মন জোছনার কান্না (প্যারাসাইকোলজি থ্রিলার)

Table of Contents
-----

মন জোছনার কান্না / মোশতাক আহমেদ / প্যারাসাইকোলজি থ্রিলার
প্রথম প্রকাশ : মাঘ ১৪২৮ জানুয়ারি ২০২২

.

উৎসর্গ

মোঃ মতিয়ার রহমান।

বয়সে আমার থেকে ছোট, তুমি করেই বলি। ফেসবুকে তার সাথে আমার পরিচয়। আমার বই পড়ে। তার কাছ থেকে শুনলাম, ‘নিহির ভালোবাসা’ বই পড়ে সে ঐ বইটি এক পাঠিকাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল। ঐ বইয়ের ভালোলাগা এবং আলোচনার সূত্র ধরে দুজনের পরিচয় এবং তারপর পরিণয়। বইয়ের ভালোবাসা রূপান্তরিত হয় সংসার জীবনের বাস্তব ভালোবাসায়। বই বন্ধন সৃষ্টি করে, বন্ধন বজায় রাখে, অনুভব করে বড় ভালো লাগল আমার। আমি এতটাই অভিভূত ছিলাম যে, তাকে আমি আমার অন্যতম প্রিয় সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ‘দ্যা নিউ ওয়ার্ল্ড’ এর মোড়ক উনোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আর হ্যাঁ, আমন্ত্রণ জানাবই বা না কেন, তার মতো বইপাগল মানুষ যে বড় বিরল! তার কাছে আমার আশিটির উপর বই আছে এবং সবকটিই সে পড়েছে। অনেক অনেক শুভ কামনা মোঃ মতিয়ার রহমান। সাথে এক মহাকাশ ভালোবাসা। যদি পারতাম, তাহলে আপনাকে আর আপনার প্রিয়জনকে একদিন ‘নিহির ভালোবাসা’ উপন্যাসের লিপিল গ্রহে নিয়ে যেতাম। জীবন হোক সুন্দর, আনন্দের, ভালোবাসার এবং বইয়ের।

.

লেখকের কথা

প্যারাসাইকোলজি উপন্যাসের একটা সমস্যা হচ্ছে অনেকে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বাস করতে চান না। তারা বলেন অবাস্তব, অবিশ্বাস্য কাহিনি, তবে দারুণ উপভোগ্য। আমি বলি ঘটনাটা অবিশ্বাস্য বলেই উপন্যাসটা প্যারাসাইকোলজি ঘরানার। যাইহোক, উপন্যাসটা পাঠকের কাছে উপভোগ্য হলেই আমি সন্তুষ্ট। আর হ্যাঁ, এই উপন্যাসে ইকবাল নামক একটি ছেলের Supernatural ক্ষমতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ইচ্ছে করেই দেইনি। কারণ ইকবালের মতো চরিত্র নিয়ে পরে আরেকটি প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস লিখব। পাশাপাশি এটা সত্য যে, উপন্যাসে কিছু লাইন এবং গানের কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। উপন্যাসের স্বার্থে এই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। সত্যি কথা বলতে কি, পাঠকদের আমি প্যারাসাইকোলজির এমন এক কাল্পনিক জগতে নিয়ে যেতে চাই যেন সমাধান খুঁজতে তারাই ডাক্তার তরফদার হয়ে হারিয়ে যেতে থাকেন অদেখা প্যারাসাইকোলজির অজানা রহস্যে। আর হ্যাঁ, উপন্যাসটির প্রথমে নাম রেখেছিলাম ‘স্বপ্নছায়া’। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখি ‘মন জোছনার কান্না’। কারণ কী জানি না। আসলে প্যারাসাইকোলজির জগতে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা থাকে না। উপন্যাসের এই নাম পরিবর্তনেরও কোনো ব্যাখ্যা নেই হয়তো। শুভ কামনা এবং সবার জন্য এক মহাকাশ ভালোবাসা।

রচনাকাল : ঢাকা, ১৫.০৬.২০২১– ১৬.০৮.২০২১

.

ডাক্তার তরফদার পরিচিতি

প্রফেসর তরফদার একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার। সবাই তাকে চিনে ডাক্তার তরফদার নামে। পেশাদারি জীবনের পুরোটাই তিনি মানসিক হাসপাতালে মানসিক রোগীর চিকিৎসা প্রদান করে কাটিয়েছেন। অবসরের পর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত পুরাতন আমলের বিশাল দোতলা বাড়িতে থাকেন। বাড়িতে তার সঙ্গী বয়স্ক করিম চাচা। করিম চাচা অসাধারণ ইএসপি (Extra Sensory Perception) ক্ষমতার অধিকারী। ডাক্তার তরফদারের কাছে যেসব রোগী আসে তাদের মধ্যে কিছু কিছু রোগীর কেইস হিস্ট্রি বড় রহস্যময় হয়। রহস্যময় এসব কেইস হিস্ট্রি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রচিত হয়েছে ডাক্তার তরফদার প্যারাসাইকোলজি সিরিজ।

***

ছোট্ট একটা টিনের ঘর। ভিতরে একজন মানুষকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার দুই হাতে শিকল, শিকল তার কোমরেও। মানুষটার নাম হামিদ। আজ প্রায় বিশ বছর ধরে সে এই ঘরে আছে।

ডাক্তার তরফদার হামিদের ঘরে প্রবেশ করলেন। হামিদ মাদুরের উপর দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে। হাত দুটোকে এমনভাবে পেট আর হাঁটুর মাঝে রাখা, দেখে মনে হবে বুঝি শীতে কষ্ট পাচ্ছে খুব। অথচ ঘরের বাইরে এবং ভিতরে বেশ গরম।

ডাক্তার তরফদার মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো হামিদ?

হামিদ কোনো কথা বলল না।

শরীর কেমন তোমার?

হামিদ চোখ বড় বড় করে ডাক্তার তরফদারের দিকে তাকাল যেন খুব বিরক্ত সে।

ডাক্তার তরফদার হামিদের জন্য ডালিম নিয়ে এসেছেন। একটা বাটিতে ডালিমটা রেখে এগিয়ে দিলেন হামিদের দিকে। হামিদ ছোঁ মেরে নিল ডালিমটা। তারপর দাঁত দিয়ে কামড়ে উপর থেকে খানিকটা অংশ আলাদা করে ফেলল। তাতে বেরিয়ে এলো ডালিমের লাল রঙের কোয়া। মুখে দিয়েই কাঁদতে শুরু করল। এমন কান্না, যে কেউ দেখলে খুব মায়া অনুভব করবে হামিদের জন্য। ডাক্তার তরফদার এই মায়ার টানেই বারবার আসেন হামিদের কাছে।

ডাক্তার তরফদার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই বাঁশির একটা করুণ সুর শুনতে পেলেন। হামিদই বাজাচ্ছে বাঁশি। সুরটা হলো সেই গানের,

প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।

***

জেসমিন অনুভব করছে রেইনবো রেইন হোটেলে তার কক্ষে কেউ একজন। প্রবেশ করেছে। কারণ একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছে সে। কার ছায়া ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে যে প্রবেশ করেছে সে পুরুষ। পোশাকটা পায়জামা-পাঞ্জাবিই মনে হচ্ছে। কক্ষের মধ্যে হালকা লাল আলো। স্পষ্ট হচ্ছে না চেহারা, ছায়ার চেহারা আসলে স্পষ্ট হয় না। এত রাতে হোটেলে তার কক্ষে প্রবেশের কারো কোনো অধিকার নেই। নিজের বিপদ অনুধাবন করছে সে। এই কক্ষটিতে সে একা, তার বান্ধবী ইলা ছিল গতকাল। ইলার আম্মা হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় চলে গেছে আজ। তখন সে একা হয়ে পড়ে। ভয় ভয় করছিল প্রথমে। স্টাডি ট্যুরের সমন্বয়কারী শিক্ষক রাবেয়া খাতুন নিজেই থাকতে চেয়েছিলেন তার সাথে। শিক্ষকের সাথে থাকলে অস্বস্তিতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় একা থাকারই সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে।

রাত কয়টা বাজে অনুমান করার চেষ্টা করল জেসমিন, কিন্তু পারল না। তার মনে আছে সাড়ে এগারোটার সময় শুয়ে পড়েছিল। ঘুমানোর আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেসবুকে কয়েকটা ছবি আপলোড করে। তারপর ঘুম

আসায় পড়তে শুরু করে ‘আনন্দভ্রমণ” নামক বই। ছবি দিয়ে ভরা ছিল বইটি। ছবিগুলো দেখতে আর ছবির নিচের লেখাগুলো পড়তে ভালো লাগছিল তার। ঐ বই পড়তে পড়তেই সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার কারণটা সে ঠিক বের করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে কি ঐ ছায়াই তার ঘুম ভাঙিয়েছে? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করল। কিন্তু উত্তর পেল না।

জেসমিন ঠিক বুঝতে পারছে না কীভাবে ছায়াটা তার কক্ষে প্রবেশ করল। ঘুমানোর আগে দরজা নিজে বন্ধ করেছে সে। জানালায় মোটা লোহার শিক। কোনো মানুষের পক্ষে আসা সম্ভব না। তাছাড়া বাইরে পাহারা আছে। হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো। সেক্ষেত্রে কীভাবে সম্ভব হলো একটা ছায়ার ভিতরে আসা?

ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে জেসমিন। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছায়াটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। হুবহু মানুষের মতো অবয়ব। তবে চোখ-মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভূত-প্রেত কি না ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে ভূত-প্রেত বলতে যে কিছু নেই সে জানে। সেক্ষেত্রে ছায়াটা কীভাবে এখানে এলো ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকছে না। তবে ছায়ার মতলব যে ভালো না অনুধাবন করছে সে। কারণ ছায়াটা এখন একেবারে খাটের কাছে চলে এসেছে।

জেসমিন উপলব্ধি করছে তার এখন চিৎকার করা উচিত। কিন্তু কেন যেন চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে না। বরং ইচ্ছে করছে দেখতে কী করে ছায়াটা। ভয়ও করছে। কাঁপতে শুরু করেছে শরীর। কী অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি! কেন যেন মনে হতে লাগল, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে, নিয়ন্ত্রণটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ছায়ার কাছে।

ছায়াটা এসে বসল একেবারে তার পাশে, খাটের উপর। তারপর একটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল তার ঠোঁট। মুহূর্তেই যেন ভয়টা চলে গেল জেসমিনের। ভালোলাগার ভিন্ন এক আবেশে ভরে উঠল মনটা। এই ভালোলাগার আর-একটা কারণ হলো ছায়াটাকে সে চিনতে পেরেছে, ছায়ার চোখ মুখ নাক দেখা যাচ্ছে এখন। তবে অনেকটা মূর্তির মতো যেন। তারপরও অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার হাডসনই হবেন।

ডাক্তার হাডসনকে সত্যি মূর্তি মূর্তি লাগছে। তবে তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন। ঝুঁকে এসে তার কানের কাছে স্পষ্ট বাংলায় বললেন, কেমন আছো জেসমিন?

জেসমিন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু কাঁপতে থাকল ঠোঁট দুটো।

তুমি আমার কাছে এসেছ, তাই না?

জেসমিন নিশ্চুপ।

আগামীকাল তমি আমার আরো কাছে আসবে, আমি জানি। যদি সত্যি তুমি আমাকে চাও, আগামীকাল আমাকে স্পর্শ করবে। তাহলেই আমি চিরতরে তোমার হয়ে যাব।

ডাক্তার হাডসনের শ্বাস-প্রশ্বাসের উত্তাপ অনুভব করছে জেসমিন। ডাক্তার হাডসন তার মুখটা আরো খানিকটা নামিয়ে এনেছেন। তার ঠোঁটের একেবারে সামনে এখন ডাক্তার হাডসনের ঠোঁট, একটা হাত স্পর্শ করেছে শরীর। তবে চেহারা সেই মূর্তির মতোই।

বিড়বিড় করে ডাক্তার হাডসন বললেন, তুমি সুন্দর জেসমিন, অপূর্ব সুন্দর!

জেসমিনের উচিত এখন ডাক্তার হাডসনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া। কিন্তু এই উচিত কাজটি তার করতে ইচ্ছে করছে না। উলটো ভালো লাগছে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতি, তার স্পর্শ, তার তপ্ত নিঃশ্বাস।

জেসমিন অনুভব করল তার নিজের মুখের উপর কয়েকটা চুল আছে, সরিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। কেমন যেন সুড়সুড়ি কাটছে মুখে। জেসমিনের এই ভাবনা যেন বুঝতে পারলেন ডাক্তার হাডসন। হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন চুলগুলো। তারপর প্রথমে খুব আলতোভাবে, পরে গভীরভাবে চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে। জেসমিনের ঠোঁট দুটো এখন ডাক্তার হাডসনের ঠোঁটের মধ্যে। দারুণ এক শিহরন অনুভব করছে জেসমিন। আগে কোনোদিন কোনো পুরুষ তাকে চুমু দেয়নি। আজই প্রথম, এই প্রথম জীবনে প্রথম! পুরুষের স্পর্শ একজন নারীর জন্য যে কতটা শিহরনের আর ভালোলাগার, কল্পনাও করতে পারেনি আগে। মনে হচ্ছে, ভালোলাগার এই আবেশে পূর্ণতা আনতে ডাক্তার হাডসনকে সে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পারছে না। শরীরে একটু শক্তিও নেই। ডাক্তার হাডসন যেন চেতনানাশক দিয়ে তাকে অবশ করে রেখেছেন, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন তার শরীরের। এখন সে ভেসে বেড়াচ্ছে ডাক্তার হাডসনের ভালোবাসার আবেগে। তার শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ উপভোগ করছে ভালোবাসার আনন্দ। এক জোড়া নর-নারীর পরস্পরের কাছে আসা, পরস্পরের ঐকান্তিক ভালোবাসার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া যে এতটা স্বর্গীয় বাস্তবে উপভোগ না করলে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।

একসময় দুজনই নিস্তেজ হয়ে এলো। একটু সময় নিয়ে ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আ…আগামীকাল থাকবে লাল শাড়িতে, অপেক্ষায় থাকব তোমার স্পর্শের, প্রিয়তমা আমার।

কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার হাডসন। কক্ষটা এখন লাল আলোয় উদ্ভাসিত। সেই আলোর মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জেসমিন অস্থির হয়ে উঠল, সে যেতে দিতে চাচ্ছে না ডাক্তার হাডসনকে। তাই সিদ্ধান্ত নিল ডাক দেবে। কিন্তু পারল না। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। শরীর যেন এখনো অবশ হয়ে আছে। তবে ভালোলাগার একটা দারুণ অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত মন আর শরীরে।

জেসমিন, জেসমিন…

কেউ একজন ডাকছে।

জেসমিন, জেসমিন!

এবার দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পেল জেসমিন, গলার স্বরটা তার বান্ধবী শান্তার। উঠে বসতে আবার দরজায় টোকার শব্দ হলো। ঘড়ি দেখল জেসমিন, সকাল পাঁচটা।

দরজা খুলতে শান্তা বলল, সমুদ্রপাড়ে যাবি না? সূর্যোদয় দেখবি বলেছিলি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

তাড়াতাড়ি চল তাহলে। অন্যরা নিচে নেমে গেছে। আমি আসছি।

শান্তা চলে গেলে বারান্দায় এলো জেসমিন। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। অপূর্ব লাগছে দেখতে। কিন্তু তার মন যেন হারিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার হাডসনের এই কক্ষে প্রবেশের ঘটনার মধ্যে। যদিও সে বুঝতে পারছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ছিল শুধুই স্বপ্ন, তারপরও তার মনে বলছে কোথাও যেন সত্যতা আছে। তার জীবনে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতি একেবারে মিথ্যা হতে পারে না।

*

জেসমিন হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিল। যখন বাইরে বের হবে তখন নজর পড়ল খাটের উপর পড়ে থাকা ‘আনন্দভ্রমণ’ বইটির উপর। বইয়ের যে পাতা খোলা রয়েছে সেখানে ডাক্তার হাডসনের একটি ছবি দেখা যাচ্ছে। রাতের স্বপ্নের ডাক্তার হাডসন আর ‘আনন্দভ্রমণ’ বইয়ের ডাক্তার হাডসন একই ব্যক্তি। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে বইটিতে। গতকাল পড়ে শেষ করতে পারেনি। সিদ্ধান্ত নিল আজ ফিরে আসার পর পড়বে।

সমুদ্রের পাড়টা সত্যি সুন্দর লাগছে জেসমিনের। আগে কখনো সে সমুদ্রে আসেনি। এই প্রথম। তাও তার বাবা আসতে দিতে চাননি। অনেকটা জোর করে এসেছে সে, কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রাবেয়া খাতুনকে কথা বলতে হয়েছে তারা বাবার সাথে। স্টাডি টুরের এই সুযোগ আর পাবে না, তাই কিছুতেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি সে। সে পড়াশুনা করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা মডেল কলেজে। এখানে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। ক্লাসে মোট ষাটজনের মতো ছাত্র ছাত্রী আছে। ক্লাস থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কক্সবাজার ভ্রমণের। মোট ত্রিশজন এসেছে তারা। এগারোজন মেয়ে আর ষোলোজন ছেলে, শিক্ষক এসেছেন তিনজন। তাদের ক্লাসের মোট বাইশজন এসেছে। গাড়িতে সিট বেশি থাকায় পরে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার থেকে নেয়া হয়েছে পাঁচজনকে। চট্টগ্রামে অবস্থান করেছে একদিন। ঘুরে দেখেছে পতেঙ্গা, ইপিজেড আর চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেটেরি। গতকাল তারা এসেছে কক্সবাজারে। আজ এবং আগামীকাল থেকে ফিরে যাবে পরশুদিন। এখন পর্যন্ত ভালো লাগছে জেসমিনের। বুঝতে পারছে স্টাডি টুরে না এলে বড় ভুল হয়ে যেত।

সকালের সমুদ্র দেখে দারুণ ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হলো জেসমিনের মধ্যে। সমুদ্র যে এত সুন্দর এখানে না এলে বুঝতে পারত না। সকাল আটটা পর্যন্ত তারা সমুদ্র তীরে থাকল, বালু নিয়ে খেলল, ছবি তুলল, অনেক অনেক মজা করল। তারপর এলো নাস্তা খেতে। শান্তা বসেছে তার সামনে। বলল, কীরে জেসমিন, ঘুম হয়েছে কেমন রাতে?

