইমা খানিকটা সামনে ঝুঁকে লিমনের দিকে তাকাল। দৃষ্টিটা অদ্ভুত সুন্দর। টেনে টেনে বলল, কেন?

আমার ভয় হয়।

কিসের ভয়?

জানি না।

ইমা এবার বিস্তৃত হাসি দিল। তারপর বলল, তোমার ভয় কাটাতেই এসেছি। এখনো তুমি আমাকে ভয় পাও। যেন ভয় না পাও, যেন ভাবতে পার আমি তোমারই একজন, এজন্য এসেছি। আজকের দিনের পর আর তোমার ভয় থাকবে না।

ভয় কাটাবে কীভাবে?

আস্থা, বিশ্বাস এবং…

এবং কী?

না বলব না। নৌকায় বসে বলব।

ঘাটে আসার পর তারা দুই ঘন্টার জন্য ছাউনিওয়ালা একটি নৌকা ভাড়া করল। নৌকাটা ছোট হলেও সুন্দর। বয়স্ক মাঝি ধীরে ধীরে নৌকা বাইতে শুরু করলে লিমন আর ইমা নৌকার মাথার দিকে ছাউনির নিচে বসল। এখানে বাতাস বেশি লাগবে, রোদ কম লাগবে। আবার একই সাথে চারপাশের দৃশ্যও দেখা যাবে।

ইমা বলল, আমি একটা ব্যাপারে কিন্তু খুব বিস্মিত।

লিমন বাইরে তাকিয়েছিল। বলল, কী ব্যাপার?

তুমি আমার দিকে খুব একটা তাকাচ্ছ না।

লিমন এবার ইমার চোখে তাকাল। বলল, এই তো তাকালাম।

খুব কম। সত্যি করে বলো তো আমাকে দেখতে কী খারাপ লাগছে?

না সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর যে তাকাতে ভয় পাচ্ছি।

ইমা অস্থির হয়ে বলল, তুমি এতটা ভীত কেন? আসলে ভীতু নই। তোমাকে দেখলে ভীত হয়ে পড়ি।

কেন?

জানি না।

ইমা মিষ্টি করে হাসল। তারপর বলল, তার মানে আমি তোমার কাছে অন্যদের মতো কেউ নই। হয়তো আলাদা কেউ, ভিন্নরকম কেউ। তাই না?

জানি না।

তুমি দেখি কিছুই জানো না। তবে তুমি যে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছ এটা কী বুঝতে পারছ? কী রকম?

এই যে তুমি আমাকে আগে ‘তুমি’ করে বলতে চাইতে না, এখন বলছি। আমিও তোমাকে ‘তুমি’ করে বলছি। দুজনেই কিন্তু অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছি, তাই না?

হ্যাঁ।

তুমি দেখি হ্যাঁ, হু, জানি না, এইভাবে কথা বলছ। এত কম কথা বললে ভালো লাগে।

কী.. কী বলব?

তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি যা বলব তাই শুনবে। আমি তোমার জন্য একটা গিফট্ এনেছি। এই গিফটটা তুমি নেবে।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, আমার জন্য গিফট্!

হ্যাঁ। আমি কী তোমাকে গিফট্ দিতে পারি না?

সত্যি কথা বলতে কী ..

কী?

কেউ কোনোদিন আমাকে কোনো গিফট দেয়নি। এজন্য…

এজন্য বিস্মিত হচ্ছ, তাই তো। এদিক দিয়ে আমি খুব সৌভাগ্যবান যে আমি তোমাকে প্রথম গিফট দিচ্ছি। আমি চাইও না, তুমি অন্য কোনো নারীর গিফট্ গ্রহণ করো। শুধু চাই আমার গিফট্ তুমি গ্রহণ করবে এবং সারাটা জীবন।

শেষের কথাগুলো বেশ টেনে টেনে বলল ইমা। তারপর ব্যাগের মধ্যে থেকে একটি চারকোনা বক্স বের করল। এগিয়ে দিল লিমনের দিকে। লিমন বলল, কী আছে এই বক্সে?

খুলে দেখো।

বক্স খুলে দেখল চমৎকার একটি ঘড়ি। চামড়ার বেল্ট আর সিলভার ডায়ালের। লিমন অবাক হয়ে বলল, এত সুন্দর ঘড়ি!

তুমি পরবে।

লিমন ঘড়িটা পড়লে ইমা বলল, তোমাকে কেন ঘড়িটা দিলাম, জানো?

কেন?

তাহলে তুমি আর আমাকে ভুলে যাবে না। গত দুদিন আমাকে তুমি ভুলে গিয়েছিলে, আমার ফোন ধরোনি, একবারের জন্য ফোনও করোনি। বড় কষ্ট পেয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী জীবনে আমি কোনোদিন এত কষ্ট পাইনি।

কথাগুলো বলতে বলতে ইমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো।

লিমন একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বলল, তু…তুমি এভাবে বলছ!

ওড়নার আঁচলে চোখ মুছে ইমা বলল, হ্যাঁ। এভাবেই বলছি। আমার সাথে আর কখনো এরকম নিষ্ঠুর আচরণ করবে না। ফোন কারার সাথে সাথে রিসিভ করবে। মেসেজ দিলে উত্তর দেবে।

হ্যাঁ, দেব।

তুমি কেন বুঝতে চাও না তোমার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না।

লিমন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ইমা, সত্যি কথা বলতে কী তোমার সাথেও আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে, দেখা করতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে। কিন্তু আমি বিবেকের দায় থেকে মুক্ত হতে পারি না। এ কথা আমি আগেও বলছি, তোমার আর আমার সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য আকাশ পাতাল।

তাতে কী? আমিই তো তোমার কাছে এসেছি।

তা এসেছ। কিন্তু সামাজ মানবে না।

মানবে। অবশ্যই মানবে।

তুমি জীবনকে যত সহজ ভাবছ, জীবন আসলে অতটা সহজ না।

অবশ্যই সহজ। জীবনকে সহজ ভাবলেই সহজ। আর কঠিন ভাবলে কঠিন। যাইহোক, তোমাকে আর এত তাত্ত্বিক কথা শোনাতে হবে না। আমি বাসা থেকে নাস্তা নিয়ে এসেছি। তেমন কিছু না। স্যান্ডউইচ। নিজের হাতে বানিয়েছি। খেও দ্যাখো, কেমন লাগে?

ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা মোড়ান কাগজে দুটো স্যান্ডউইচ বের করল ইমা। একটা এগিয়ে দিল লিমনের দিকে। অন্যটা সে নিল।

ইমা স্যান্ডউইচে কামড় দিচ্ছে আর চোখ দিয়ে তার টপ্‌প্ করে পানি পড়ছে। এখনো তার কান্না থামেনি। ইমাকে এখন লিমনের কাছে দূর আকাশ থেকে আগত এক অপূর্ব সুন্দরী পরীর মতো মনে হচ্ছে। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল ইমা নামের এই পরীকে সে আর কষ্ট দেবে না। আরও সিদ্ধান্ত নিল ইমাকে সে একটি গিফট্ দেবে। খুব সুন্দর গিফট্। এত সুন্দর যে কেউ কখনো তার প্রেমিকাকে দেয়নি।

২২

ইমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে লিমন ভেবেছিল আবার লাইব্রেরিতে আসবে। গত কয়েকদিনে পড়াশুনা ঠিকমতো হয়নি। তাই বদ্ধপরিকর ছিল দীর্ঘসময় সে পড়বে। কিন্তু শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগায় মত পালটাল সে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। শরীরে কেমন যেন জ্বালাপোড়া করছে, তাপমাত্রাও বাড়ছে। একইসাথে শুরু হয়েছে মাথাব্যথা। এরকম অবস্থা তার দুদিন আগে হয়েছিল। পরে পিয়ার দেয়া ওষুধ খাওয়ার পর কমেছিল।

ডাক্তার ওষুধ দিলে সাথে সাথে খেয়ে নিল লিমন। তারপর এলো মার্কেটে। উজ্জ্বল কমলা রঙের একটি শাড়ি কিনল ইমার জন্য। শাড়িটি তার নিজের খুব পছন্দ হয়েছে। ঠিক করেছে আগামীকাল যেভাবেই হোক ইমাকে সে শাড়িটি দেবে। এরপর আবার পা বাড়াল লাইব্রেরির উদ্দেশে।

লাইব্রেরিতে স্থির হয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ল লিমনের জন্য। ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খাওয়ার পর ঘণ্টা দেড়েক ভালো ছিল সে। এখন আবার জ্বর বাড়তে শুরু করেছে। আবার ওষুধু খেল সে। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। বুঝতে পারল জ্বর কমার বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণই মানসিক। একটা সময় আর থাকতে পারল না সে। মেসে ফিরে এলো। তারপর শুয়ে পড়ল বিছানায়।

সন্ধ্যার দিকে হালকা বমি হলো লিমনের। সাথে শরীরে কাঁপুনিও আসতে লাগল। সে অনুধাবন করল এটা সাধারণ কোনো অসুখ নয়। এই অসুখ সম্ভবত পিয়ার সৃষ্ট। কারণ পিয়াই এই অসুখ বা অসুস্থতা থেকে তাকে সারিয়ে তুলেছিল। এক্ষেত্রে বাঁচতে হলে তাকে আবার পিয়ার কাছে যেতে হবে।

এ মুহূর্তে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে জরুরী এরকম একটা ভাবনা থেকে সে মেস্ ছেড়ে তার বাসায় চলে এলে। বাসা বলতে ছাদের উপর সেই ছোট্ট রুম। পাশে সজলের রুমটা তালা দেয়া। সে চলে গেছে, আর আসবে না। এখন থেকে এই ছাদে সে একা থাকবে। ভাবতেই কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতিম তার মধ্যে কাজ করতে লাগল।

রুমের মধ্যে সবকিছু কেমন যেন গুমোট গুমোট মনে হচ্ছে। গুমোট অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে লিমন পূর্ব আর দক্ষিন দুই দিকের জানালাই খুলে দিল। দরজাও খোলা রাখল। এতে বাইরের বাতাস দ্রুত ভিতরে প্রবেশ করলে গুমোট ভাবটা কেটে যেতে লাগল। কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরের জ্বালাপোড়া আগের মতোই থাকল। লিমন অনুধাবন করল তাকে বেঁচে থাকতে হলে এখন পিয়ার সাহায্য নিতে হবে। কারণ তার এই অস্বস্তি বা অসুস্থতার জন্য পিয়াই দায়ি। কিন্তু পিয়ার ওখানে যেতে তার ইচ্ছে করছে না। তাই চোখ বুজে পড়ে থাকল বিছানায়।

লিমন কতক্ষণ এভাবে পড়েছিল বলতে পারবে না। কপালে হাতের স্পর্শ পেয়ে দেখল পিয়া পাশে এসে বসেছে। লিমন কিছু বলার আগে পিয়াই বলল, কোথায় ছিলে তুমি?

বন্ধুর ওখানে।

কেন?

লিমন টেনে টেনে বলল, অসুস্থ ছিলাম।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু এই অসুস্থতা তো তোমার বন্ধু সারাতে পারবে না। একমাত্র আমিই তোমাকে সুস্থ রাখতে পারব। আর কেউ নয়। তোমার উচিত ছিল আমার কাছে আসা। আর এভাবে হুটহাট করে বাইরে থাকবে না। আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।

আপনি চিন্তা করবে কেন?

