১০. ধিরি ধিরি মিঠি মিঠি হেসে । মহাশূন্যে পরান মাস্টার

১০

ধিরি ধিরি মিঠি মিঠি হেসে চলেছে মেয়েটি, আমি আর পালাবার পথ পাইনে। একেবারে নলের ভেতরে বন্দি, মসৃণ ঝকঝকে দেয়াল, নিপাট নিশ্ছিদ্র, দরোজা জানালা কিচ্ছু নেই, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম নেই, আমি পাগলের মতো ছোটাছুটি করছি। বেরুবার পথ পাইনে, আবার যেদিকেই যাই মেয়েটিকে আড়ালে রাখতে পারিনে— সমুখেই দেখি সে বিছানায় আধো শুয়ে আছে।

আমি তখন অধোবদনে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।

কোকিলার মতো সুরেলা গলায় মেয়েটি কথা কয়ে উঠল, পরান, তুমি কি বিরক্ত হয়েছ? সেই পুরনো কাণ্ড আর কী। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেছি, তিনি তাদের গ্রহের হিসেবে বুঝে নিয়েছেন বিরক্ত হয়েছি। মাথা নাড়ালাম। আর সেটাই এক মহাভুল হয়ে গেল। মেয়েটি বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আমার হাত ধরল তখন।

বলল, তাহলে?

তাকিয়ে দেখি, মেয়েটির মুখে সবুজ আলো খেলা করছে। বুঝলাম লাজে রাঙা হয়েছেন দেবীটি।

কোকিল আবার কথা কয়ে উঠল, আমার নাম তীবযু?

এই বলে হাত ধরে সে আমাকে বিছানার ওপর বসাল। বসতেই হলো কারণ সেই নলের মধ্যে আর কোনো আসবাব নেই, আমারও পা থরথর করে কাঁপছিল; অজানা রমণীর বিছানাতেই আশ্রয় নিতে হলো।

তীবযু আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, আমাকে তোমার পছন্দ হয় নি?

আমি চুপ করে রইলাম অধোবদন বজায় রেখে।

তীবযু আমার চিবুক ধরে বলল, আমার দিকে তাকাতেও তোমার ইচ্ছে করছে না? আমি কি তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে খুবই কুৎসিত? তুমি কি জানো এই বীথিপৃতে আমি এবার মিস বীথিপৃ হয়েছি? তার অর্থ বোঝ? আমি বীথিপৃর সেরা সুন্দরী। আর সে জন্যেই তানেহাম আমাকে স্মরণ করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ যে স্বয়ং তানেহামের একটি পরীক্ষার কাজে আমি লাগতে পারছি। তানেহামের সেবা যে করে সে মহাগৌরবের অধিকারী হয়, তার মুখের প্রতিকৃতি কম্পিউটার যন্ত্রে অনন্তকালের জন্য রক্ষিত হয়। তোমাদের পৃথিবীতেও তো এই ব্যাকুলতা আছে, মানুষ কৃতী সাধনের চেয়ে আপন মুখের প্রতিকৃতি সংরক্ষণে বেশি যত্নবান হয়। তুমি আমাকে তোমার অবহেলা দ্বারা এই অমরত্বের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে, পরান?

একটা বিষম দায়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমাদের বয়সকালে শিক্ষা পেয়েছিলাম, কখনোই কোনো রমণীর মনে আঘাত দেবে না। আবার এদিকে, আঘাত না দিতে হলে যে কাজ এখন করতে হয়, সেটা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। পাঁচ সন্তানের পিতা হয়েছি, এখনো আরও দুচারটি জন্ম দিতে পারি, কিন্তু পাপ কখনো করি নি! পৃথিবীতে যা করি নি এই বীথিতে এসে তাই করা যায়?

আগেই বলেছি, এ গ্রহের ষ্যনুমেরা আবার অপরের মনের কথা পরিষ্কার দেখতে পায়; ভাষায় কিছু বলতে হয় না।

তীব বলল, তুমি ইতস্তত, করছ কেন? অপরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা কি তোমাদের পৃথিবীতে অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত নয়?

হাঁ, তা বটে। তবে দৃষ্টান্তটি অনুমোদনযোগ্য হতে হবে।

অনুমোদনযোগ্য? কার অনুমোদন? তোমার।

আমি ইতস্তত করি।

তীব আমার দিকে মোহিনী চোখ মেলে বলল, কথা বলছ না, কারণ, তুমি জান তোমার অনুমোদনের কোনো মূল্য নেই। আসলে, পৃথিবীতে সমাজ যা অনুমোদন করে সেটাই আদর্শ, সেটাই অনুসরণযোগ্য, তাই নয়?