ভালো।

একা একা ভয় পাসনি তো?

না। শুধু…

শুধু কী? একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।

শান্তা চোখ কুঁচকে বলল, কীসের স্বপ্ন?

একটা ছায়া।

ছায়া!

থাক, পরে বলব। আজ আমাদের রুটিন কী? মানে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব?

নাস্তা শেষে যার যার কক্ষে চলে যাব। তারপর সাড়ে নয়টার সময় নিচে নেমে আসব। প্রথমে যাব কলাতলী বিচে। তারপর যাব ইনানী বিচ। এখান থেকে নাকি বেশ দূর ইনানী বিচ। মেরিন ড্রাইভ ধরে যেতে হবে। সেখান থেকে হাডসন হিলে।

হাডসন হিলটা কী?

আনন্দভ্রমণ’ বইটা পড়িসনি?

না, শেষ করতে পারিনি। তবে ছবিগুলো দেখেছি।

বইটিতে লেখা আছে। ইনানী বিচের পর বেশ দূরে আর-একটা জায়গা। হাডসন হিল মূলত একটা পাহাড়। ওখানে ডাক্তার হাডসন নামের এক ব্রিটিশ ডাক্তার এসেছিলেন। তার সাথে তার স্ত্রীও এসেছিল। নাম সম্ভবত এলিজা। এলিজার মৃত্যুর পর তিনি থেকে যান ঐ পাহাড়ে। তার নামের সাথে মিলিয়ে পাহাড়টার নাম রাখা হয়েছে হাডসন হিল। ওখানে তার নাকি একটা মূর্তি আছে, ঐ মূর্তিটা দেখতে যাব আমরা। আর যেহেতু জায়গাটা স্মৃতিবিজড়িত, ছবিও তুলব। তবে হাডসন হিল এখনো অতটা পরিচিতি লাভ করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

কথাগুলো শুনছিল আর নিজের মধ্যে অন্যরকম এক শিহরন অনুভব করছিল জেসমিন। গতকাল রাতের স্বপ্নে দেখা ডাক্তার হাডসনের কথা বলছে শান্তা। ঘুমানোর আগে ‘আনন্দভ্রমণ’ বইটিতে ডাক্তার হাডসনের পাথুরে মূর্তির ছবিটা দেখেছিল সে। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ মনে হয়েছিল। একসময় ছবি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে আর স্বপ্নটা দেখে। স্বপ্নটা অপছন্দের হওয়ার কথা, কারণ ডাক্তার হাডসন তার ঠোঁটে চুমু দিয়েছে। এর আগে কখনো কেউ তাকে চুমু দেয়নি। এক্ষেত্রে ডাক্তার হাডসনের উপর তার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু রাগ উঠেনি। বরং ডাক্তার হাডসনের স্বল্পসময়ের উপস্থিতির আনন্দটা ছিল অসাধারণ।

কী ভাবছিস?

শান্তার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলো জেসমিন। বলল, না কিছু না।

অবশ্যই কিছু ভাবছিলি, কী বিষয় বল তো?

প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জেসমিন বলল, তোর কেমন লাগছে, তাই বল।

শান্তা মুখের মধ্যে খানিকটা রুটি ঢুকিয়ে বলল, দারুণ, দারুণ। না এলে কী যে মিস করতাম! আমি আগেও একবার এসেছি কক্সবাজারে। তবে এবারের আসাটা একেবারে অন্যরকম। কারণ সাথে ক্লাসের সবাই আছে।

তুই ঠিকই বলেছিস। এজন্য আনন্দটাও বেশি। বিকেলে কী প্রোগ্রাম?

হাডসন হিল থেকে ফিরে এসে যে যার মতো খেয়ে নেবে। তারপর ফ্রি টাইম, অর্থাৎ ঘোরাঘুরি। তবে রাত আটটার পর বিচে থাকতে নিষেধ করে দিয়েছেন ম্যাডাম। সাড়ে আটটার সময় সকলের হাজিরা নেবেন তিনি, এইখানে। তারপর রাতের খাবার খেতে হবে। আগামীকাল যাব মহেশখালী। ওখানে একটা বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট আর ফিশ প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ভিজিট করব। ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে।

মহেশখালী যেতে হলে তো স্পিডবোটে যেতে হবে, তাই না?

ট্রলারেও যাওয়া যাবে। ট্রলারে সময় কিছুটা বেশি লাগে। আমরা খুব সকালে রওনা দেব। ফিশারি ঘাটে প্রথমে মাছ দেখব। তারপর ট্রলারে উঠব। কক্সবাজার আর মহেশখালীর মাঝামাঝি স্থানে সমুদ্রে নাস্তা করব।

ওয়াও! ভাবতেই দারুণ লাগছে।

আমিও বিশ্বাস করছি বড় আনন্দের হবে টুরটা। চল, উঠি।

চা খাবি না?

শান্তা মাথা নেড়ে বলল, আমি চা খাই না।

কেন?

কালো মানুষ আমি, তোর মতো ধবধবে ফর্সা না। চা খেয়ে আর কালো হতে চাই না।

ভ্রু কুঁচকে জেসমিন বলল, চা খেলে মানুষ কালো হয় কে বলল তোকে? আজ খেয়ে নে, একদিন খেলে কিছু হবে না।

ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস এক কাপ না হয় খেলামই।

কথা বলতে বলতে চায়ের কাপে চুমুক দিল শান্তা।

মিনিট দশেক পর রুমে ফিরে এলো জেসমিন। খাটের উপর ‘আনন্দভ্রমণ” বইটা পড়ে আছে। পাতলা একটা বই। তবে টুরিস্টদের জন্য ভালো, বিশেষ করে যারা কক্সবাজার আসে। কারণ বইটি মূলত কক্সবাজারের টুরিস্ট স্পটগুলো নিয়ে লেখা।

বইটা হাতে তুলে নিয়ে ডাক্তার হাডসনের ছবিটা আবারো দেখল সে। ছবিটা মূলত তার মূর্তির। বিশেষত্ব হলো বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও পায়জামা পাঞ্জাবি পরা ডাক্তার হাডসন। আর চেহারার মধ্যে কেমন যেন মায়া মায়া ভাব আছে। যে কেউ দেখলে পছন্দ করবে মূর্তির ছবিটা। জেসমিন নিজেও অনুভব করল, তার কেন যেন ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে এবং বারবার তাকাচ্ছেও। ছবিটার নিচে লেখা,

ডাক্তার হাডসন ছিলেন একজন পেশাদার ব্রিটিশ ডাক্তার। ১৯৪১ সাল বা কাছাকাছি সময়ে কক্সবাজার এলাকায় আসেন। তার সাথে তার স্ত্রী এলিজাও ছিলেন। জাহাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা কক্সবাজারের মনখালি এলাকায় একটা বড় পাহাড়ের পাদদেশে জাহাজ থেকে অবতরণ করেছিলেন। তার স্ত্রী সাগরে ডুবে মারা যান ওখানে। স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে নীল চোখের ডাক্তার হাডসন আর ইংল্যান্ডে ফিরে যাননি। তিনি যে পাহাড়ের পাদদেশে থাকতেন তার নামে ঐ পাহাড়টির নাম রাখা হয়েছে হাডসন হিল। গ্রামের মানুষদের তিনি ফ্রি চিকিৎসা দিতেন। এজন্য তার সুনাম ছিল। কথিত আছে, অবসর সময়ে তিনি পাথর কেটে কেটে একটা মূর্তি তৈরি করেছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ বলে মূর্তিটি অন্য কেউ তৈরি করেছিল। যাইহোক, পরে তিনি ইংল্যান্ড ফিরে গেছেন। অনেকে বিশ্বাস করে ইংল্যান্ডে মৃত্যুর পর তার আত্মা নাকি প্রায়ই এখানে আসে। সেই আত্মা স্থানীয় মানুষ দেখেছে। অবশ্য এই তথ্যের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

জেসমিন পৃষ্ঠা উল্টে দেখে আর কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে। পরের পৃষ্ঠায় টেকনাফ নিয়ে লেখা। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে হঠাৎই তার কেন যেন জানতে ইচ্ছে করছে। ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসতেন যে স্ত্রীর মৃত্যুর পর রয়ে গেছেন এই দেশে, সত্যি বিস্ময়কর। ডাক্তার হাডসনের যে ভালোবাসায় ভরা একটা মন ছিল, উপলব্ধি করছে জেসমিন! এমন ভালোবাসা কোন নারী না চায়! তার স্ত্রী এলিজা ছিল সত্যিই সৌভাগ্যবান।

*

কলাতলী বিচে বেশিক্ষণ থাকল না জেসমিন আর তার ক্লাসের সবাই। চলে এলো ইনানী বিচে। ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে আসতে। খুবই ভালো লাগল জায়গাটা। সাগরের মধ্যে অনেক কোরাল পাথর। কক্সবাজার বিচে এত সুন্দর পাথর নেই। পাথরগুলোর উপর দাঁড়িয়ে পা ভিজাতে যে কারোরই ভালো লাগবে। তাছাড়া বিচটা বেশ প্রশস্ত। পর্যটকের ভিড়ও কম। অনেকে আবার পানিতে নেমে পড়েছে। সবাইকে ডাক দিলে উঠতে শুরু করল গাড়িতে।

গাড়িতে উঠার সময় রাবেয়া ম্যাডাম বললেন, তুমি শাড়ি পরে এসেছ কেন জেসমিন?