তুমি আমাকে আপনি করে বলবে না। ‘তুমি’ করে বলবে। কেন বলবে, কারণও তোমাকে বলেছি। এ বিষয়ে আমাকে যেন আর বলতে না হয়।

ঠিক আছে।

এখন কী খুব বেশি খারাপ লাগছে?

হ্যাঁ, মনে হচ্ছে শরীরের মধ্যে আগুন ধরে গেছে। ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে।

এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাও?

হ্যাঁ চাই।

তাহলে এসো আমার ওখানে।

কোথায়?

আমার রুমে। ওখানে তোমাকে শান্তি দেব।

কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল পিয়া। তারপর হঠাৎ টেবিলের উপর চোখ পড়তে বলল, শাড়ীর বাক্স দেখছি, তুমি কী শাড়ি কিনেছে?

ভয়ে একেবারে জমে গেল লিমন।

লিমনের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই পিয়া বাক্সটি খুলল। তারপর কমলা রঙের শাড়িটি হাতে নিয়ে বলল, কার জন্য কিনেছ?

কোনো উত্তর দিল না লিমন।

নিশ্চয় ইমার জন্য?

লিমন চুপ থাকল।

তার মানে তুমি ইমার কাছে গিয়েছিলে।

আমি যাই নি, ইমা এসেছিল।

পিয়া প্রচন্ড রেগে গেল। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোমাকে ঐ ইমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। এ কথা তোমাকে আগে বলেছি। তা না হলে ভয়ানক পরিণতি বরণ করতে হবে। যাইহোক, তোমার পছন্দটা আমি জানলাম। এই শাড়ি আমি পড়ব। তুমি যা কিছু কিনবে সব আমার জন্য। অন্য কোনো মেয়ের জন্য নয়। বুঝতে পেরেছ?

লিমন কোনো কথা বলল না।

পিয়া লিমনকে টেনে তুলল। তারপর তাকে নিয়ে যেতে থাকল নিজের রুমের দিকে। কাঠের পাটাতন পার হওয়ার সময় বেশি সতর্ক থাকতে হলো লিমনকে। তবে পিয়া ধরে রাখায় তেমন সমস্যা হলো না। একসময় এসে পৌছাল পিয়ার রুমে।

খাটের উপর বাসে লিমন বলল, পানি খাব।

পানি এগিয়ে দিতে পুরো এক গ্লাস পনি খেল লিমন। কিন্তু তাতে তার তৃষ্ণা মিটল না। বরং বাড়ল। শেষে থাকতে না পেরে নিজে থেকেই বলল, আমার গলা শুকিয়ে আসছে।

মৃদু হাসল পিয়া। তারপর বলল, পানি তোমার তৃষ্ণা মেটাতে পারবে না।

তাহলে কী মেটাব?

আমি ব্যবস্থা করছি।

তাড়াতাড়ি করুন।

আবার ‘আপনি’ বলছ। তুমি বলো।

তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি।

একটু ধৈর্য ধরতে হবে এবং আমার কথা মতো চলতে হবে।

তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব, তাই করব। কিন্তু আমি আর তৃষ্ণার্ত থাকতে চই না। গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে।

পিয়া তার হাসিটা বিস্তৃত করে বলল, তোমাকে আমি যে এভবাবেই চাই। শুধু শুধু তুমি ইমার পিছনে ঘুরে জীবনটাকে নষ্ট করছ, আমাকে কষ্ট দিচ্ছ। আর কখনো ঘুরবে ইমার পিছনে?

না কখনোই না।

তাহলে তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে। আমিও তোমাকে নিয়ে সুখী হতে পারব। আমাদের সুখের দিন আর বেশি দূরে নয়। আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে করব। সম্ভবত পরের অমবস্যায়। অমবস্যার রাতের অন্ধকারে শুধু থাকব তুমি আর আমি। তারপর হারিয়ে যাব নতুন জীবনের নতুন আনন্দে।

কথাগুলো বলতে বলতে পিয়া কালো রঙের একটা ওড়না নিয়ে এলো। তারপর সেটা লিমনের চোখের উপর রাখতে লিমন আঁতকে উঠে বলল, কী করছ?

তোমার চোখ বাঁধছি।

কেন?

তুমি এ প্রশ্ন করো না। আমার উপর কী তোমার আস্থা নেই?

হ্যাঁ আছে।

তাহলে আমি যা করতে বলি তাই করবে। দেখবে তোমার তৃষ্ণা মিটে গেছে।

পিয়া এমনভাবে লিমনের চোখ বাঁধল যে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না লিমন। কিছুটা ভয়ও করছে তার। কিন্তু সে নিরুপায়। পিয়ার নির্দেশের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

হাত ধরে লিমনকে দাঁড় করাল পিয়া। তারপর বলল, চলো, ধীরে ধীরে সামনে হাঁটতে থাকো।

লিমন অনুভব করল রুম থেকে বের হওয়ার পর তারা প্রথমে বামে মোড় নিল। তারপর সিড়ি দিয়ে দোতলায় নামল। আবার বাম দিকে মোড় নিয়ে খানিকটা পথ এগোলো। এমন সময় তার একেবারে কানের কাছে মুখ এনে পিয়া বিড় বিড় করে বলল, এখন থেকে কোনো কথা বলবে না। তাহলে সাধনার ক্ষতি হবে। আমি যা বলব তাই শুধু করবে। তোমাকে লোনা একরকম পানীয় পান করতে দেয়া হবে। যতক্ষণ না তৃষ্ণা মেটে ততক্ষণ পান করবে।

কথার মাঝেই ডানে মোড় নিয়ে কোথায় ঢুকল তারা। লিমন অনুভব করল তার পাশে তৃতীয় কেউ আছে। কে, অনুমান করতে পারল না। তাকে মেঝেতে বসতে বলা হলে সে বসল। এর কয়েক সেকেন্ড পরই তার মুখের মধ্যে একটা টিউব প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো। তারপর বলতে শুনল পিয়াকে, ‘পান করো, তৃপ্ত হও, শান্তি পাও’।

প্রথম টানে যে স্বাদ পেল লিমনের সেটা ভালো লাগল না। মনে হলো লবন পানি। তবে শরীরে প্রশান্তির সৃষ্টি হওয়ায় দ্বিতীয় টান দিল সে। আগের থেকে স্বাদটা এবার সহনীয় হয়ে উঠল। তৃতীয় এবং চতুর্থ টানে সে যেন আসক্ত হয়ে পড়লল এবং এরপর সে টানতেই থাকল যতক্ষণ না শরীর একেবারে স্বাভাবিক হয়ে এলো। একসময় নিজেই মুখ থেকে খুলে ফেলল টিউবটি।

লিমন এখন সুস্থ, একেবারেই সুস্থ। কী সে পান করল জানে না। তবে যা পান করেছে তা যে ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। কারণ তার শরীরে এখন কোনো অস্বস্তি নেই, নেই কোনো দুর্বলতা, শুধু আছে ভালোলাগার আমেজ। পিয়া যখন তাকে উপরে নিয়ে আসছে তখন ভালোলগাাটা আরও বেড়েছে। কারণ পিয়া তাকে সুস্থ করে তুলেছে। তার থেকে বড় কথা পিয়ার শরীর থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে এই গন্ধটা তার এখন প্রিয় হয়ে উঠছে, দারুন প্রিয়।

রুমে এসে পিয়া লিমনের চোখ খুলে দিল। তারপর বলল, এখন কেমন লাগছে?

লিমনের চোখে আলো সয়ে আসতে একটু সময় লাগল। বলল, ভালো। তবে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

হ্যাঁ পারো।

আমি কী পান করেছি?

পিয়া মিষ্টি হেসে বলল, যা তুমি পান করতে চেয়েছ তাই করেছ। এই পানীয় সবার মাঝেই আছে। তোমার মাঝেও, আমার মাঝেও। ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে, বুঝতে পারবে। যাইহোক, তোমার শাড়িটা কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তুমি শাড়ী কিনতে পারো নি।

কেন?

শাড়ীর সাথে আনুষঙ্গিক আরো কিছু কিনতে হয়। তুমি তা কিনোনি। যেমন ধরো ব্লাউজ।

কথাটা বলে পিয়া একদৃষ্টিতে লিমনের দিকে তাকাল। লিমন চোখ সরিয়ে নিল। পিয়ার কথাটা তার জন্য খুব বিব্রতকর। অথচ পিয়া কী অবলীলায়ই না কথাগুলো বলছে।

পিয়া এবার বলল, ঠিক আছে, তুমি যেভাবে দিয়েছ শাড়িটা আমি সেভাবেই পড়ব এবং তা শুধু তোমারই সামনে। চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি

দুই ছাদের কাঠের পাটাতন পার হলে লিমন একবার মাত্র পিছন ফিরে তাকাল। তারপর দ্রুত পা বাড়াল তার রুমের উদ্দেশ্যে। পিয়া এবার এই ছাদে আসেনি। সেও চাচ্ছিল না আসুক। কারণ পিয়ার সান্নিধ্য কেন যেন এখন আর সে কামনা করছে না।

২৩

সকালে ঘুম থেকে উঠে লিমনের মনে পড়ল আগের রাতের কথা। প্রথমে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হলেও বুঝতে পারল সব ছিল সত্য। এর অন্যতম প্রমাণ টেবিলের উপর শাড়ীটা নেই। কিন্তু এই সত্যটাকে সে মেনে নিতে পারছে না। বিশেষ করে পিয়ার রহস্যময় আচরণ আর ক্ষমতাকে। গতকাল বলতে গেলে পিয়াই তাকে সুস্থ করে তুলেছে, বাঁচিয়েছে। কিন্তু কীভাবে বিষয়টা সম্ভব হলো সে বুঝতে পারছে না। তাকে চোখ বেঁধে কী পানীয় খাওয়ান হয়েছে তাও সে বের করতে পারছে না। ডাক্তারের ওষুধ খাওয়ার পর জ্বর কমছে না, অস্বস্তি যাচ্ছে না, অথচ পিয়া মুহূর্তের মধ্যে সব দূর করে দিচ্ছে। কী এমন ক্ষমতার অধিকারী পিয়া? নিশ্চয় কোনো না কোনো ক্ষমতা আছে। তা না হলে পিয়া তাকে এভাবে প্রভাবিত করতে পারত না। জীবনটা তার এমন হয়ে গিয়েছে যে পিয়ার কথার বাইরে যে যেতে পারছে না। পিয়া যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে সে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পিয়া কয়েকদিন ধরে বলছে, তাকে বিয়ে করবে। কী অবিশ্বাস্য? কীভাবে মেনে নেবে সে? পিয়া তার থেকে বয়সে বড়। অসম বয়সের একজন নারী পুরুষের বিয়ে কীভাবে সম্ভব? তারপর নাকি বিয়ে হবে অমাবস্যার রাতে? এ তো কল্পনারও বাইরে। এর থেকে বড় প্রশ্ন পিয়ার পরিচয়। এখন পর্যন্ত পিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত সে জানে না। নুপূর, ঝুমুর সম্পর্কেও জানে না। সম্পর্কের এই বিষয়গুলো ধোঁয়াটে হয়ে আছে। কোনো পুরুষকে সে ঐ বাড়িতে আসতে দেখে না। আশেপাশের অন্য কারো সাথে সম্পর্কও জোরাল নয়। নাচের স্কুল চালাতে গিয়ে সবার সাথে যে সম্পর্ক রাখা উচিত তাই পিয়া রাখছে। পিয়ার এরূপ আচরণ খুব রহস্যময়। রহস্যময় এক নারী তাকে বিয়ে করবে এটা চিন্তা করলেই মাথা গুলিয়ে উঠছে লিমনের। সেক্ষেত্রে ইমার কী হবে? ইমার সাথে সে প্রতারণা করতে পারবে না। কারণ ইমা তাকে নিঃস্বার্থভাবে পছন্দ করে। পছন্দ করে বলা এখন আর ঠিক হবে না, ভালোবাসে বলতে হবে। কারণ ইমা নিজেকে তার সামনে প্ৰকাশ করেছে, তার প্রতি তার ভালোলাগার কথা খোলামেলাভাবে ব্যক্ত করেছে।

লিমন যখন এরকম ভাবছে তখন তার ফোনে রিং বেজে উঠল। দেখল ইমা ফোন করছে। সে ফোন ধরতে ইমা বলল, কেমন আছ?