হাঁ, তাই বটে। আমি উৎসাহের সঙ্গে এবার বলে উঠলাম, আমার সমাজ এটা অনুমোদন করবে না, তীব। ফিরে গেলে আমি তাদের মুখ দেখাতে পারব না।

কী যে বল। তীবযু ভঙ্গি ধরে বসে রইল, যেন আমি মহামুর্খের মতো একটি কথা বলে ফেলেছি। অচিরে সে আবার আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে এল, আমি সরে বসতে গেলাম, নলের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আড় হয়ে পড়লাম, প্রায় আমার গায়ে গা চেপেই তীবয়ু বলে উঠল, তোমাদের নামি দামি মানুষেরা মুখ দেখায় কী করে? বিদেশ থেকে ফিরে এসে?

অর্থাৎ?

আহ, প্রশ্ন কোর না, পরান। প্রশ্ন করবার দরকার নেই। আমি বলে যাচ্ছি, তুমি শোন- তোমার সমাজে যে দৃষ্টান্ত আছে, তোমাকে তাই অনুসরণ করতে বলা হচ্ছে, এর বেশি কিছু নয়। পৃথিবীতে, বিশেষ করে তোমার স্বদেশ বাংলাদেশে এটা নতুন কিছু নয় যে, বিদেশ গিয়ে বিবাহ ব্যতিরেকে যুবতীর সঙ্গে মিলিত হওয়া। আমরা এমন সংবাদও রাখি যে, তোমার স্বদেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি বিদেশে নিতান্ত বুভুক্ষু হয়ে পড়েন, নৈশ মিলন কেন্দ্রগুলোতে যান এবং স্বদেশে ফিরে এসে বেমালুম তা চেপে যান। তারা যা অনবরত পারেন, তুমি কেবল একটি বারের জন্যে তা পারবে না? তুমি মনে কর না কেন, যে, তুমি বীথিপৃতে নয়, ব্যাংকক অথবা প্যারিসে এসেছে? হাঁ, তুমি ভেবে দ্যাখ, পরান আমি কোনো নতুন কথা তুলি নি। এবং এই সঙ্গে এটাও তোমার ভাবনায় এনে দেই যে, তুমি নিতান্ত স্ফুর্তির জন্যে নয়, এক উন্নত গ্রহের সম্রাটের অনুরোধ রক্ষার জন্যে আমার প্রতি অগ্রসর হবে। তোমাদের পৃথিবীতে তো কর্তাব্যক্তিদের অনুরোধ রক্ষা, যত অন্যায়ই হোক, বড় পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়, আর এ ক্ষেত্রে তো একটি গ্রহের সর্বময় প্রভু স্বয়ং অনুরোধ করছেন। হাঁ, তবে তোমার বাংলাদেশে তোমরা বড় সাহেবের অনুরোধ রক্ষা করে কিঞ্চিত পুরস্কার পাও, এ ক্ষেত্রেও আমি অঙ্গীকার করছি যে তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে। বাংলাদেশে যেমন সে পুরস্কারটি তোমরা গোপন রাখ, ইচ্ছে হলেই আমাদের পুরস্কারটি তুমি গোপন রাখবে। অথবা প্রকাশ করতে পার, কারণ বীথিতে যে পুরস্কার করতলগত হয়েছে তার দরুন স্বদেশে তোমাকে দুর্নীতি দমন বিভাগে আসামি হয়ে হাজির হতে হবে না। তোমরা তো বিদেশের কমিশন উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করে থাক; এবং আমরা জানি, স্বদেশের এহেন উপার্জনের চেয়ে বিদেশের উপার্জন তোমাদের ওখানে বিশেষ সম্মানজনক। তুমি কেন ইতস্তত করছ? এখন দেখতে পাচ্ছ তো, যে, তুমি বস্তুত সমাজের অনুমোদিত পথই অনুসরণ করছ?

আমি ভ্রূ তুলে বসে রইলাম।

তীব বলল, তোমাদের মতো আমার ভ্রূ থাকলে আমিও এখন ভ্রূ তুলে তোমাকে দেখতাম যে, তুমি কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হতে পার।

আমি ভ্রূ নামিয়ে নিলাম।

তীবয়ু সেটাকে আমার নরম হবার ইঙ্গিত বলে মনে করল কি-না জানি না; তবে সে রকম মনে করবার কথা নয়, কারণ এরা মনের কথা নিমেষে টের পেয়ে যায়। অথচ তীবয়ু এখন যা বলল তাতে বোঝা গেল যে সে ধারণা করেছে আমি সম্মত হয়েছি— তবে কি আমিই আমার মন বুঝতে পারছি না?— তীর এখন বলল, তবে আর দেরি করে কী হবে? তোমারও ফিরে যাবার আছে। আমিও মিলিত হবার পরই পরীক্ষাগারে দশ মাস দশ দিনের জন্যে প্রবেশ করব। তানেহাম অধীর অপেক্ষা করেছেন। তার বিশ্বাস সৎ পুরুষ দিয়ে যে সন্তানের জন্ম হবে, তার ভেতরে ধর্মবোধ পরিলক্ষিত হবে। তার এই পরীক্ষা যদি সফল বলে প্রমাণিত হয়, আমি আদি মাতা বলে এই বীথিতে স্বীকৃত হব এবং সে পরিস্থিতিতে আমার কেবল প্রতিকৃতিই নয়, আমার ত্রিমাত্রিক প্রতিমূর্তিও অমর কম্পিউটার যন্ত্রে সংরক্ষিত হবে; ভবিষ্যৎ বংশধরেরা কম্পিউটারের বোতাম টিপলেই আমাকে জ্বলজ্যাস্ত দর্শন করতে পারবে। তোমাদের পৃথিবীর মতে আমিও ভবিষ্যতে দেবী রূপে পূজিত ভজিত হবার আশা করছি।