জেসমিন বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, আমি আসলে ম্যাডাম বুঝতে পারিনি।

এটা কোনো কথা হলো! এখানে এমন পোশাক পরা উচিত যেন তুমি সহজে চলাফেরা করতে পার, তার উপর আবার লাল রং।

লাল রঙে ছবি তুললে ভালো আসবে।

ছবি ভালো আসবে কি না জানি না, কিন্তু তুমি তো নামতে পারলে না পানিতে। সবাই কম-বেশি নেমেছে।

গোড়ালি পানিতে নেমেছিলাম। ভালো লেগেছে।

সমুদ্রে এসে যদি পানিতেই না নামো তাহলে আর লাভ কী?

এর পরেরবার নামব ম্যাডাম।

সুযোগ সবসময় আসে না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ, বুঝেছ? এখন থেকে সবসময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। আগে থেকে সবকিছুর পরিকল্পনা করে রাখবে।

জি ম্যাডাম অবশ্য আমার ভালোই লেগেছে।

তুমি সন্তুষ্ট হলেই হলো। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে তুমি ভুল করেছ। যাইহোক, সিটে গিয়ে বসো। গাড়ি ছেড়ে দেবে এখনই।

গাড়িতে বসতে ফোন এলো জেসমিনের। আগে জেসমিনের ফোন ছিল না। কলেজে উঠার পর কিনেছে একটা। প্রথমে তার বাবা কিনে দিতে চাননি। অনেকটা জোর করেই কিনেছে সে। মোবাইল ছাড়া জীবন যেন এখন অচল, তাছাড়া নিজেকে আধুনিক মনে হয় না।

জেসমিন ফোন ধরে দেখল তার মা নিলুফার ইয়াসমিন ফোন করেছেন। ফোন ধরতে নিলুফার বললেন, জেসমিন কী খবর তোর?

ভালো আছি মা।

সকালে ফোন করলি না যে!

গাড়িতে বসেই করতাম। আর এখনই তুমি ফোন করেছ।

বড় চিন্তায় আছি তোকে নিয়ে। তোর বাবা তো সকালে আমাকে কিছুক্ষণ বকাবকি করল, কেন তাকে শিক্ষাসফরে যেতে দিলাম!

তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমরা সবাই ভালো আছি।

নাস্তা করেছিস?

হ্যাঁ, করেছি।

রাতে রুমে একা ঘুমাবি না। সাথে কাউকে রাখবি। হোটেল-ফোটেলে বিশ্বাস নাই। আর নতুন কারো সাথে মিশবি না।

আচ্ছা মা। আর আমি একা ঘুমাচ্ছি না। সাথে কেউ না কেউ থাকে। তুমি অতটা ভাববে না।

কেন যে ভাবি বুঝবি না, মা হলে বুঝতি। আবারো বলছি, সাবধানে থাকিস।

আচ্ছা মা।

ঠিক আছে।

লাইন কেটে দিলেন নিলুফার। জেসমিন এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ডান পাশে সমুদ্র আর বাম পাশে পাহাড়। দেখার মতো দৃশ্য। যতই সামনের দিকে এগোচ্ছে ততই প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন বাড়ছে। বাড়ছে সবুজের ঘনত্বও। মানুষের চলাচল তুলনামূলকভাবে কম। সমুদ্রতীরে মাঝে মাঝে মাছ ধরা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই বশের উপর শুকাতে দেয়া হয়েছে জাল। এমনই একটা জায়গায় ছবি তোলার জন্য থামল সবাই।

শাড়ি পরে কয়েকটি ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল জেসমিনের। কিন্তু সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। শান্তাসহ সবাই উঠে পড়েছে নৌকার উপর। সে উঠতে পারেনি, কারণ শাড়ি পরা। শাড়ি পরে এসে কী যে ভুল করেছে অনুধাবন করছে সে। তাই নিজে নিজেই সেলফি তুলতে লাগল। হঠাৎই কাউকে বলতে শুনল, আমি তোমার ছবি তুলে দেব আপু?

তাকিয়ে দেখে জেহান। তাদেরই ক্লাসের ছেলে। থাকেও তাদের বাড়ির পাশে। জেহানরা অবশ্য অনেক ধনী, তার বাবার অনেক বড় ব্যবসা রয়েছে। খুব ভদ্র, নম্র আর বিনয়ী ছেলে জেহান। দেখতেও সুন্দর, ফর্সা। তাদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই আসে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে যে কয়েকজনকে শিক্ষাসফরে আনা হয়েছে তাদের মধ্যে জেহান একজন। সেও অনেকটা জোর করে এসেছে। তাকে প্রথমে আসতে দিতে চায়নি তার বাবা-মা। কিন্তু নাছোড়বান্দা হওয়ায় বাড়ি থেকে অনুমতি পেয়েছে।

জেসমিন মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তাহলে তো ভালোই হয়, দাও ছবি তুলে দাও।

আমার ক্যামেরায় তুলে দেই, রেজুলেশন ভালো, ছবি সুন্দর আসবে।

ঠিক আছে, ছবিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দেবে কিন্তু।

আচ্ছা আপু।

জেহান অনেকগুলো ছবি তুলল। ছবিগুলো আসলেই সুন্দর হয়েছে, খুশি হলো জেসমিন। বলল, ধন্যবাদ তোমাকে জেহান।

আপু, তোমার সাথে আমি একটা ছবি তুলব।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, আজ তোমাকে সত্যি খুব সুন্দর লাগছে, বিশেষ করে লাল শাড়িতে।

তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। সবাই আমাকে উলটো বকাবকি করছে, কেন আমি লাল শাড়ি পরে এসেছি। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও খারাপ লাগছিল কেমন লাগছে আমাকে জানতে। একমাত্র তুমিই বললে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

এরমধ্যে শান্তা এসে উপস্থিত। জেসমিন অনুরোধ করলে শান্তা জেহান আর জেসমিনের কয়েকটা ছবি তুলে দিল। তারপর আবার সবাই উঠে পড়ল বাসে। চিত্তার করছেন রাবেয়া ম্যাডাম, খানিকটা রেগেও গেছেন। কারণ ত্রিশ মিনিট দেরি হয়ে গেছে এর মধ্যে।

গাড়িতে উঠার পর রাবেয়া ম্যাডাম সবার উদ্দেশে বক্তব্য দিলেন। বক্তব্যের সারমর্ম নিম্নরূপ,

তোমরা সবাই জানো প্রতি বছর আমরা আমাদের কলেজ থেকে শিক্ষা সফরে আসি। শিক্ষা সফর মূলত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য। পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান আমরা ভ্রমণ করি এবং আনন্দ উপভোগ করি। এই আনন্দ উপভোগ মানে ইচ্ছামতো চলা নয়। তোমাদের অবশ্যই নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে এবং নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। আমি সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে বলছি, তোমরা কেউ কেউ আমাদের আচরণবিধি বা নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করছ। এরকম করলে ভবিষ্যতে শিক্ষাসফর বাতিল হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে তোমরা পরবর্তী নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটা পথ বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছ বলে সবাই বিশ্বাস করবে। তোমরা জানো, আমরা কাউকে জোর করে এই শিক্ষা সফরে আনিনি। তোমরা স্বেচ্ছায় এসেছ। আমরা বিশ্বাস করি, তোমরা দায়িত্বশীল হবে এবং এমন কোনো আচরণ করবে না যার জন্য আমাদের বিব্রত হতে হয়। তোমাদের প্রতি কড়া নির্দেশ, এখন থেকে তোমরা সময় মেনে চলবে এবং যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে শতভাগ পালন করবে। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তোমাদের কারো জন্য যেন অন্যরা বিপদগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে লক্ষ রাখবে। আর যে হাডসন হিলে আমরা যাচ্ছি সেখানে সবাই দলবদ্ধভাবে থাকবে। জায়গাটা নির্জন। কেউ ভুলেও দলছুট হবে না। যাইহোক, আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলছি, তোমরা বড় হয়েছ। কেউ এমন কিছু করবে না যাতে এই শিক্ষা সফর অন্যদের জন্য কষ্টের, চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে। আর সবাই নিজ নিজ অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ রাখবে। ইতিমধ্যে আমি দুজন অভিভাবকের ফোন পেয়েছি। তারা চিন্তায় আছেন কারণ তোমাদের ফোনে পায়নি। এমন যেন না হয়। তোমাদের পিতা মাতা অভিভাবক যেন সবসময় তোমাদের পায়। আমাদের শিক্ষা সফর আরো সুন্দর আর আনন্দময় হোক এই আশা ব্যক্ত করছি।

কথা শেষ হলে রাবেয়া ম্যাডাম সামনের সিটে বসে পড়লেন। জেসমিনের পাশে বসেছিল শান্তা। সে নড়েচড়ে বসে বলল, ম্যাডাম বোধহয় একটু বেশিই রেগে গেছেন।

না রেগে উপায় আছে! নৌকা থেকে কেউ নামতেই চাচ্ছিল না।

আসলে অনেকের কাছে জায়গাটা নতুন, আর নৌকাটা কত বড় দেখেছিলি! এজন্য কেউ নামতে চায়নি।

জেসমিন বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যা কিছু আছে সবই আমাদের জন্য নতুন। তাই বলে এত সময় ধরে নৌকা দেখতে হবে, নৌকায় থাকতে হবে?

তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। হাডসন হিলে আবার কী হয়, কতক্ষণ লাগে কে জানে?

এখন আর কিছু হবে না। ম্যাডাম যেহেতু কড়াভাবে বলে দিয়েছেন, কেউ আর অহেতুক দেরি করবে না। তাছাড়া…।

তাছাড়া কী?

তখন ক্ষুধাও লেগে যাবে সবার। দেখবি তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চাইবে।

মনে হয় না।

কেন?

শান্তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এত সুন্দর জায়গা সব। আজ প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে ক্ষুধা পরাজিত হবে। দেখবি আবার সাগরে লাফালাফি শুরু করেছে সবাই।

তাহলে তো বকা খেতেই হবে।

একদিন না হয় বকা খেলামই। প্রত্যেকদিন তো আর কক্সবাজারে আসা হবে না, আসা হবে না হাডসন হিলেও।

জেসমিন আর কিছু বলল না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই থাকল। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, অপূর্ব সুন্দর সমুদ্র। এই সমুদ্র কার না দেখতে ভালো লাগে। জেসমিন ভাবল, ইস! এই সমুদ্রের পাশে যদি আজীবনের জন্য থেকে যাওয়া যেত কতই না আনন্দ হতো!

*

গাড়ি থেকে নেমে হাতের ডানে তিন শ গজের মতো হাঁটতে হয়। তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু একটা রাস্তা বের হয়ে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝ বরাবর। ঐ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে বাম পাশে অপূর্ব সুন্দর হাডসন হিল।

হাডসন হিল দেখে তো অবাক সবাই। এত সুন্দর! পাহাড়টা বেশ উঁচু সামনে ছোট উচ্চতার কিছু ঝোঁপ আছে। তারপর বিচ এবং সাগর। বিচ যেখানে শেষ সেখানে একটা বিশাল পাথর। এক তলা বাড়ির সমান উঁচু। ঐ পাথরের উপরে উঠলে কার না ভালো লাগবে? জোয়ারের সময়ও ডুবে না পাথরটা। পাহাড়ের দক্ষিণে আরো একটা ছোট পাহাড়। পুরোটাই নারকেল গাছে ঢাকা। জানতে পারল নাম ‘কোকোনাট হিল’। তবে এখন সবাই এগোচ্ছে পাথরটার দিকে।

জেসমিনদের সাথে অল্পবয়সি একজন গাইড এসেছে। সে জানাল, ঐ পাথরটার উপর ডাক্তার হাডসন পূর্ণিমা রাতে বসে থাকতেন। উপভোগ করতেন সমুদ্র আর জোছনার সৌন্দর্য। পাথরটার নাম তিনি রেখেছিলেন ‘এলিজা স্টোন’। কারণ তার স্ত্রীও খুব পছন্দ করতেন পাথরটা। তবে

অনেকে পাথরটাকে বলে ‘নীল পাথর’।

পাথরের উপর খোদাই করে এলিজা নামটা লেখা আছে। উপরে উঠার জন্য পাশে আছে আরো ছোট ছোট তিনটা পাথর। ঐ পাথরগুলোতে পা রেখে উপরে উঠে গেল অনেকেই। ছবি তুলতে শুরু করল। রাবেয়া ম্যাডাম বরাবরের মতোই চিৎকার করতে লাগলেন, সাবধান, কেউ পাথরের ফাঁকে পা ফেলবে না, খবরদার দলছুট হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সবাই ব্যস্ত ক্যামেরায় ছবি তুলতে। আর মুখে সবার একটাই কথা, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

গাইড এবার সবাইকে ডাকল হাডসন গুহায় যাওয়ার জন্য। পাহাড়ের ঠিক নিচে, বিচ থেকে ফুট তিনেক উপরে গুহাটা। বেশ চওড়া। লম্বায় এক শ ফুট আর ভিতরের দিকে চওড়া ষাট ফুটের মতো। পাহাড়ের নিচে এত বড় একটা গুহা কীভাবে তৈরি হলো এটা এক বড় রহস্য। একে একে সবাই গুহার ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করল। জেসমিন দেখল, গুহাটাকে বাইরে থেকে যত বড় মনে হয়, ভিতরে আসলে আরো বড়। একেবারে মাথায় একটা মূর্তি।

মর্তিটার উচ্চতা দশ ফুটের মতো হবে। দেখে বড় অবাক হলো জেসমিন, এই মূর্তিটাকেই গতকাল সে স্বপ্নে দেখেছিল। তার কক্ষে এসেছিল মূর্তিরূপী ডাক্তার হাডসন। বলেছিল লাল শাড়ি পরে আসতে আর স্পর্শ করতে তাকে। তার খুব ইচ্ছে করছে মূর্তিটাকে ধরার। কিন্তু এই মুহূর্তে সম্ভব না, কারণ গাইড সবার উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছে।

গাইড বলছে, এই মূর্তিটা ডাক্তার হাডসনই তৈরি করেছিলেন। জানা যায় যে, তিনি তার স্ত্রী এলিজার একটি মূর্তিও তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করেননি। কেন করেননি তা এখনো রহস্যাবৃত। লোকমুখে শোনা যায় তার বাস্তব চেহারা আর এই মূর্তির চেহারা হুবহু একইরকম। এতে বোঝা যায় মূর্তি তৈরিতে তার খুব ভালো হাত ছিল। তিনি এই গুহাটাতেই বসবাস করতেন। গুহাটাকে হাডসন হাউসও বলা হয়। এখানে বসেই মানুষের চিকিৎসা করতেন তিনি।

একজন ছাত্রী প্রশ্ন করল, এখানে তো মানুষজন নেই। কার চিকিৎসা করতেন?

আপনি ঠিকই বলেছেন। এখনো এই জায়গাটতে তেমন বসতি গড়ে উঠেনি, আর এখন থেকে সত্তর-আশি বছর আগে মানুষ থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। কথিত আছে তিনি সপ্তাহে তিন দিন ঘোড়ায় করে উখিয়া বাজারে চলে যেতেন। উখিয়া বাজার শত বছরের পুরাতন বাজার। ওখানে মানুষজন আসত। ওখানেই রোগী দেখতেন তিনি। ওষুধ আনতেন টেকনাফ কিংবা চট্টগ্রাম থেকে। এজন্য তার লোক ছিল। মাঝে মাঝে উখিয়াতেই রাত যাপন করতেন। তারপর চলে আসতেন এই গুহায়। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকলে মানুষজন এখানেও আসতে শুরু করে।

এবার এক জুনিয়র ছাত্র প্রশ্ন করল, তিনি এখানে কীভাবে এসেছিলেন?

কথিত আছে জাহাজটা সামনের ঐ সাগরে ঝড়ের কবলে পড়েছিল। ডাক্তার হাডসনসহ অনেকে নৌকায় করে তীরে আসেন। অন্যরা চলে গেলেও ডাক্তার হাডসন আর তার স্ত্রী থেকে যান এখানে। পরে তার স্ত্রী সাগরে ডুবে মারা গেলে তিনিও আর ফিরে যাননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এলিজা মারা যায়নি। বরং বিশ্বাস করতেন কোনো না কোনোদিন ফিরে আসবে তার প্রিয়তমা স্ত্রী।

তারপর কী হলো?

প্রায় বারো-তেরো বছর পর হঠাৎই তিনি সবার অলক্ষ্যে ইংল্যান্ড চলে যান। তবে স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে তিনি ফিরে আসেন, মানুষ হিসেবে নয়, আত্মা হিসেবে। অনেকে সেই আত্মা দেখেছে। যাইহোক, সময় যত পার হতে থাকে মানুষের মন থেকেও মুছে যেতে থাকে ডাক্তার হাডসনের স্মৃতি। তবে গত কয়েক বছর ধরে আবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। মূল কারণ পর্যটকদের আগমন এবং ফেসবুকে হাডসন হিলের সংবাদের বিস্তৃতি।

গত এক বছরে কেউ কি ডাক্তার হাডসনের আত্মা দেখেছে এই পাহাড়ে?