ভালো। তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো নেই।

কেন?

ভেবেছিলাম তুমি অন্তত একবার ফোন করবে। খোঁজ খবর নেবে। গতকালকের পর একবারও ফোন করলে না। কিছুটা হতাশ হয়েছি বলতে পার।

না না, হতাশ হবে না।

না না, বললে তো হবে না। যা সত্য তাই বলেছি। আমি কিছুতেই তোমাকে বোঝাতে পারছি না যে আমি তোমার ফোন আশা করি।

আমি বুঝি।

তাহলে ফোন করো না কেন?

অবশ্যই করব।

কবে করবে?

আসলে..

আসলে কিছুই না। তুমি না খুব কঠিন মানুষ। আমি তোমাকে একটা চিঠি লিখলাম, তুমি উত্তরও দিলে না।

লিমন বিব্রতভঙ্গিতে বলল, ..সত্যি কথা বলতে কী, সুযোগ পাই নি I

সুযোগ তো নিজে নিজে আসে না। তৈরি করে নিতে হয়, এর জন্য চেষ্টা করতে হয়। তুমি কী চেষ্টা করেছ?

তা করিনি।

কেন?

লিমন এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, কয়েকদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ জ্বর আসে, সাথে মাথা ব্যথা আর তীব্র অস্বস্তি। এজন্য কোনোকিছুতে মন বসাতে পারছি না।

এর কারণ আছে।

কী কারণ?

তুমি সময়মতো কিছুই করো না। সকালে নাস্তা করেছ?

না করিনি।

তাহলে চিন্তা করে দেখো। এখন সাড়ে নয়টা বাজে। অথচ তুমি খাওনি। তার মানে কী? তুমি নিজের প্রতি, শরীরের প্রতি যত্ন নাও না। আর যত্ন না নিলে জ্বর, মাথা ব্যথা তো হবেই। যাইহোক, নাস্তা করবে কোথায়?

গরম হোটেলে।

আবার গরম হোটেল।

ঐ হোটেলে খেয়েই তুমি অসুস্থ হয়েছ।

না হোটেলে খেয়ে নয়, মনে হচ্ছে অন্যকিছু

অন্যকিছু আবার কী?

বুঝেও যেন বুঝতে পারছি না। তোমার সাথে সামনাসামনি দেখা হলো বলব।

কবে দেখা হবে?

আজ পড়াতে আসব। বিকেলে দেখা হবে।

না বাসায় তোমার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। বাইরে কোথাও বসতে হবে। কবে বসবে?

পরীক্ষা দিয়ে নেই।

তুমি পড়াশুনায় খুব সিরিয়াস। পরীক্ষা তো থাকবেই। এর মধ্যেও তো দেখা করা যায়। আমি তোমাকে জানাব।

ঠিক বলছো তো?

হ্যাঁ।

তাহলে তোমার সময়ের অপেক্ষায় থাকব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

এখন তাহলে রাখি। ভালো থেকো।

এরপর লাইন কেটে গেল। লিমন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পড়ে থাকল। তারপর উঠে হাত মুখ ধুয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। এমন সময় তার চোখ পড়ল পূর্বের দিকের জানালায়। জানালাটা খোলা। ওপাশে পিয়ার জানালা। জানালায় একটা পর্দা টানানো। পর্দার ওপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। লিমন দেখতেও চায় না। সে জানালা বন্ধ করে দিল।

গরম হোটেল থেকে নাস্তা করে এসে দুপুর পর্যন্ত একটানা পড়ল লিমন। কিন্তু তারপর আর পারল না। আবার তার শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হলো। সেই সাথে শরীরের তাপমাত্রাও বাড়তে থাকল। একপর্যায়ে সে শুয়ে পড়তে বাধ্য হলো। দুপুরে খাওয়া হলো না।

সন্ধ্যার খানিকটা আগে উঠে বসল লিমন। শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। সে বুঝতে পারছে তাকে সুস্থ হতে হলে আবার পিয়ার কাছে যেতে হবে। এতক্ষণ সে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। কিন্তু এখন যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। তার সামনে আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু পিয়ার অনুমতি ব্যতীত পিয়ার ওখানে যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর জানালা খুলল, সে যদি পিয়াকে দেখা যায় এই আশায়। কিন্তু পিয়া নেই। ওপাশে আগের মতোই জানালায় পর্দা টানানো।

সন্ধ্যার পর লিমন অবশ্য আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে কাঠের পাটাতন ব্যবহার করে পিয়ার ছাদে চলে এলো। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল পিয়ার রুমের দিকে। জানে সে যা করছে তা অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। কিন্তু কোনো উপায় নেই। দরজার সামনে এসে বেশ কয়েকবার নিচু স্বরে ‘পিয়া, পিয়া’ বলে ডাক দিল। কিন্তু পিয়ার সাড়াশব্দ পেল না। পরে ধীরে ধীরে উঁকি দিল ভিতরে। না নেই, পিয়া নেই।

লিমন অনুমান করল তাকে চোখ বেঁধে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে যেতে পারলে হয়তো সে গতকালকের পানীয় পেয়ে যাবে। ঐ জায়গাটা ছিল দোতলায়। কিন্তু দোতলায় নুপূর আর ঝুমুর থাকে। এভাবে তার ওখানে যাওয়া মোটেও ঠিক নয়। অথচ তাকে যেতেই হবে, বিশেষ ঐ পানীয় পান করতে হবে। তাই অনুমানের উপর সে এগোতে থাকল। একটা সিঁড়িও পেয়ে গেল। সেই সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে গিয়ে তবলার শব্দ কানে এলো তার। আরও খানিকটা নামতে বুঝতে পারল নিচে নাচের প্র্যাকটিস হচ্ছে। দোতলায় না থেমে একতলায় নেমে এলো লিমন। তারপর উকি দিতে দেখল একপাশে পিয়া বসে আছে। সামনে নুপূর নাচছে। একেবারে কোনায় ঝুমুর তবলা বাজাচ্ছে।

এবার লিমন দোতলায় উঠে এলো। অনুমান করল খানিকটা সময় সে পাবে। এটুকু সময়ই যথেষ্ট তার জন্য। যেভাবেই হোক তাকে গতকালকের সেই পানীয় পান করতে হবে। অণুমানের উপর এগিয়ে যেতে বুঝল কোন কক্ষটা হবে। পাশের অন্য দুটো কক্ষ খোলা হলেও এই কক্ষটা বাইরে থেকে আটকানো। সে নিঃশব্দে কক্ষটা খুলল। ভিতরে পুরো দেয়াল লাল রঙের। তবে তেমন কিছু নেই। শুধু একটা কফিন দেখা যাচ্ছে। তবে ভালোমতো তাকাতে চমকে উঠল সে। কফিনের দুপাশ থেকে দুটো হাত বের হয়ে আছে। হাতের আঙ্গুলগুলো খুব ধীরে ধীরে নড়ছে। তার পাশেই বেশ কয়েকটি টিউব। এগুলো দেখতে স্যালাইনের টিউবের মতো। একটা হাতে স্যালাইন চলছে। অন্য হাতে একটা টিউবে মাথার সুই ধমনীর মধ্যে প্রবেশ করান। ধমনী থেকে রক্ত টিউবে আসছে। এরকমই একটা টিউব যে তার মুখের মধ্যে গতকাল দেয়া হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মানে সে মানুষের রক্ত পান করেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল লিমনের।

লিমন কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তার মনে হতে লাগল জ্ঞান হারিয়ে যে কোনো সময় সে পড়ে যাবে। এজন্য ভারসাম্য রক্ষা করতে পাশের দেয়ালে হাত রাখল। কিছুটা সময় নিল নিজেকে স্থির করতে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কফিনের কাছে। কফিনটি নিচের দিকে ছোট্ট একটা ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। ছিটিকিনি খুলে উপরে টান দিতে নিচের অংশ ব্যতীত পুরোটাই উঠে এলো। যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। মোবারক শুয়ে আছে নিচে। তার দুটো পা আংটার সাহায্যে কফিনের নিচের অংশে লাগানো। মুখটা শক্তভাবে বাঁধা। চোখ দুটো আধবোজা হয়ে আছে। একেবারে রক্তশূন্য। মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শরীর শুকিয়ে কাঠ হওয়ার মতো অবস্থা। মনে হচ্ছে বহুদিন সে কিছু খায় না। হতবিহ্বল লিমন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। নিচে তবলার শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। তারমানে সবাই এখন উপরে উঠে আসবে।

লিমন শুধু বলল, মোবারক ভাই, আমি লিমন।

মোবারক অবশ্য কোনো উত্তর দিল না। মোবারক কিছু শুনল কিনা তাও বোঝা গেল না। লিমন উপরের ঢাকনা নামিয়ে ছিটকিনি আটকে দিল। তারপর বের হয়ে এলো কক্ষ থেকে। এর মধ্যে নিচ থেকে উপরে উঠার কারো পায়ের শব্দ কানে এলো লিমনের। সে দ্রুত উপরে তিনতলায় উঠে এলো। তারপর কাঠের পাটাতন পার হয়ে সরাসরি নিজের রুমে। এখন সে হাঁপাচ্ছে। এতটাই হাঁপাচ্ছে যে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো তার। আর পারল না। বিছানার উপর এলিয়ে দিল নিজেকে।

২৪

শোয়ার পর থেকে লিমনের শরীর কাঁপতে শুরু করল। জ্বর ছেড়ে দিয়ে হঠাৎই ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীর। শরীরের অভ্যন্তরের জ্বালা যন্ত্রণা নেই। কেমন যেন নিস্তেজ নিস্তেজ ভাব। এর মধ্যে ঘামতেও শুরু করেছে। বেশ ভয় করছে তার। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারছে না। সে যে মোবারকে দেখেছে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে মোবারককে সে হোটেলে দেখেছিল সেই মোবারক আর কিছুক্ষণ আগে দেখা মোবারকের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। চেনার কোনো উপায় নেই।

মোবারকের রক্ত পান করছে পিয়া, সাথে ঝুমুর আর নুপূর। লিমন নিজেও পান করেছে। কিন্তু তা ছিল অনচ্ছিাকৃত। তাহলে এখন তার কী করা উচিত? যে ভাবেই হোক মোবারককে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। পুলিশের সহায়তা নিলে সম্ভব হবে। তাহলে কী সে পুলিশকে জানাবে? এরকম একটা প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর খুঁজতে লাগল সে। তার অবচেতন মন বলছে পুলিশকে বলেও লাভ হবে না। কারণ পিয়া এমনভাবে সবকিছু সাজাবে যে পুলিশ নিজেই বোকা বনে যাবে। তাহলে? আর ভাবতে পারছে না লিমন অতিরিক্ত দুর্বলতায় চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। তার উপর আবার জ্বালা যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে শরীরে। জ্বরও আসতে শুরু করছে। তার এখন ঘুম প্রয়োজন, গভীর ঘুম। এরকম ভাবতে ভাবতে সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল।

লিমনের ঘুম ভাঙল পিয়ার ডাকে। পিয়া তার রুমে এসে তাকে ডেকে তুলেছে। উঠে বসতে বলল, সেই সন্ধ্যা থেকে দেখি তুমি শুধু ঘুমাচ্ছ। কেন?