তীবযু লীলাভরে আমাকে আকর্ষণ করল। তার কাঁঠালি চাঁপার মতো গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে জোর সামলে নিলাম। তীবযু ঈষৎ রক্তাভ হয়ে উঠল।

আমি করজোড়ে বললাম না তীবযু, তুমি আমার দুলির মতো।

দুলি কে?

আমার বড় মেয়ে। বড় দুঃখী মেয়ে। অবশ্য তোমাকেও আমি দুঃখী বলে মনে করছি না। আমি কেবল বলছি যে, তুমি আমার মেয়ের মতো, আমার পক্ষে এ সম্ভবই নয়।

তীবযু তিরস্কার করে বলল, শিক্ষক হয়েও তুমি যুক্তিবিজ্ঞানের কিছুই জান না, দেখছি।

মেয়ের মতো আর মেয়ে— এক কথা নয়।

তানেহাম যে কেন পাশের ঘর বলেছিল এবার মর্মে টের পেলাম— এ যে মহা ফাঁদ এবং সেই ফাঁদে পাশবদ্ধ পরান মাস্টার জলেশ্বরী প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার।

তীবযু আবার বলল, চুপ করে থেকো না।

বললাম, মা, তোমাদের তো অজানা কিছুই থাকে না; আমার মনের কথাটি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ; ভাষায় হয়ত একটু গোলমাল করে ফেলেছি; আর এ জন্যে এখন বেশ প্রশংসাও করছি যে তোমাদের এই নীরবে নিঃশব্দে অপরের মনোভাব পড়ে নেয়াটা বড়ই উপযোগী একটা গুণ, তা সে যাক— তুমি নিশ্চয়ই জান যে, তোমাকে মেয়ের মতো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমি নিজে যে বুড়ো মানুষ সেইটে জানান।

বুড়ো মানুষ?

হাঁ, বাঙালির পঞ্চাশ হলে আর থাকে কী, মা?

বাজে কথা।

আমি চমকিত হয়ে উঠলাম। আবার কী প্যাঁচ দেয়, কে জানে।

তীবযু বলল, তোমার দেশে পুরুষেরা সত্তর পঁচাত্তর বছর বয়সেও আবার ষোড়শী বিয়ে করছে; জন্মনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলোর কর্মচারীরা আশি বছরের বুড়োকেও ধরে এনে ভ্যাসেকটমি করে ছেড়ে দিচ্ছে।

আমি অধোবদন হয়ে রইলাম; লজ্জায় নয়, রীতিমতো ভয়ে। আর নিস্তার নেই।

তীবযু তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, ঢং।

আমি একেবারে দেশের স্বাদ পেয়ে থ’ হয়ে গেলাম।

কি? রাজি?

মনের খবর এরা রাখে, আমার উত্তর দেবার দরকার নেই। হঠাৎ দৈববাণী হলো, অতিথির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে না। মনে হলো তানেহামেরই কণ্ঠস্বর। আবার শোনা গেল, প্রায় খেদেক্তি একটি, ‘রমণী যে-কোনো সূর্যের যে-কোনো গ্রহের রমণীই রয়ে গেল।’ কণ্ঠস্বর উধাও হয়ে যাবার পরও কিছুক্ষণ সুমসুম একটা শব্দ হতে লাগল, তারপর তাও থেমে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো ঘর, ঘর নয়, নল।

নলের মধ্যে আবার সেই আমি আর তীবযু।

তীবযু হেসে বলল, রাগ করো না। নিজেকে বুড়ো ভাবছ, মোটেই তুমি বুড়ো নও। আয়নায় দ্যাখ, তুমি যুবক।

পঁচিশ বছর আগের সেই মুখখানা আবার দেখতে পেলাম নলের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে আছে। ধবধবে পাঞ্জাবি পাজামা একেবারে নতুন জামাইর মতো লাগছে দেখতে : নলের প্রতিফলনের পাশে তীবয়ু মুখ এনে বলল, এতই যদি আপত্তি, নিজের বউ হলে তো আপত্তি নেই?

কথাটি ঠিক ধরতে না পেরে, প্রতিফলন ফেলে মানুষটিকেই সরাসরি তাকিয়ে দেখবার জন্যে যেই মুখ ফিরিয়েছি, দেখি, কোথায় তীবযু?– বিয়ের কনে চান বড়ু আমার সম্মুখে লাল চেলিতে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই পঁচিশ বছর আগের মতো।