দুই মাস আগে একজন মাঝবয়সি নারী দেখেছে বলে দাবি করেছে। সে যখন গুহায় প্রবেশ করে তার স্বামী ছিল বাইরে। দেখেছিল কাফনের কাপড় পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে গুহার ভিতর। তার চোখের দিকে নাকি তাকিয়েও ছিল। নীল চোখ জ্বলজ্বল করছিল। ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল তার। পরে অবশ্য তারা তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যায়। যাইহোক, তোমাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এটা সত্য হাডসন হিল এক রহস্যময় জায়গা, আমি নিজেও বিশ্বাস করি ডাক্তার হাডসনের আত্মা এই হাডসন হিলে আছে। তবে এখন পর্যন্ত ডাক্তার হাডসন কিংবা তার আত্মা কারো কোনো ক্ষতি করেছে বলে জানা যায়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই এলাকায় ডাক্তার হাডসন সবার কাছে একজন ভালোবাসার মানুষ হিসেবে পরিচিত। যাইহোক, এখন তোমরা ছবি তুলে নাও। তারপর আমরা বের হব।

শুরু হয়ে গেল ছবি তোলার হিড়িক। সবাই ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে ছবি তুলতে চায়। জেসমিন অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকল। সে দেখতে লাগল মূর্তিটাকে, আর অপেক্ষা করতে থাকল ভিড় কমার জন্য। মূর্তিটা আসলেই সুন্দর। হঠাৎ তার মনে হলো মূর্তিটা যেন নড়ে উঠল। চমকে উঠল সে। ভালোমতো তাকাল মূর্তিটির দিকে। না, মূর্তিটি আগের জায়গায়ই আছে, নড়ে উঠা সম্ভব না। কারণ বড় একটা পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে মূর্তিটাকে। নড়তে হলে পুরো পাহাড়কে নড়তে হবে।

ভিড় কমে গেলে জেসমিন ধীরপায়ে এগিয়ে গেল মূর্তিটার দিকে। তার দাঁড়িয়ে থাকার আর-একটা কারণ ছিল। তলপেটে হালকা চিনচিন ব্যথা করছে। এরকম ব্যথা আগে কখনো করেনি। কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে ব্যথাটা সহ্য করা যাচ্ছে, তেমন সমস্যা হচ্ছে না।

জেসমিন তাকাল উপরের দিকে। স্থির দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা। হঠাৎই তার মনে হতে লাগল মূর্তিটা যেন তাকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না। মূর্তিটার যেন অনেক অনেক কথা, এমন কাউকে খুঁজছে যাকে সে সবকিছু খুলে বলতে পারে। হয়তো সে নিজে সেই মানুষই, এমনই অনুধাবন করল জেসমিন।

মনের মধ্যে আবোল-তাবোল কল্পনা জন্ম নিচ্ছে উপলব্ধি করে মাথা ঝাঁকি দিল জেসমিন। এসে দাঁড়াল মূর্তির একেবারে পাশে। মূর্তিটা উঁচু হওয়ায় মূর্তির হাত তার গলা পর্যন্ত নেমে এসেছে প্রায়। আলতোভাবে হাত স্পর্শ করল সে। আর সাথে সাথে যেন নিজের মধ্যে ভিন্ন এক শিহরন অনুভব করল। তার মনে হলো, ভালো লাগার চমৎকার এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে। সে ছাড়াল না হাতটা, ধরেই রাখল। সবচেয়ে ভালো লাগছে উপলব্ধি করে যে তার তলপেটের ব্যথাটাও উধাও হয়ে গেছে। ডাক্তার হাডসনের স্পর্শ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে যেন।

এই এতক্ষণ হাত ধরে আছিস কেন?

শান্তার প্রশ্ন শুনে বাস্তবে ফিরে এলো জেসমিন।

শান্তা আবার বলল, আমি ছবি তুলব। তুই একটু সরে দাঁড়া জেসমিন।

জেসমিন সরে দাঁড়ালে শান্তাসহ বাকি কয়েকজন নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলল।

সবাই যখন গুহা থেকে বের হয়ে গেল গুহার মুখে তখনো দাঁড়িয়ে থাকল জেসমিন। অজানা একটা টান অনুভব করছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তিটার জন্য। মূর্তিটা যেন তাকে বলছে, তুমি থেকে যাও জেসমিন, থেকে যাও, আমার কাছে তুমি থেকে যাও, আমি অপেক্ষায় আছি, অনেক অনেক দিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি, শুধুই তোমার অপেক্ষায়।

জেসমিন, জেসমিন।

রাবেয়া ম্যাডামের চিৎকার শুনে বাস্তবে ফিরে এলো জেসমিন।

রাবেয়া ম্যাডাম বলে চলছেন, তুমিও শেষ পর্যন্ত দেরি করছ। এজন্যই আমি শিক্ষা সফরে আসতে চাই না। কেউ কথা শোনে না। যাও গাড়িতে ওঠো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করেছ তো…

জেসমিন আর দাঁড়াল না। দ্রুত উঠে এলো বাসে।

বাস চলতে শুরু করেছে। জেসমিন তাকিয়ে আছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হাডসিন হিলের দিকে। তার অবচেতন মন বারবার বলছে, সে যেন কাউকে ফেলে যাচ্ছে, ফেলে যাচ্ছে তার প্রিয়, অতি প্রিয় কাউকে।

*

বিকেলে জেসমিন সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে বের হয়েছে। এখানে ঝিনুক মার্কেটে ঝিনুকের তৈরি অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়। বছরখানেক হলো মার্কেটটা পাঁচমিশালী ধরনের হয়ে গেছে। ছোটদের খেলনা, বিছানার চাদর, জুতা, স্যান্ডেলসহ এমন কিছু নেই যা পাওয়া যায় না, দামও বেশি। মানুষ তারপরও কেন যেন বেশ আগ্রহ নিয়ে কিনতে থাকে সবকিছু। প্রত্যেকটা দোকানেই ভিড়। কোনো কোনো দোকানে তো বিক্রেতারা ক্রেতার সাথে কথা বলার সময়ও পাচ্ছে না। জমজমাট এই কক্সবাজার দেখতে সত্যি ভালো লাগছে জেসমিনের।

জেসমিন আর শান্তা ঢুকেছে একটা মুক্তোর দোকানে। দুই ধরনের মুক্তোর মালা পাওয়া যায় কক্সবাজারে। প্রথম ধরনটা হলো কৃত্রিম এবং হালকা আর দ্বিতীয় ধরনটা আসল। আসল মুক্তোর মালা বেশ ভারী হয়। এরকমই একটা মুক্তোর মালা পছন্দ করল জেসমিন। কিন্তু দাম তিন হাজার টাকা। এত টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই জেসমিনের। দামাদামি করার পর দুই হাজার পাঁচ শ টাকায় রাজি হলো দোকানদার। কিন্তু তারপরও কিনতে পারল না জেসমিন। সে সতেরো শ টাকা পর্যন্ত বলেছে।

যখন দোকান থেকে বের হয়ে আসবে তখন দেখে জেহান দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে জেসমিন বলল, কী ব্যাপার জেহান, তুমি এখানে?

তোমাকে দেখে এলাম আপু।

কেন?

হাড়সন হিলে তোমার অনেকগুলো ছবি তুলেছি। আমার মোবাইল ফোনে আছে। তুমি অনুমতি দিলে আমি তোমার হোয়াটস্অ্যাপে কিংবা মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেই।

জেসমিন খানিকটা ধমকে উঠে বলল, তুমি অনুমতি ছাড়া আমার ছবি তুলেছ কেন?

জেহান একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। সে ভাবতে পারেনি জেসমিন এভাবে রেগে উঠবে। বলল, আ…আমি তো দুপুরে তোমার ছবি তুলে দিয়েছিলাম। তুমিই অনুমতি দিয়েছিলে। মনে আছে, মেরিন ড্রাইভে নৌকা থেকে একটু দূরে। আমার সাথেও ছবি তুলেছিলে।

তার মানে এই নয় যে হাডসন হিলে তুমি ছবি তুলতে পারবে আমার!

শান্তা এবার জেসমিনকে উদ্দেশ করে বলল, ওকে তুই শুধু শুধু বকছিস কেন? শিক্ষাসফরে ছবি তোলার কাউকে পাওয়া যায় না। জেহান আমাদের জুনিয়র, ছবি তুলে দিয়েছে তাতে দোষের কী? জেহান তুমি ছবিগুলো পাঠিয়ে দিও জেসমিনের মোবাইলে। আর আমি তোমাকে আমার ছবি তোলার অনুমতি দিয়ে দিলাম, যখন ইচ্ছা তখন তুলতে পারো। তবে ছবিগুলো শুধু আমাকেই পাঠাবে, ঠিক আছে।

শান্তা পরিবেশটাকে হালকা করে দিল। তবে জেহান আর কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল শান্তা আর জেসমিন দোকান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত।

জেসমিন বাইরে আসতে রিং বেজে উঠল ফোনে ফোন করেছে রাশেদ। রাশেদ তাদের কলেজের ছাত্র। ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে। এখন তৃতীয় বর্ষে পড়ে। জেসমিনের প্রতি তার বেশ ঝোঁক। জেসমিনও পছন্দ করে তাকে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠছে অনেকে মনে করলেও সম্পর্কটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এখনো। একজন অন্যজনকে দেখলে মুচকি হাসে, টুকটাক কথা বলে এ পর্যন্তই। রাশেদ ছেলে হিসেবে ভদ্র, নম্র, দেখতেও সুন্দর। কলেজের প্রায় সব মেয়েই পছন্দ করে রাশেদকে। এই হিসেবে জেসমিন সৌভাগ্যবান। কারণ সে কিছুটা হলেও সম্পর্ক করতে পেরেছে রাশেদের সাথে। রাশেদদের পারিবারিক অবস্থাও স্বচ্ছল। বাবা বড় কাপড় ব্যবসায়ী, চারতলা বাড়ি আছে নিজেদের। রাশেদের একটা মোটরসাইকেল আছে। রাশেদ তাকে উঠতে বলেছে কয়েকবার, কিন্তু ভয়ে মোটরসাইকেলে উঠেনি সে। অবশ্য এটাও ঠিক, সম্পর্কটা এখনো মোটরসাইকেলে উঠে ঘুরতে যাওয়ার মতো হয়নি।

ফোন ধরতে রাশেদ বলল, কেমন আছো জেসমিন?