লিমন কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। দুহাতে চোখ রগড়াল শুধু।

এখন কটা বাজে জানো?

না।

রাত সাড়ে বারোটা।

রাত সাড়ে বারোটা!

হ্যাঁ।

এত রাত হয়ে গিয়েছে?

হু।

টেরই পেলাম না।

তাই তো মনে হচ্ছে। শরীর কেমন তোমার?

ভালো না।

আমি ভালো করে দেবে। চলো বাইরে বসি।

কোথায়?

ছাদে।

না বসব না।

পিয়া মিষ্টি হেসে বলল, কেন বসবে না? আজ বাইরে সুন্দর বাতাস আছে। বসলে ভালো লাগবে। তেমার সাথে অনেক গল্প করব।

লিমন সোজা হয়ে বসে বলল, না, তোমার সাথে আর কোনো গল্প করব না।

পিয়া চোখ কুচকে বলল, কেন?

কা..র… ন..

কী কা....ন….

কারণ তুমি মানুষের রক্ত পান করো।

পিয়া সোজা হয়ে বসে বলল, তু.. তুমি জানলে কীভাবে?

.. আমি জেনেছি।

কীভাবে?

আমি তোমাদের অলক্ষ্যে তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। দেখিছি তোমরা মোবারক ভাইকে বন্দি করে রেখেছ।

পিয়া কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল, তারপর টেনে টেনে বলল, তুমি কী করতে চাচ্ছ?

আমি পুলিশকে বলব।

এবার খিল খিল করে হেসে উঠল পিয়া। তারপর বলল, তুমি দেখি বোকা ছেলে। এর পরিণতি কী হবে জানো?

তোমরা সবাই পুলিশের হাতে আটক হবে।

পিয়া আবার হেসে উঠল। তারপর আগের মোতোই টেনে টেনে বলল, না হবো না, কারণ কী জনো, আমরা রাক্তপ। ও হ্যাঁ রক্তপ কী তা তো তুমি জানো না। রক্তপ হচ্ছে যারা মানুষের রক্ত পান করে তারা। রক্ত আর পানের ‘প’ এই দুই শব্দ মিলে হয়েছে রক্তপ। তুমিও কিন্তু রক্তপ। কারণ তুমি মানুষের রক্ত পান করেছ। আর তাছাড়া তোমার শরীরে রক্তপের রক্ত আছে, মানে আমার রক্ত। রক্ত ছাড়া তুমি আর বাঁচতে পারবে না। তোমাকে সেদিন যে ট্যাবলেট খাইয়েছিলাম সেটাও কিন্তু ছিল জমানো রক্ত দিয়ে তৈরি। বেঁচে থাকার জন্য রক্ত তোমার প্রতিদিন প্রয়োজন হবে। একদিন রক্ত পান না করলেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। কারণ যার শরীরে রক্তপের রক্ত আছে তাকে বাইরের রক্ত শরীরে গ্রহণ করতেই হবে। তা না হলে সে বাঁচতে পারবে না। এরকম রক্তপের সংখ্যা কিন্তু অনেক। তুমি চাইলেও মুক্তি পাবে না। এজন্য বলছি পুলিশকে জানানোর মতো উদ্ভট চিন্তা থেকে বের হয়ে এসো। বরং আমরা শান্তিতে থাকি। আর পুলিশ এসেও যে কিছু করতে পারবে তা কিন্তু নয়। কারণ কিছুক্ষণ আগে মোবারকের মৃত্যু হয়েছে। এতদিন স্যালাইন তার শরীরে কাজ করছিল। এখন আর করছে না। কারণ তার শরীরিক অবস্থা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ আগে চুষে চুষে আমরা তার সমস্ত শরীরের রক্ত নিঃশেষ করেছি। পুলিশ এলে এখন সাক্ষ্য দেয়ার মতো কেউ থাকবে না। শুধু তুমি বলবে। কিন্তু তোমার কথা পুলিশ বিশ্বাস করবে না। কারণ তুমি যে রক্ত পান করছ তার ছবি আমাদের কাছে আছে। আমরা তুলে রেখেছি। সময় মতো কাজে লাগাব। পুলিশকে বলব রক্তপদের মূল ব্যক্তি তুমি। তখন কিন্তু আর মুক্তি পাবে না। জেলের মধ্যে পঁচতে হবে। সেখানে তোমার জীবন হবে নিদারুন কষ্ট আর যন্ত্রণার। কারণ কেউ তোমাকে রক্ত দেবে না। তখন তোমাকে কী করতে হবে জানো? শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা নিবৃত্ত করার জন্য নিজের রক্ত নিজেকে পান করতে হবে। শেষ পরিণতি হবে মৃত্যু।

তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?

না, ভয় দেখাচ্ছি না। যা সত্য তাই বলছি।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি না। আমি পুলিশকে বলবোই।

তুমি পাগলামো করছ। তোমাকে মনে রাখতে হবে, তুমি যতটা না মানুষ তার থেকে বেশি রক্তপ।

না না, আমি রক্তপ নই। আমি মানুষ।

তুমি রক্তপ।

না মানুষ।

তুমি সীমা অতিক্রম করছ।

করলে করছি। কিন্তু আমি পুলিশের কাছে যাবই যাব। তোমাদের এই অপকর্ম আমি বন্ধ করব।

কথাগুলো বলে খাট থেকে নামল লিমন। তারপর পা দুটো থর থর করে কাঁপছে। তারপরও সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল দরজার দিকে। কিন্তু পারল না। পিয়া তাকে ধরে বসল।

লিমন বেশ জোরেই বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও।

এভাবে চিৎকার করো না। পরিণতি ভালো হবে না কিন্তু।

আমি পুলিশকে সবকিছু বলবোই।

বলেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল লিমন। কিন্তু পারল না, পিয়া মেয়ে হলেও শরীরে অনেক শক্তি।

লিমন বদ্ধ পরিকর। যেভাবেই হোক পুলিশকে তার সবকিছু জানাতে হবে। তাই সে আর দেরি করল না। টেবিলের উপর ফল কাটা ছুরিটা ছো মেরে তুলে নিল হাতে। পিয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই পর পর দু’বার সেটি ঢুকিয়ে দিল পিয়ার তলপেটে।

পিয়া মুখ দিয়ে ‘কোক্’ শব্দ করে খানিকটা পিছিয়ে গেল। তার হাতটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। লিমন স্পষ্ট দেখতে পেল তলপেটে যেখান দিয়ে ছুরি ঢুকেছিল সেই জায়গাটা আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে একেবারে যেমন ছিল তেমন হয়ে গেল। ততক্ষণে পিয়ার মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে। সে জিহ্বা দিয়ে নিজের হাতের আঙ্গুলে লেগে থাকা রক্তটুকু প্রথমে চেটে খেল। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো লিমনের কাছে। লিমনের হাতে থাকা ছুরিটা নিয়ে সেটাতে জিহ্বা দিয়ে লম্বা চাটা দিল। কয়েকবার চাটা দিতে একটু রক্তও থাকল না ছুরিতে।

পিয়া এবার মুচকি একটা হাসি দিল। তারপর টেনে টেনে বলতে লাগল, তুমি আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছ লিমন। পারবে না। তুমি বোধহয় জানো না আমার জীবন আর আমার মধ্যে নেই। আমার জীবন এখন তোমার মধ্যে। কারণ আমার রক্ত তোমার শরীরে। এজন্য কেউ আমাকে হত্যা করতে চাইলেও পারবে না। যেমন তুমি পরোনি। তুমি নিশ্চয় এখন বিশ্বাস করছ আমি ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। সত্যি আমার অনেক ক্ষমতা। আর হ্যাঁ, আমার জীবনটা আমি রেখেছি তোমার মাঝে। কেউ তোমাকে হত্যা করলে আমার সেই জীবন আবার আমার কাছে চলে আসবে। আমার মৃত্যু হবে না। তবে তুমি যদি আত্মহত্যা করো তাহলে আমার মৃত্যু হবে। আমি জানি তুমি আত্মহত্যা করবে না। কারণ আত্মহত্যা যে মহাপাপ তা তুমি জানো। অনেক চিন্তা ভাবনা করে এজন্য আমি তোমাকে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি। তুমি আমার সাথে আজ যে আচরণ করেছ, আমাকে হত্যা করার যে চেষ্টা করেছ, তা ক্ষমার অযোগ্য। তারপরও তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিচ্ছি, কেন জানো? কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি, দারুন ভালোবাসি। এজন্য চাই সারাটি জীবন তুমি আমার হয়ে থাকবে। চলার পথে আর কখনো, কোনোদিনও তুমি এরকম ভুল করবে না। তাহলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। এসো আমার কাছে এসো।

লিমন একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেছে। সে যে কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না।

পিয়া লিমনের হাত ধরে বলল, চলো আমার ওখানে যাবে। তোমার শরীর সত্যি অসুস্থ, তোমাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। এটা আমার দায়িত্ব।

লিমন যেন কেমন ঘোরের মধ্যে আছে। মনে হচ্ছে সে শূন্যে ভাসছে। যে কোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে। পিয়া যতক্ষণ তার হাত ধরে রাখে ততক্ষণই সে বেঁচে থাকবে। তাই সে আর নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল না। পিয়ার হাত ধরেই এলো পিয়ার ছাদে।

পিয়া এবার বলল, আমাদের একটা কাজ করতে হবে। মোবারকের লাশটিকে পানিতে ডুবিয়ে দিতে হবে।

লিমন কিছু বলল না, শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল শুধু।

হাত ধরে পিয়া তাকে নিজের বাসার দোতলায় নিয়ে এলো। বাইরে এনে রাখা হয়েছে মোবারকের লাশটি। শরীর দেখে মনে হচ্ছে শুধু কঙ্কালের উপর চামড়া আছে, আর কিছু নেই। মৃত্যুর আগে যে কী অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে মোবারককে অনুধাবন করতে পারছে লিমন। কিন্তু তার কিছু করার নেই।

মোবারকের মুখের বাঁধনটিও খোলা হয়নি। দুই পা আংটার মধ্যে আটকা থাকায় চামড়ায় দগদগে ক্ষত হয়ে গিয়েছে। বার বার পা বের করে নেয়ার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু পারেনি। এজন্য পায়ের এ অবস্থা। অথচ এতটুকু দয়া মায়া দেখায়নি পিয়া, নুপূর, কিংবা ঝুমুর। সবাই তার রক্তের নেশায় পাগল ছিল।

লিমনকে মোবারকের মাথা ধরতে বলা হলো। নুপূর আর ঝুমুর ধরল দুই হাত। তারপর তাকে টেনে নামান হলো নিচে। লাশটি একটি বস্তায় ভরে আনা হলো নদীর পাশে। এরপর বস্তার সাথে কয়েকটি ইট বাঁধা হলো। অতঃপর ডুবিয়ে দেয়া হলো পানিতে। এই লাশ আর কোনোদিন ভেসে উঠবে না।

এরপর পিয়া তার সাথে রাখা একটি কৌটা থেকে চারটি ট্যাবলেট বের করল। একটা নিজে খেল এবং বাকি দুটি দিল নুপূর আর ঝুমরকে। শেষটি দিল লিমনকে। লিমন আর দেরি করল না। শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ট্যাবলেটি দ্রুত মুখে দিল। এরপরই সে অনুভব করল পৃথিবীটা শান্তির, বড় শান্তির।

২৫

তিন দিন পর।

রাত দুইটা। লিমন ছাদের একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বুড়ীগঙ্গা নদী। দশটা থেকে চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ঘুমাতে পারেনি। তাই এসে দাঁড়িয়েছে ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে। নদীর বাতাস এসে লাগছে তার মুখে। ভালোলাগার দারুন একটা অনুভূতি তার মধ্যে জেগে উঠেও উঠছে না। কারণ সে বন্দি। বন্দি পিয়ার রক্ত সাধনার বেড়াজালে।

লিমন যখন মোবারকের লাশ নদীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন পিয়া কিছু ছবি তুলে রেখেছে। ঐ ছবিগুলো দেখিয়ে পিয়া তাকে আরো দুর্বল করে ফেলেছে। কারণ ঐ ছবি দেখলে যে কেউ ভাববে সে নিজে বুঝি মোবারককে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছে। এজন্য সবকিছু পুলিশকে খুলে বলার যে ইচ্ছে তার ছিল তা আর নেই। এখন সে যা করতে পারে তা হলো আত্মহত্যা। এতে পিয়ার মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু তাতে তার নিজের কী লাভ? কোনো লাভ নেই। মোবারকের মৃত্যুর পর থেকে সে বিবেকের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এই যুদ্ধে সে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। কারণ দিন যত যাচ্ছে সময় ততই তার প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। এখন প্রতিদিন তাকে পিয়ার দেয়া একটি ট্যাবলেট খেতে হয়। ট্যাবলেট না খেলে সে স্থির থাকতে পারে না। কীভাবে ট্যাবলিটটি বানানো হয়েছে তা তার জানা নেই। শুধু জানে ভিতরে রক্ত আছে। পিয়ার কাছ থেকে দূরে সরে গেলে এই ট্যাবলেটের অভাবে সে শান্তিতে থাকতে পারবে না। শরীরে মারাত্মক জ্বালাপোড়া শুরু হবে এবং আবার তাকে ফিরে আসতে হবে। এজন্যই সে নিজেকে বন্দি মনে করছে। আর অনিশ্চয়তার ভরে উঠেছে সবকিছু। গতকাল তার পরীক্ষা থাকলেও সে দেয়নি। কারণ মানসিক শান্তি নেই। যোগাযোগ নেই ইমার সাথেও। ইমা প্রতিদিনই তাকে ফোন করে। কিন্তু সে ফোন ধরে না। কারণ আজ সে অস্বাভাবিক মানুষ। রক্তপ সে কখনো মানুষ ইমার ফোন ধরতে পারে না। ইমাকে সে আর কষ্ট দিতে চায় না। এজন্য সে ইমার কাছ থেকে দূরে অনেক দূরে চলে যেতে চায়। পিয়ার কাছ থেকেও সে দূরে সরে যেতে চায়। কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। একা হয়ে গেলে সে ট্যাবলেট জোগাড় করতে পারবে না, পারবে না রক্ত সংগ্রহ করতে। রক্ত কিংবা ট্যাবলেট ছাড়া তার জন্য বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই তাকে পিয়ার সাথেই থাকতে হবে। থাকতে হবে তার অধীন হয়ে। এরকমভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো। কিন্তু কীভাবে মৃত্যুবরণ করবে সে? আত্মহত্যা? না, আত্মহত্যা করা মহাপাপ। তাছাড়া আত্মহত্যা করতে ভয় পায় সে। বিষয়টা বোধহয় পিয়া বুঝতে পেরেছে। পেরেছে বলেই পিয়া নিজের জীবনটা তার মধ্যে দিয়েছে। কী অবিশ্বাস্য! তার বেঁচে থাকার জীবনের সাথে এখন দুটো জীবন জড়িত। একটা তার নিজের, আর অন্যটা পিয়ার। কিন্তু বাস্তবে কী মানুষ এমন পারবে? না কখনোই পারবে না। কারণ মানুষ নিজের জীবনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। পৃথিবীর কোনোকিছুর বিনিময়ে মানুষ নিজের জীবনকে অন্যের হাতে দেবে না। অথচ রক্তপরা পারে কিংবা তাদের পারতে হয়। পিয়া নিজের জীবনকে তার কাছে সমর্পন করেছে। এটা এক অদ্ভুত নিয়ম! লিমন স্বীকার করতে বাধ্য হলো এটা অনেক বড় ত্যাগ এবং ঝুকি। ভালোবাসার মানুষদের কাছে পেতে রক্তপরা এই ঝুকি মেনে নেয়। পিয়াও তাই করেছে। এজন্য পিয়ার চিন্তা চেতনা আর ভালোবাসায় এখন শুধুই সে। কিন্তু লিমনের জন্য বিষয়টা মেনে নেয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ সে রক্ত পান করতে চায় না, কোনো রক্তপকে বিয়ে করতে চায় না, কোনো রক্তপের সাথে সংসার করতে চায় না। সে চেয়েছিল ইমার মতো কাউকে ভালোবেসে, বিয়ে করে সুন্দর জীবন উপভোগ করতে। অথচ তা আর সম্ভব নয়। আজ সে রক্তপ, অন্যের রক্ত পান করতে না পারলে সে সুস্থ থাকতে পারে না, শান্তিতে থাকতে পারে না, পারে না নিজেকে স্থির রাখতে। এজন্যই তাকে মেনে নিতে হচ্ছে পিয়াকে, যে কিনা বয়সে তার থেকে বড় হলেও জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

কী করছ?

প্রশ্ন শুনে পিছনে ফিরে তাকাল লিমন। দেখল পিয়া এসেছে। আজ সে সাদা রঙের শাড়ি পড়েছে।

লিমন কিছু বলল না দেখে পিয়া নিজে থেকেই বলল, আজ এই সাদা শাড়ীতে কেমন লাগছে আমাকে?

পিয়া আজ শাড়ির সাথে শর্ট ব্লাউজ পরেছে। ব্লাউজের কাপড় এত পাতলা যে ব্রেসিয়ারের স্ট্রাপ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন সাজের মধ্যে উগ্রতা রয়েছে। তারপরও সুন্দর লাগছে তাকে। তাই বলল, সুন্দরই লাগছে।

জানি তুমি আমাকে সুন্দর বলবে। তো এত রাতে জেগে আছ কেন?

ঘুম আসছিল না।

আমারও ঘুম আসছিল না। তোমাকে পেয়ে ভালোই হলো। গল্প করতে করতে রাতটা কাটিয়ে দেব।

কথা বলতে বলতে পিয়া লিমনের একেবারে শরীর ঘেষে এলো। পিয়ার চুলগুলো এখন লিমনের কাধে উড়ে উড়ে এসে পড়ছে। পিয়া বলল, নদীটা খুব সুন্দর, তাই না?

হ্যাঁ সুন্দর।

নদীতে ঘুরবে?

লিমন অবাক হয়ে বলল, এত রাতে!

হ্যাঁ।

না। আমার এখন নদীতে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে। আর হ্যাঁ, অমাবস্যা হতে আর দুইদিন বাকি আমি ভাবছি দুদিন পরে আমরা বিয়ে করব। তোমার মতামত কী?

.. আমি চাচ্ছি আরও দেরি করতে।

কেন?

আমার সময় দরকার।

সময় নিয়ে কী করবে? জীবন যখন শুরু করতেই হবে, আগে করাই ভালো। শুধু শুধু দেরি করব কেন? এ বিষয়ে আর কোনো কথা নয়। দুদিন পর অমাবস্যায় আমাদের বিয়ে হবে। এটাই চূড়ান্ত। আমাদের বিয়ে কীভাবে হয়, জানো?

না জানি না।

মানুষের রক্তপান করে।

লিমন অবাক হয়ে বলল, মানুষের রক্তপান করে!

হু।

তুমি কোথায় পাবে মানুষের রক্ত?

জোগাড় করব।

কী বলছ!

এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। মানুষের রক্ত জোগাড় করা আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। বলতে গেলে আমরা রক্তের মধ্যেই বসবাস করি। আর হ্যাঁ, ঐ দিন রাতে আমি তোমার রক্ত পান করব, আর তুমি আমার রক্ত পান করবে। মানুষ বিয়ের সময় যেমন একে অন্যকে ফুলের মালা দেয়, আমরা দেই রক্ত। এই রক্ত পান আমাদের পরস্পরকে বন্ধনে আবদ্ধ করে। বুঝতে পেরেছ?

হ্যাঁ পেরেছি।

এরপর আমরা কী করব, জানো?

না জানি না।

আমরা চলে যাব।

কোথায় যাবে?

নতুন কোথাও। এখানে তো পাঁচ বছর হয়ে গেল। আর থাকতে চাই না। রক্তপরা বেশিদিন একজায়গায় থাকে না। মানুষজন সন্দেহ করতে পারে।

লিমন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?

পিয়া লিমনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ করো।

তোমরা কী রুবায়েতকে হত্যা করেছ?

পিয়া মৃদু একটা হাসি দিল। তারপর বলল, আমরা ওকে হত্যা করিনি। ওর রক্ত পান করেছি। রুবায়েত ছিল ভীতু স্বভাবের। ভয়েই মারা গেছে। তার রক্তপান করে আমরা খুব একটা মজা পাইনি। তবে মোবারকের রক্তপান করে মজা পেয়েছিলাম। খুব শক্ত ছিল। দীর্ঘদিন আমাদের রক্ত দিয়েছে। আবার রক্তের স্বাদও ভালো ছিল। যাইহোক, আজ তোমার শরীরের কী অবস্থা?

ভালো।

ট্যাবলেট খেয়েছিলে?

হ্যাঁ।

এই যে আগামীকালকের ট্যাবলেট।

লিমন ট্যাবলেট হাতে নিয়ে বলল, প্রতিদিন দেয়া দরকার কী? একসাথে অনেকগুলো দিয়ে দিলেই পারো।

এখন দেব না। নতুন জায়গায় গিয়ে দেব। ওখানে শুধু তুমি আর আমি থাকব।

নুপূর আর ঝুমুরের কী হবে?

ওদের জন্য জায়গা নির্ধারন করা হয়েছে। ওরা সেখানে চলে যাবে।

এরকম কত জায়গায় রক্তপরা আছে?

পিয়া একটু সময় নিয়ে বলল, আমি বলতে পারব না। তবে বেশ অনেক জায়গায়। গত বছর প্রায় বিশ জায়গার রক্তপরা আমরা জড়ো হয়েছিলাম। সেটা ছিল বড় আনন্দের। কেন জানো?

না জানি না।

আমরা একটা জলজ্যান্ত মানুষের রক্ত পান করেছিলাম। রক্তপান উৎসব ছিল মানুষটির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। আমাদের সে কী আনন্দ। এ বছর যখন উৎসব হবে তোমাকে নিয়ে যাব।

তাতে লাভ?

যতই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করবে ততই তোমার মৃত্যু কঠিন হয়ে পড়বে।

মানে?