ভালো আছি ভাইয়া।

কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

না না।

কোথায় কোথায় ঘুরলে?

অনেক জায়গায়।

ভালো লাগলো কোন জায়গাটা?

হাডসন হিল।

ঐ জায়গা আবার কোনটা?

এলে বুঝতে পারবেন। ফোনে বোঝানো যাবে না।

ঠিক আছে, তুমি ফিরে এলে তখন শুনব। আসলে আমি নিজেও কখনো কক্সবাজার যাইনি। তুমি যখন যাচ্ছিলে, ইচ্ছে হচ্ছিল একাই চলে যাই। পরে ভাবলাম ঠিক হবে না। যাইহোক, কবে আসবে?

পরশুদিন রওনা দেব। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কক্সবাজার থেকে ঢাকা অনেক দূর।

আমি মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করব। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব বলে ঠিক করেছি।

মোটরসাইকেলে আমি উঠতে পারব না। ভয় করে।

আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে রিকশায় পৌঁছে দেব।

আজ তাহলে রাখি।

এত তাড়াতাড়ি!

জি।

আচ্ছা।

এভাবে ছোট ছোট বাক্যে কথা হয় দুজনের। তবে নিয়মিত না। জেসমিন অবশ্য নিজে ফোন করেনি একদিনও। যতদিন ফোন করেছে রাশেদই। জেসমিনের মধ্যে কিছুটা হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে দ্বিধাদ্বন্দ্বটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আগে কথায় কথায় “ভাইয়া বলত রাশেদকে। ইদানীং একবার কি দুবার বলে।

রাতে খাওয়ার পর তলপেটের ব্যথাটা আবার শুরু হলো। এরকম হচ্ছে কেন সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আজই ব্যথাটা তার উঠেছে এবং তা হাডসিন হিলে যাওয়ার পর। আবার ডাক্তার হাডসনের মূর্তির স্পর্শে মিলিয়ে গেছে। কী অদ্ভুত! এই ব্যথার সাথে হাডসন হিলের কোনো যোগসাজস আছে কি না ঠিক বুঝতে পারছে না সে।

ব্যথার মাত্রা আরো বাড়লে শান্তার কক্ষে প্রবেশ করল সে। প্যারাসিটামল চাইলে প্যারাসিটামল দিয়ে শান্তা বলল, ব্যথা কি খুব বেশি?

সহনীয় মাত্রায় আছে, তবে কষ্ট হচ্ছে।

আমি কি রাতে তোর পাশে ঘুমাব?

না, দরকার হবে না। অত চিন্তা করিস না। সকালে একবার উঠেছিল, তারপর এমনিতেই চলে গেছে। আশা করছি এবারও কমে যাবে।

কথাগুলো বলে নিজের কক্ষে চলে এলো জেসমিন। ঘড়ি দেখল, রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি তার শুতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু ব্যথাটার জন্য দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। শেষে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। আর তখনই অনুভব করল, কেউ একজন আছে এই ঘরের মধ্যে। অজানা একটা শঙ্কা হঠাৎই তাকে অস্থির করে তুলল। কিন্তু সে নিশ্চিত কেউ নেই, অথচ মন বলছে কেউ আছে। কী এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব।

বাথরুম, খাটের নিচে, দরজার পিছনে, বারান্দা সবজায়গায় দেখল জেসমিন। না, কেউ নেই। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শরীরের উপর চাদর টেনে দিল সে। আর তখনই মেসেঞ্জারে একসাথে অসংখ্য ছবি এলো, পাঠিয়েছে জেহান। হাডসন হিলে তোলা ছবিগুলো, খুব সুন্দর হয়েছে। জেহানের মোবাইল ফোনের ক্যামেরার রেজুলেশন অনেক ভালো, এজন্য ছবিগুলো সুন্দর হয়। কিছুটা খারাপ লাগছে ভেবে যে জেহানকে আজ ছবি তোলার জন্য বকা দিয়েছে। ব্যাপারটা যে উচিত হয়নি অনুধাবন করছে। সে। ঠিক করল, অযাচিত ব্যবহারের জন্য আগামীকাল ক্ষমা চেয়ে নেবে জেহানের কাছে।

এমন একটা ভাবনা স্বস্তি দিলেও তলপেটের ব্যথা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে পড়ল। ব্যথাটা বাড়ছে ধীরে ধীরে। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। উঠে একবার পানি খেল সে। তারপর আবার এসে শুলো। ব্যথাটা বাড়ছে তো বাড়ছেই। সে অনুভব করল ঘামতে শুরু করেছে, এটা ভালো লক্ষণ না। জোরে কয়েকবার শ্বাসও নিল। এতে কিছুটা যেন কমল ব্যথাটা। এরপর হাতে তুলে নিল মোবাইল ফোন। দেখতে লাগল হাডসন হিলে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে তোলা ছবিগুলো।

ব্যথাটা বাড়ছেই। জেসমিন শুয়েছিল ডান কাত হয়ে। এবার চিৎ হয়ে শুলো। পা টান করলে মনে হলো একটু বুঝি কমল। মোবাইলটা তার তখনো হাতে। একটা ছবি চোখের সামনে ভাসছে। সে দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির পাশে আর ডাক্তার হাডসনের হাতটা তার কাঁধে। হঠাৎ যেন তার মনে হলো ডাক্তার হাডসন নড়ে উঠলেন। হ্যাঁ, নড়েই উঠলেন। জেসমিন যখন হেঁটে আসছে, তিনিও হেঁটে হাসছেন সামনের দিকে। একেবারে গুহার বাইরে বের হয়ে এলেন তিনি। সময়টা রাত। তবে জোছনা থাকায় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোছনা যেন আজ বৃষ্টির মতো করছে নিচের দিকে, অবশ্য হালকা বৃষ্টিও পড়ছে। আর ডাক্তার হাডসন ছায়ার মতো এগিয়ে আসছেন তার পাশে। এ যেন ছায়া আর জোছনার বৃষ্টির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। জেসমিন বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করেছে দেখে লাল একটা ছাতা মাথার উপর ধরলেন ডাক্তার হাডসন। সেই ছাতার নিচে এখন দুজন। ডাক্তার হাডসন আর মূর্তি নেই, নীল চোখের অপূর্ব সুন্দর এক পুরুষ, পরনে সাদা পায়জামা আর নীল পাঞ্জাবি। তার পাশে সে পরে আছে লাল শাড়ি।

জেসমিন অবাক হয়ে দেখল যে সে নিজেই নিজেকে দেখছে। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তার এই ভাবনার মাঝেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে। এখন শুধু দেখা যাচ্ছে ডাক্তার হাডসনকে। লম্বাটে মুখ, ফর্সা গায়ের রং, নিষ্পাপ একটা ভাব আছে চেহারায়। এগিয়ে আসছেন তারই কাছে। যত কাছে আসছেন ততই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে। আসছেন, ডাক্তার হাডসন আসছেন এবং একসময় মোবাইলের স্ক্রিন পার হয়ে সত্যি তার কক্ষে চলে এলেন। তারপর খাটের পাশে এসে মিষ্টি হেসে বললেন, কেমন আছো জেসমিন?

জেসমিন বিশ্বাস করতে পারছে না ডাক্তার হাডসন তার কক্ষে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ডাক্তার হাডসন সুন্দর, দেখতে আসলেই সুন্দর।

আমি খুব খুশি হয়েছি এ কারণে যে তুমি লাল শাড়ি পরে আমার কাছে এসেছিলে

এবার জেসমিন মিনমিন করে বলল, আ…আপনি বলেছিলেন এজন্য লাল শাড়ি পরেছিলাম।

শুধু আমি বলেছিলাম বলে যে তুমি শাড়ি পরেছিলে, তা কিন্তু নয়।

জেসমিন কিছু বলল না।

ডাক্তার হাডসন মৃদু হেসে বললেন, তুমি আমাকে পছন্দ করো, কল্পনা করো, আমাকে কাছে পেতে চাও, এজন্যই তুমি আমার পছন্দের শাড়ি পরে গিয়েছিলে। সত্য বললাম কি?

আ…আ…আমি জানি না।

তুমি জানো। কিন্তু বলতে পারছ না। আমার প্রতি তোমার ভালোলাগাকে আমি উপলব্ধি করি। এজন্যই তোমার এখানে এসেছি। আমি জানি, তুমি তলপেটের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছ।

আপনি জানলেন কীভাবে?

তুমি যখন আজ দুপুরে আমাকে স্পর্শ করেছিলে তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার স্পর্শ তোমার ব্যথা কমিয়ে দিয়েছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

তোমার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তীব্র একটা ব্যথা তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি কি তোমার ব্যথাটা কমিয়ে দেব?

কীভাবে?

তোমার ব্যথার স্থানটা আমাকে স্পর্শ করতে হবে।

আ…আ…আমি…

তুমি অনুমতি দিলেই আমি স্পর্শ করব এবং দেখব।

আ…আমি চাই ব্যথাটা কমে আসুক। সহ্য করতে পারছি না আর। আপনি আমাকে স্পর্শ করতে পারেন।

ডাক্তার হাডসন মৃদু একটা হাসি দিলেন। তারপর বসলেন খাটের উপর। ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেললেন চাদরটা। বললেন, ঠিক কোন জায়গায় তোমার ব্যথাটা?