এই যে তুমি আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু পারো নি। কারণ কী জানো? ঐ রক্তপানের উৎসব। ওখানে আমাদের সাধক আসেন যিনি আমাদের কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন। তুমি যখন বার বার যাবে তখন তোমাকেও ঐ ক্ষমতা দেবেন তিনি I

উনি থাকেন কোথায়?

আমি জানি না। তবে অতি শীঘ্রই তার সাথে আমার দেখা হবে। কারণ তিনিই আমাকে বিয়ে করতে বলেছেন। তোমাকে নিয়ে আমার তার সাথে দেখা করতে হবে।

তাই নাকি?

এটাই নিয়ম।

কেন?

কারণ তিনি তোমার রক্তপান করবেন।

কী বলছ!

আমাদের সাধককে আমাদের সকল সদস্যদের রক্তপান করতে দিতে হয়। উনি যদি মনে করেন আমার রক্ত পান করবেন আমাকে তা দিতে হবে। যদি মনে করেন তোমার রক্ত পান করবেন তাহলে তোমাকে রাজি হতে হবে।

যদি রাজি না হই?

এরকম কথা মুখেও আনা যাবে না। তিনি আমাদের সব। তাকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাদের রক্তপান করতে চেয়েছেন, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। তাকে কখনো নিরাশ করা যাবে না, কষ্ট দেয়া যাবে না। যাইহোক, চলো ভিতরে যাই। বাতাসের সাথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

রুমে ঢুকতে বৃষ্টির তীব্রতা সত্যি বৃদ্ধি পেল। একেবারে ঝুম বৃষ্টি। বহুদিন এরকম বৃষ্টি হয় না। পিয়া বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

কী সিদ্ধান্ত?

তোমার এখানে আমি থেকে যাব।

লিমন চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলছ!

হ্যা সত্য বলছি। তুমি থাকতে কেন আমি এই বৃষ্টিতে ভিজব। তাই তোমার সাথে রাতটা গল্পগুজবে কাটিয়ে দেব। দেখবে আমি কত সুন্দর, কত ভালো। চা দিয়ে শুরু করি। তোমার জন্য আজ আমি চা বানাব। সুন্দর চা, আমি নিশ্চিত তুমি পছন্দ করবে।

লিমন কোনো কথা বলল না। কারণ সে জানে পিয়ার সাথে কথা বলে লাভ হবে না। পিয়া যা বলে তাই করে। পিয়ার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। পিয়াই তার নিয়ন্ত্রক তার নির্দেশক। এজন্য বেঁচে থাকতে হলে পিয়ার আদেশ নির্দেশ তাকে শুনতে হবে, পিয়ার মতো করে নিজেকে সাজাতে হবে, নিজেকে ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পন করতে হবে। একমাত্র তাহলেই সে বেঁচে থাকতে পারবে।

২৬

ইমা অস্থির হয়ে আছে। কয়েকদিন হলো লিমনের সাথে তার কোনো যোগোযোগ নেই। লিমন না আসছে টিউশনি করতে, না ধরছে তার ফোন। প্রতিদিন কম না হলেও একশ বার সে ফোন করছে লিমনকে। লিমন ফোন ধরেনি। একবারের জন্য ফোন করেওনি। লিমনের কী ঘটল সে ঠিক বুঝতে পারছে না। এজন্যই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে লিমনকে খুঁজতে যাবে। কিন্তু কাউকে কিছু জানাবে না। এরকম একটা পরিকল্পনা থেকে ক্লাস শেষে দুপুরের পর সে রওনা দিল লিমনের বাসার উদ্দেশ্যে।

লিমনের বাসা সুনির্দিষ্টভাবে ইমা চেনে না। শুধু জানে গরম হোটেলের উলটো পাশে একটা দোতলা বাড়িতে সে থাকে। গরম হোটেল খুঁজে পেতে তার তেমন কোনো সমস্যা হলো না। হোটেলের উলটো পাশে দুটো বাড়ি একই রকম দেখতে। একটির নিচে ব্যবসায়িক দোকান আর অন্যটির নিচে নাচের স্কুল। দুটো বাড়ির মধ্যে নাচের স্কুল থেকে তথ্য পাওয়া তার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে বলে সে অনুমান করল। কারণ এখানে কোনো না কোনো মহিলা থাকবে বলে তার আশা।

বাইরের গেট বন্ধ ছিল। ইমা প্রথম দুবার কলিং বেল বাজালে কেউ গেট খুলল না। তৃতীয়বার বাজাতে সুন্দর দেখতে অল্পবয়সী এক মেয়ে খুলে দিল গেট। বলল, কাকে চাচ্ছেন? ইমা ইতস্তত করে বলল, ..আমি আসলে লিমনকে খুঁজছিলাম। এই বাসায় কী লিমন থাকে?

মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকে বলল, লিমন!

হ্যাঁ।

এবার উপর থেকে কাউকে বলতে শোনা গেল, কে এসেছে নুপূর?

একটি মেয়ে, সে লিমনকে খুঁজছে।

কী নাম মেয়েটির?

ইমা এবার তাড়াতাড়ি নাম বললে নুপূর বলল, ইমা।

ও আচ্ছা। ওকে উপরে নিয়ে এসো।

নুপূর উপরে উঠার জন্য ইশারা করতে ইমা বলল, আমি উপরে উঠব কেন? লিমন কী এখানে থাকে?

নুপূর মিষ্টি হাসল। তারপর বলল, অবশ্যই থাকে। তা না হলে আপনাকে উপরে যেতে বলব কেন?

ও আচ্ছা। কিন্তু..

কিন্তু কী?

নাচের স্কুলের মধ্যে..

ও আচ্ছা। নাচের স্কুল শুধু এক তলায়।

এরমধ্যে পিয়া নেমে এসেছে। সে এসে বলল, এসো এসো, তুমিই ইমা।

পিয়া মাথা ঝাকিয়ে বলল, জ্বি।

উপরে এসো।

.. আমি বরং এখানেই থাকি। লিমনকে যদি একটু ডেকে দিতেন।

লিমনের ওখানে আমাদের অতটা যাওয়া আসা নেই। তাছাড়া সে রুমে আছে কিনা তাও জানি না। দেখতে হবে। এসো তুমি এসো।

ইমা ইতস্তত করতে পিয়া বলল, ভয় নেই, এসো। তোমার মতো অনেকেই এখানে প্রতিদিন নাচ শিখতে আসে। আর আমরা সবাই মেয়ে মানুষ। তোমার কোনো ক্ষতি করব না। তবে তুমি আমাদের অবিশ্বাস করলে চলে যেতে পারো।

না না, অবিশ্বাস করছি না।

তাহলে এসো আমার সাথে।

এরপর ইমার জন্য ‘না’ বলা কঠিন হয়ে পড়ল।

পিয়া অবশ্য ইমাকে উপরে নিয়ে গেল না। দোতলায় নুপূরের কক্ষে নিয়ে এলো। তারপর নুপূরকে বলল, তুমি দেখো তো লিমন আছে কিনা। আর হ্যাঁ, ওকে শরবত আর পায়েস দাও।

না না আপু, আমি কিছু খাব না।

কেন?

আসলে…

পিয়া মিষ্টি করে হাসল। তারপর বলল, আমার বাসায় কেউ এলে কাউকে না খাইয়ে যে ছাড়ি না। ও হ্যাঁ, তোমাকে বলা হয়নি। আমার নাম পিয়া। আমি নাচের স্কুলটি চালাই। বলতে পারো সংস্কৃতমনা মানুষ। তাই আতিথিয়েতা আমার হৃদয়ের অংশ। ভালো কথা, তুমি কি নাচতে পারো?

না পারি না।

তুমি যে সুন্দর দেখতে, নাচতে পারলে ভালো হতো। আমার এখানে ভর্তি হয়ে যাও না? আসলে আপু আমার নাচ শেখার ইচ্ছে নেই।

কেন?

ইয়ে মানে…

নাচ ভালো লাগে না?

তা ঠিক নয়। ছোট বেলা থেকে অভ্যাস নেই তো।

তাতে কী? আজ তো নাচ জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। মাঝে মানুষজন নাচ অতটা পছন্দ করত না। এখন দেখবে বয়স্ক নায়ক নায়িকারা, এমন কী বড় বড় ব্যবসায়ীরাও শিখছে। যদিও আমার এখানে তারা আসেন না। তারপরও বলব, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো।

আপু আমি আসলে লিমন ..

এর মধ্যে নুপূর শরবত আর পায়েস নিয়ে এলো। পিয়া বলল, লিমন কী আছে?

আমি দেখিনি। উপরে যাচ্ছি।

তাড়াতাড়ি যাও।

এরকম একটা বাড়িতে লিমন থাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ইমা। এই বাড়িতে একটা নাচের স্কুল, তাছাড়া সবাই যারা থাকে সকলে মেয়ে। তার সমবয়সী মেয়েরাও থাকে। এটা কীভাবে সম্ভব, তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না।

পিয়া এবার বলল, নাও শরবত নাও।

আমার আসলে খেতে ইচ্ছে করছে না।

কী যে বলো না। লেবুর শরবত। খেলে দেখবে অন্যরকম ভালো লাগবে।

অনেকটা জোর করেই ইমার হাতে গ্লাস তুলে দিল পিয়া। তারপর বলল, একাই এসেছ?

জ্বি।

লিমনের সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে?

আমার বোনের ছেলেকে পড়ায়।

ও আচ্ছা। নাও না, খাও, শরবত খাও। লেবু হচ্ছে সিলেটি। ভালো লগাবে। ভিতরে বরফ দেয়া আছে, বেশ ঠান্ডা

ইমার পক্ষে আর না করার উপায় থাকল না। সে শরবতে চুমুক দিল।

পিয়া নিচু স্বরে বলল, কেমন হয়েছে শরবত?

সুন্দর।

পায়েস আরও ভালো লাগবে।

আমি পায়েস খাব না।

কেন?

আপু আমাকে মাফ করবেন। আমি লিমনের কাছে এসেছি।

আচ্ছা ঠিক আছে। শরবতটুকু শেষে করো। তারপর তোমাকে উপরে নিয়ে যাচ্ছি।

এক চুমুকে পুরো শরবতটুকু শেষ করল ইমা।

এর মধ্যে নুপূর এসে জানাল লিমন উপরে আছে। সে আসছে।

ইমা অবাক হয়ে বলল, লিমন এখানে আসবে?

পিয়া উপরে নিচে মাথা দুলিলে বলল, হ্যাঁ আসবে।

ও কী এখানে আসে?

হ্যাঁ আসে।

কী বলছেন!

অসুবিধা কোথায়?

.. আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

তুমি অনেককিছুই বুঝতে পারছ না। তবে পারবে। যখন পারবে তখন দেখবে তুমি যা ভাবছ বাস্তবে সবকিছু ভিন্ন। জীবনটা ঠিক নিজের ভাবনা, নিজের চাওয়া পাওয়ার মতো নয়।

.. আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

বলতে চাচ্ছি যে, সবকিছু নিজের মতো করে চলে না।

.. আমি…

কথা শেষ করতে পারল না ইমা। তার কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। তারপর হঠাৎই চোখের সামনে পিয়ার মুখটা ঝাপসা হতে শুরু করল। সে বিড় বিড় করে বলতে লগাল, সবকিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।

এমন হচ্ছে কেন?

কারণ তোমার লিমনকে পছন্দ করা ঠিক হয় নি।

কী বলছেন আপনি!

সত্য বলছি। লিমনকে আমি পছন্দ করেছি। তুমি পছন্দ করতে পারো না, সেই অধিকার তোমার নেই। এটা অন্যায়, মহা অন্যায়। শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও বটে। এজন্য তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কঠিন প্রায়শ্চিত্ত। তোমাকে…

পিয়ার আর কোনো কথা শুনতে পেল না ইমা। মাথা এলিয়ে পড়ল টেবিলের উপর। গভীর ঘুমে হারিয়ে গেছে সে।

ইশারা করতে নুপূর আর ঝুমুর ভিতরে প্রবেশ করল। পিয়া তাদের দিকে তকিয়ে বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলল, ভাগ্য আমার সুপ্রসন্নই বলতে হয়। বিয়ের রাতে আমি আমার সবচেয়ে কাঙ্খিত রক্তপান করতে পারব। রক্তসাধনায় এই সাফল্য হবে এক মাইলফলক। যাও তোমরা ওকে সাধনার কফিনে শুইয়ে দাও।

নুপূর আর ঝুমুর পিয়াকে সাধনার কক্ষে নিয়ে এলো। কফিনটা ফাঁকাই ছিল। সেখানে তাকে শুইয়ে দুই পায়ে আংটা লাগিয়ে দিল তারা। তারপর মুখটা বেঁধে ফেলল শক্ত করে। শেষের দিকে চোখ মেলে তাকালেও মুখ দিয়ে টু টা শব্দ করতে পারল না পিয়া। বরং তার মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল উপরের ঢাকানা। দুটো হাত কফিনের বাইরে, টেনে আনতে গিয়েও পারল না সে। হঠাৎই বাম হাতে সুই ফোটানোর মতো ব্যথা অনুভব করল। ঘুণাক্ষরেও সে বুঝতে পারল না যে তার শরীরে স্যালাইন প্রবেশ করান শুরু হয়েছে।

২৭

অমবস্যার রাত।

পিয়া আর লিমনের বিয়ে হবে আজ। বিয়ে উপলক্ষে লিমনের কেনা কমলা রঙের শাড়িটা পড়েছে পিয়া। দুজনে বসে আছে রক্ত সাধানার কক্ষে। সামনে একটি কফিন রাখা। কফিনের মধ্যে যে একজন মানুষ আছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে লিমন। কারণ বাইরে দুটো হাত দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুঝি মেয়ের হাত হবে, কারণ তুলনামূলকভাবে চিকন। তবে সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। আসলে প্রথম দিনের মতো প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে এখন হয় না। ইতিমধ্যে সে বুঝতে পেরেছে রক্তপান করে তাকে বেঁচে থাকতে হবে এবং রক্তই তার জীবন I

সময় অনুমান করতে চেষ্টা করল লিমন। মাঝরাত হবে বলে তার ধারণা। বাইরে কোথাও টু টা শব্দ নেই। বাড়ির মধ্যে সবাই অবশ্য সরব। নুপূর আর ঝুমুর দুজনেই আছে সাধনার ঘরে। তারা এর মধ্যে বিয়ের শরবত তৈরি করেছে। এক গ্লাস দিয়েছে লিমনের হাতে, অন্য গ্লাস পিয়ার হতে।

লিমন পিয়ার দিকে তাকাতে পিয়া বলল, তুমি এই গ্লাসে চুমুক দিয়ে শরবত খাবে। তারপর সেই শরবত আমি খাব। এরপর আমার খাওয়া শরবত তুমি খাবে।

শরবতের গ্লাসে চুমুক দিল লিমন। অতঃপর গ্লাস হাতে নিয়ে সেই শরবত খেল পিয়া।

এবার পিয়া তার শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে এগিয়ে দিল লিমনের দিকে। লিমন বাকী শরবতটুকু খেয়ে ফেলল।

এরপর ঝুমুর প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা চোখা আর ধারাল একটি ছুরি নিয়ে এলো। ছুরিটি পিয়ার হাতে দিল সে। পিয়া ছুরিটি উপরের দিকে ধরে বলল, এখন আমরা চূড়ন্ত বন্ধনে আবদ্ধ হব।

লিমন বলল, কীভাবে?

আমরা একে অন্যের রক্ত পান করব। এই ছুরি দিয়ে আমি তোমার হাতের তালুর চামড়া ফুটো করব। তাতে যে রক্ত বের হবে তা আমি পান করব। এতে প্রমাণিত হবে তুমি সারা জীবন আমাকে রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকবে। আমাকে বাঁচানোর জন্য তুমি সবকিছু করবে। একইভাবে তুমি আমার হাতের তালুতে খোঁচা দিয়ে রক্ত বের করবে। সেই রক্ত তুমি পান করবে। এতে আমি প্রমাণ করব তোমার জীবন বাঁচাতে শুধু রক্ত কেন, জীবনের সবকিছু দিতে প্রস্তুত আমি। এভাবে আমরা একে অন্যের আস্থা অর্জন করব, বিশ্বস্ত হব, পারস্পরিক ভালোবাসার চিরবন্ধনে আবদ্ধ হব। এখন তুমি তোমার হাত প্রসারিত করো, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত খুলে ফেল।

লিমন ডান হাতের তালু সামনে ধরল।

পিয়া ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে হালকা একটা খোঁচা মারল লিমনের হাতে। তাতে এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে এলো। সেই এক ফোঁটা রক্ত জিহ্বা দিয়ে চেঁটে খেয়ে ফেলল পিয়া।

অবাক হয়ে দেখছে লিমন। রক্ত দেখলে পিয়ার চোখে মুখে কেমন যেন একরকম উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এই উচ্ছ্বাসের মধ্যে কোথায় যেন পৈশাচিকতার ছোঁয়া আছে। লিমন বুঝতে পারলেও কিছু বলতে পারল না। কারণ সে আর কোনোদিন পিয়াকে কিছু বলতে পারবে না। বরং তাকে পিয়ার মতো করে চলতে হবে।

পিয়া এরপর লিমনের হাতের তালু টিপে আরও খানিকটা রক্ত বের করল। এক ফোটা রক্তও সে নিচে পড়তে দিল না। চেটে চেটে পুরোটাই খেয়ে ফেলল। অতঃপর ছুরিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এখন আমার রক্ত পান করবে।

ছুরিটা ধরার পর লিমনের হাত কাঁপতে লাগল। তারপরও শক্ত থাকল সে। পিয়ার এগিয়ে দেয়া হাতের তালুতে ঠিক মাঝ বরাবর ছুরি দিয়ে খোঁচা দিল সে। আর তাতে লাল রক্ত বের হয়ে হয়ে জমা হতে থাকল হাতের তালুতে। দেরি হতে পিয়া বলল, কই খাচ্ছ না কেন?

লিমন খানিকটা সামনে ঝুকে আবার ফিরে এলো।

পিয়া মৃদু হেসে বলল, আমার রক্ত তোমার জন্য বড় স্বাদের হবে।

তারপরও অনড় থাকল লিমন I

এবার পিয়া টেনে টেনে বলল, আমার রক্ত কিন্তু তোমার শরীরে আছে। কাজেই এই রক্ত তোমার জন্য নতুন কিছু নয়। নাও, পান করো। রক্ত পান করে আমাকে ধন্য করো। স্ত্রী হিসেবে তোমাকে সেবা করার সুযোগ আমাকে দাও।

লিমন আর সময় ক্ষেপন করল না। পিয়ার হাত টান দিয়ে পিয়ার রক্ত পান করতে শুরু করল। পিয়ার রক্ত শরীরে প্রবেশ করা মাত্র ভালো লাগার ভিন্ন এক অনুভূতি সৃষ্টি হলো তার মধ্যে। যতই রক্ত শরীরে যেতে লাগল, ততাই ভালো লাগার অনুভূতির তীব্রতাটা বাড়তে লাগল। একসময় সে পিয়ার হাত টিপে আরও রক্ত বের করল এবং সেই রক্ত পানও করল। যখন রক্ত পান শেষ হলো তার মুখের চারপাশে বেশ রক্ত লেগে থাকতে গেখা গেল। তবে সে তা বুঝতে পারল না।

পিয়া এবার বলল, আমাদের বিয়ের পর্ব শেষ। এখন হবে রক্ত উৎসবের পালা। ঝুমুর তুমি কী প্ৰস্তুত?

হ্যাঁ।

আমরা কীভাবে রক্ত পান করব?

প্রথমে আপনারা দুজন করবেন, তারপর আমরা।

পিয়া এবার লিমনের দিকে ফিরে বলল, ঐ কফিনে যাকে দেখতে পাচ্ছ আমরা এখন তার রক্ত পান করব। ওখানে একটি মেয়ে আছে।

লিমন অস্পষ্টভাবে বলল, একজন মেয়ে।

হ্যাঁ। ঐ মেয়ের রক্ত এখন পর্যন্ত কেউ পান করেনি। তুমি আর আমি প্রথম পান করব। বিয়ের রাতে আটক কোনো নারী কিংবা পুরুষের প্রথম রক্ত পানের সুযোগ বড়ই সৌভাগ্যের। এজন্য বলতে পারি তুমি আর আমি অতি সৌভাগ্যবান। আমি বিশ্বাস করছি, আমাদের সংসার আর ভালোবাসা সত্যি দীর্ঘস্থায়ী হবে। তুমি কী বলো?

লিমন মুখে কিছু বলল না। শুধু উপরে নিচে মাথা দুলাল।

এর মধ্যে ঝুমুর একটা সুই কফিনের মধ্যে থাকা ইমার ডান হাতে প্রবেশ করিয়েছে। রক্ত এসে জমা হচ্ছে ব্ল্যাড ব্যাগের মধ্যে। সেই ব্যাগের সাথে দুটো টিউব লাগানো। ঝুমুর একটা টিউবের মাথা এগিয়ে দিল পিয়ার দিকে, অন্য টিউবের অগ্রভাগ ধরিয়ে দিল লিমনকে।

টিউবের মাথা মুখের মধ্যে দিয়ে হালকা টান দিল পিয়া। আর তাতে ব্লাডব্যাগের মধ্যে জমা হওয়া ইমার রক্ত তার মুখে চলে এলো।

লিমন তখনো চুমুক দেয়নি দেখে বলল, তুমিও টান দাও।

লিমন টিউব মুখে দিয়ে টান দিল। এতে তার মুখেও চলে এলো রক্ত। এভাবে দুজনই ইমার রক্ত পান শুরু করল। এই রক্ত শরীরের প্রবেশের সাথে সাথে নিজের মধ্যে ভিন্ন এক ভালোলাগা অনুভব করল লিমন। এই ভালোলাগা আর আনন্দের কারণে নিজের মধ্যে তার যে শঙ্কা আর ভয় ছিল তার সব দূর হয়ে গেল। হয়তো এ কারণেই রক্তপানে সে আরো উৎসাহী হয়ে উঠল।

পিয়া আর লিমনের পর নুপূর আর ঝুমর রক্তপান করল। আজ বিয়ের দিন। এজন্য রক্তপানে কোনো কার্পণ্য নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না তৃপ্ত হলো ততক্ষণ পর্যন্ত নুপূর আর ঝুমুর রক্তপান করল।

রক্তপান শেষ হলে অদ্ভুত চোখে পিয়া লিমনের দিকে তাকাল। তরপর বলল, আজ রক্তপান আমার জন্য অতি আনন্দের, কেন জানো?

লিমন বলল, কেন?

কারণ আমি আমার চরম শত্রুর রক্ত পান করেছি।

ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ঐ কফিনের মধ্যে যে আছে সে আমার চরম শত্রু। শত্রুর রক্তপানে আনন্দই অন্যরকম। আজ তোমাকে আমি পেলাম, আবার একই সাথে শত্রুর রক্তও পান করলাম। এরকম আনন্দের দিন আমার জীবনে দ্বিতীয়টি আসেনি। সত্যি কথা বলতে কী তোমার আমার পথের সবচেয়ে বড় কাঁটাও আজ দূর হয়ে গেছে। আমার যেমন এখন থেকে কোনো শঙ্কা থাকবে না, তোমারও পিছুটান থাকবে না। তুমি আমাকে আমার মনের মতো করে ভালোবাসতে পারবে। আমিও তোমাকে আমার মতো করে কাছে পাব। যাইহোক, দেখতে চাও আমার ঐ শত্রুকে?

লিমন কিছু বলল না।

পিয়া হাত ধরে লিমনকে উঠাল। তারপর বলল, চলো তোমাকে দেখাব।

তারপর ঝুমুরকে ইশারা করে বলল, উপরের ঢাকানাটা তুলে দাও। আমার শত্রুকে আমার প্রিয়তম দেখুক।

লিমন প্রথমে যেন চিনতে পারল না। যখন চিনল তখন একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেল সে। ইমাও তাকে চিনেছে। তার চোখ দিয়ে গল গল করে পানি পড়ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য এখনো চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছে না। মুখ বাঁধা থাকায় মুখেও কিছু বলতে পারছে না।

লিমন পিয়ার দিকে ফিরে বলল, .. এ তুমি কী করেছ?

পিয়া মৃদু হেসে বলল, ইমা আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। সেই সুযোগ তো আমি তাকে দিতে পারি না।

তু.. তুমি ওকে..

হ্যা আমিই ওকে আটক করেছি, ওকে বন্দি করেছি, ওর রক্ত পান করেছি এবং তোমাকেও করিয়েছি।

লিমন চিৎকার করে বলে উঠল, না না, তুমি করতে পার না। ওকে ছেড়ে দাও, এক্ষুণি ছেড়ে দাও।

অসম্ভব, কেন ছাড়ব?

ও নিস্পাপ।

ইমা পাপী নাকি নিস্পাপ তা আমার দেখার বিষয় নয়। ইমার শরীরে রক্ত আছে, তাজা রক্ত। বেঁচে থাকার জন্য ঐ রক্ত আমাদের প্রয়োজন। কাজেই আমরা কখনোই ইমাকে ছাড়ব না।

না না, তা হতে পারে না। আমি ওকে মুক্ত করব।

কথাগুলো বলেই লিমন কফিনের কাছে চলে গেল। কিন্তু পিয়া পিছন থেকে তাকে টেনে ধরল। ইশারা করতে নুপূর আর ঝুমুরও টেনে ধরল লিমনকে। পিয়া খুব রেগে গেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুমি এ কী করছ? আমরা রক্তপ। রক্ত পান করা আমাদের নেশা। কারো রক্ত পান করার পর এভাবে তাকে আমরা মুক্ত করতে পারি না। আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

না আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি ইমার মুক্তি চাই।

পিয়া কড়া গলায় বলল, তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ লিমন।

লিমন উলটো ধমকে উঠে বলল, আমি না, তুমি সীমা ছাড়াচ্ছ। তুমি অমানুষ, শয়তান..

চোপ…।

আমাকে ধমক দেবে না।

শুধু ধমকই না, আমি তোমাকে বন্দি করে রাখব, সারাটা জীবনের জন্য। ঝুমুর, নুপূর ওকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করো।

লিমন বুঝল এখন যদি সে কিছু না করে সে আর মুক্ত হতে পারবে না। কী করা যায় ভাবতেই পাশে দেখল চোখা ছুরিটা। ছো মেরে সেটা হাতে নিয়ে নিল। তারপর সময় ক্ষেপন ছাড়াই ঢুকিয়ে দিল পিয়ার গলা বরাবর। পিয়া কিছুটা পিছিয়ে গেল। তবে আগের মতো কোনো কাজ হলো না। গলার ক্ষতটা মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে গেল। পিয়ার চোখ দুটো এখন বড় বড় হয়ে আছে। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না বিয়ে পরবর্তীতে লিমন তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে পারে।

এদিকে নুপূর আর ঝুমুর পিছন থেকে লিমনকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। লিমন বুঝল যা করার এখনই করতে হবে। এ পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকাটা একেবারেই মূল্যহীন। কারণ সে আর মানুষ নয়, রক্তপ। পৃথিবী রক্তপদের জন্য নয়, মানুষের জন্য। তাই হাতের মধ্যে থাকা ছুরিটা সে মুহূর্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিল নিজের পেটে। একবার নয়, পর পর তিনবার উদ্দেশ্য আত্মহত্যা করা।

নিজের পেটে ছুরি ঢুকতেই চিৎকার করে উঠল পিয়া। পিয়ার পেটের মধ্যে থেকে রক্ত বের হচ্ছে। একই অবস্থা নুপূর আর ঝুমুরের। তারা দুজন লিমনকে ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে গেল। রক্তে ভিজে গেছে তাদের শরীর। লিমন আবারও পর পর দুবার নিজের পেটে ছুরি ঢুকাল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সে কোনো ব্যথা অনুভব করছে না। সকল ব্যথ্যা যেন পিয়া, নুপূর আর ঝুমুরের। এজন্য নিজের পেটে ছুরি বসাতে দ্বিধা করছে না সে। তবে এটা সত্য, সে নিজেও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এর মধ্যে মেঝেতে পড়ে গেছে পিয়া। এক হাতে সে লিমনের পা টেনে ধরেছে। লিমন অবশ্য পা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে গেল কফিনের কাছে। চোখে এখন সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। আর দেরি করল না। হাত দিয়ে খুলে দিল ইমার পায়ের আংটার হুক। তারপর ঢাকনাটা উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তাতে মুক্ত হয়ে গেল ইমা।

এদিকে লিমনের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে পিয়া। মুখ দিয়ে কমড়ে ধরেছে তার হাত। লিমন নাছোড়বান্দা। ছুরিটা এবার পাশ থেকে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিল সে। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠল পিয়া। তারপর গড়িয়ে পড়ল পাশে। ছুরিটা টান দিয়ে বের করে আনার চেষ্টা করেও পারল না লিমন। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে ব্যথা অনুভব না করলেও রক্ত ঠিকই ঝরছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার অবস্থা সংকটাপন্ন।

ইমার মুখটা দেখতে পাচ্ছে লিমন। ইমা উঠে দাঁড়িয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে ভীত চোখে। লিমন মিষ্টি করে হাসাল। তারপর বিড় বিড় করে বলল, ‘আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম ইমা, কিন্তু পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করো।’ এরপর হঠাৎই ইমার মুখটা হারিয়ে গেল তার চোখের সামনে থেকে। এখন শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।

ইমা বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিল লিমনের দিকে। লিমনের চোখ দুটো স্থির হয়ে গেলে সে ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় এখন কেউ নেই। একটা কুকুর শুধু তার পিছু নিল

পুলিশ পিয়া নৃত্য স্কুল থেকে মোট চারটি লাশ উদ্ধার করে। তিনজন নারীর আর একজন পুরুষের। তবে তাদের মৃত্যু রহস্য এখনো উদ্ঘাটন করতে পারেনি। আর পারেনি অদ্ভুত এক কফিনের রহস্যের কিনারা করতে যার নিচের দিকে দুটো আংটা লাগানো ছিল। সব রহস্য ভেদ করা যেত যদি কিনা ইমা কথা বলতে পারত। তাকে পুলিশ উদ্ধার করে নদীর পাশ থেকে। সে কোথায় গিয়েছিল কিংবা কার কাছে গিয়েছিল তাও কেউ জানে না। তীব্র ভয়ে ইমা স্মৃতিশক্তি এবং বাকশক্তি দুটোই হারিয়ে ফেলেছে। এমন কী কিছু লিখতেও পারে না। এজন্য পুরিলশ কোনো তথ্য পায়নি। তবে ‘রক্তপ’রা থেমে থাকেনি। তাদের রক্তপান এখনো চলছে। তবে কখন কোথায় তারা রক্তপান করে তা কেউ জানে না। কোনোদিন জানতে পারবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়।

রচনাকাল, ঢাকা – ১৪.০২.২০১৭ – ১৪.০৪.২০১৭

.

(প্রুফ ও এডিট পূর্ববর্তী কপি)

মোশতাক আহমেদ

জন্ম ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৫, জেলা ফরিদপুর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট থেকে এম ফার্ম ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ এবং ইংল্যান্ডের লেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ক্রিমিনলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি একজন চাকরিজীবী। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে,

সায়েন্স ফিকশন : গামা, অমর মানব, প্রজেক্ট ইক্টোপাস, লালমানব, রোবটিজম, লাল শৈবাল, নিলির ভালোবাসা, নিঃসঙ্গ জিরি, দ্বিতীয় পৃথিবী, গিটো, প্রজেক্ট হাইপার, নিকি, নিরি, রিরি, লাল গ্রহের লাল প্রাণী, বায়োবোট নিওক্স, গিপিলিয়া, গিগো, ক্রিকি, সবুজ মানব, অণুমানব, রোবটের পৃথিবী, নিহির ভালোবাসা, ক্রি, রোবো, পাইথিন, ক্লিটি ভাইরাস, লিলিপুটের গ্রহে। সায়েন্স ফিকশন রিবিট সিরিজ : রিবিট, রিবিট ও কালো মানুষ, রিবিট এবং ওরা, রিবিটের দুঃখ, শান্তিতে রিবিট, রিবিটের জীবন, হিমালয়ে রিবিট, রিবিট ও এলিয়েন নিনিটি, রিবিট ও দুলাল, এক ব্যাগ রিবিট।

প্যারাসাইকোলজি : স্বপ্নস্বর্গ, ছায়াস্বর্গ, মন ভাঙা পরি, নীল জোছনার জীবন, বৃষ্টি ভেজা জোছনা, জোছনা রাতের জোনাকি, মায়াবী জোছনার বসন্তে।

শিশিলিন কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ : ডাইনোসরের ডিম, লাল গ্যাং, জমিদারের গুপ্তধন, হারানো মুকুট, কালু ডাকাত, কঙ্কাল ঘর, লালু চোর, ডলার গ্যাং, খুলি বাবা, কানাদস্যু। সামাজিক ও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস : নক্ষত্রের রাজারবাগ, জকি, লাল ডায়েরি, শিকার। ভ্রমণ উপন্যাস : বসন্ত বর্ষার দিগন্ত

কিশোর উপন্যাস : ববির ভ্রমণ, মুক্তিযোদ্ধা রতন।

ভৌতিক উপন্যাস : রক্তনেশা, রক্তসাধনা, প্রতিশোধের আত্মা, ইলু পিশাচ, অশুভ আত্মা, আত্মা, কালা পিশাচ, অভিশপ্ত আত্মা, উলু পিশাচের আত্মা, শয়তান সাধক চিলিকের আত্মা, রক্ত পিপাসা, রক্ততৃষ্ণা, প্রেতাত্মা, অতৃপ্ত আত্মা।

লো অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ : লো, নরেন্দ্র জমিদারের যুগে, জংলীর দেশে, রাক্ষসের দ্বীপে, দূর গ্রহের নিগি, রোবটের যুগে।

পুরস্কার : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক ২০১৮, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮, কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার ২০১২, চ্যানেল আই সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার- ২০১৫, ছোটোদের মেলা সাহিত্য পুরস্কার-২০১৪।