জেসমিন খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে। একজন অপরিচিত পুরুষ তার কক্ষে, তাকে স্পর্শ করছে, বিষয়টা ঠিক যেন মেনে নিতে পারছে না সে। অস্বস্তিটা আরো বাড়ল যখন মনে পড়ল গত রাতে এই মানুষটাই তাকে চুমু খেয়েছিল, তার সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আজ আবার এসেছে। মানুষটাকে তার ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে, ঠিক অনুধাবন করতে পারছে না এখন, তবে এটুকু বুঝতে পারছে তার ব্যথাটা কমানো দরকার। তাই সে হাত দিয়ে তলপেটে নাভির পাশে জায়গাটা দেখিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনকে।

সালোয়ার-কামিজ পরা ছিল জেসমিন। কামিজ খানিকটা সরিয়ে ব্যথার স্থানে হাত রাখলেন ডাক্তার হাডসন। তারপর ধীরে ধীরে চাপ দিতে থাকলেন। চাপের সাথে সাথে ব্যথার তীব্রতাও বাড়তে থাকল। জেসমিন মুখে উহ্ উহ্ করতে লাগল।

ডাক্তার হাডসন বললেন, তোমাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে জেসমিন।

আ…আমি আর পারছি না।

কিছুটা ব্যথা লাগবে, তবে তার পরে সেরে যাবে।

আ…আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এখন ব্যথা আরো বাড়ছে।

আ…আমি বোধহয় বুঝতে পারছি তোমার ব্যথার কারণটা।

কী কারণ?

ডাক্তার হাডসন কোনো কথা বললেন না। হঠাই ঝুঁকে এলেন জেসমিনের মুখের উপর। তারপর আলতোভাবে চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে, আর ডান হাত দিয়ে জোরে চাপ দিলেন জেসমিনের তলপেটে। তীব্র ব্যথায় জেসমিন চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারল না। কারণ তার ঠোঁট দুটো তখন ডাক্তার হাডসনের ঠোঁটের মাঝে। রেগে উঠল সে, ডাক্তার হাডসনের কাছ থেকে অযাচিত এরকম আচরণ সে আশা করেনি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে বুঝতে পারল ব্যথাটা চলে গেছে তার, শরীরটা এখন একেবারে ব্যথাহীন। তবে সে ঘেমে ভিজে গেছে আর অবশ হয়ে আসছে তার শরীর। সে অনুধাবন করল ডাক্তার হাডসনের এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে শরীরকে অবশ করে দেয়ার এবং শরীরে ভালোলাগার তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি করার। এখন তার মনে হচ্ছে ডাক্তার হাডসন তার কাছে আসুক, আরো কাছে আসুক।

ডাক্তার হাডসন মাথা উঁচু করলেন। তারপর বাম হাতটা জেসমিনের মুখে রেখে বলল, চিৎকার কোরো না। তোমার ব্যথাটা বোধহয় কমে গেছে।

আ…প…আপনি… আপনি…

আমি অন্যায় করিনি। তুমি আমাকে চাও, মনের গভীর থেকে চাও, আমি অনুধাবন করি। করি বলেই তোমার কাছে এসেছি। আর আমি এটাও জানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ। ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রত্যেক নারীরই প্রথমে সংকোচ থাকে, সংকোচ কাটিয়ে অতঃপর ভালোবাসাকে নারী উপভোগ করে।

না, না, আমি হয়তো আপনাকে ভালোবাসি না।

তুমি অবশ্যই আমাকে ভালোবাসো। তোমার চোখ দেখে আমি বুঝতে পারছি জেসমিন। ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখতে নেই, তাহলে ঠকতে হয় জীবনে। ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে প্রিয়জনকে দেয়ার জন্য, প্রিয়জনের ভালোবাসা ভাগাভাগি আর উপভোগের জন্য। ভালোবাসা কষ্টের নয়, আনন্দের। তুমি আমাকে ভালোবাসো, মনের গভীর থেকে ভালোবাসো। আমি জানি, আমি উপলব্ধি করি। এজন্য আমি আবার আসব, বারবার আসব। আগামীকাল রাতেও আসব তোমার এখানে। আগামীকাল তুমি জানালাটা খোলা রাখবে আর লাল রঙের শাড়ি পরবে। জানালা বন্ধ থাকলে বুঝব তোমার হৃদয় আমার জন্য বন্ধ। আর আসব না তোমার কাছে। আর খোলা রাখলে বুঝব তোমার হৃদয় আমার জন্য উন্মুক্ত, তুমি আমাকে চাও, অনেক অনেক কাছে চাও, একেবারে হৃদয়ের গভীরে। আমি আগামীকাল তোমার হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যেতে চাই।

কথাগুলো বলে ঠোঁটের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন ডাক্তার হাডসন। তারপর আবার একটা চুমু খেলেন। এবার আলতোভাবে। জেসমিন অনুভব করল তার শরীর কাঁপছে এবং সে খুব ক্লান্ত। সে যে কিছু বলবে কিংবা বাধা দেবে সেই শক্তি তার এখন আর নেই।

এদিকে ডাক্তার হাডসন উঠে দাঁড়িয়েছেন। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন পিছনের দিকে। হঠাৎই রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে মিলিয়ে গেলেন জোছনার বৃষ্টিতে।

জেসমিন চোখ বুঝল। অনুভব করল তার শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই। বরং ভালোলাগার একটা আবেশ যেন ছড়িয়ে আছে সমস্ত শরীরে। আর ঘুম আসছে, ঘুম আসছে দুচোখ জুড়ে!

*

জেহান সকালে সাগরের পাড়ে এসেছে। কলেজের অনেকে আছে বিচে। তবে সে তাদের থেকে খানিকটা দূরে। ইচ্ছে করেই একা থাকছে। কারণ তার পকেটে আছে মুক্তোর মালা। এই মালাটা সে দিতে চায় জেসমিনকে, কিন্তু কীভাবে দেবে ঠিক বুঝতে পারছে না। জেসমিন ভালোভাবে নেবে কি নেবে না জানে না সে। তার আসলে জেসমিনকে বড় ভালো লাগে! তাকে নিয়ে স্বপ্নও দেখে সে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে মূল সমস্যা হচ্ছে বয়স। জেসমিন তার থেকে এক বছরের বড়। জেসমিনকে ভালোলাগা যে মূলত ভালোবাসা, তা ইদানীং উপলব্ধি করছে সে। কিন্তু এই সমাজে বয়সে ছোট ছেলেরা বয়সে বড় মেয়েদের ভালোবাসতে পারবে না, এরকম একটা অলিখিত নিয়ম যেন আছে। বিষয়টাকে সে নিজেও মেনে নিতে চায়, কিন্তু পারে না, জেসমিনকে দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। তার খুব ইচ্ছে হয়, জেসমিনকে ‘আপু’ করে সম্বোধন না করে শুধু ‘জেসমিন’ বলে ডাকতে। কিন্তু বাস্তবে যে তা সম্ভব নয়। কেউ মেনে নেবে না, না জেসমিন নিজে, না তার পরিবার।

গত রাতে ছবি পাঠানোর পর জেসমিন মেসেঞ্জারে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছে। মোবাইল ফোনে ধন্যবাদটা বের করে বেশ কয়েকবার দেখল সে। জেসমিনের লেখা ‘ধন্যবাদ’ তার জীবনে এক অনন্য প্রাপ্তি। স্ক্রিনশটটা রেখে দিল, যেন যে কোনো সময় ইচ্ছে হলে দেখতে পারে। জেসমিনের সাথে ভোলা তার ছবিগুলোও দেখল! কী সুন্দর জেসমিন! অথচ এত কাছে থেকেও যে কত দূরে! তাদের আর জেসমিনদের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায়, যখন ছোট ছিল অনেককিছু জেসমিনের কাছ থেকে পেত সে। চকলেট, আইসক্রিম, খেলার জিনিসপত্র, আরো কত কী! বয়স তাদের যত বাড়ছে ততই যেন জেসমিন দূরে সরে যাচ্ছে, কেমন যেন পর হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ইদানীং কলেজের বড় ভাই রাশেদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে জেসমিনের। ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছে না সে। রাশেদ পড়াশুনায় যেমন ভালো, তেমনি দেখতেও হ্যান্ডসাম। জেসমিন তার প্রেমে পড়ে গেলে সে যে জেসমিনকে আর পাবে না তা নিশ্চিত। রাশেদের প্রেমে পড়ার আগেই জেসমিন যেন তার প্রেমে পড়ে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে এখন। কিন্তু কীভাবে সম্ভব, জানে না সে। প্রাথমিকভাবে মুক্তোর মালাটা কিনেছে। এই মালা দিয়েই নিজের ভালোলাগার কথা জেসমিনকে বলবে বলে ঠিক করল। অবশ্য আগেও সে কয়েকবার নানানাবে জেসমিনকে ভালোলাগার কথা বলবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি। কেন যেন তার ভয় ভয় লাগে। মনে হয় জেসমিন তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তারপর আর কোনোদিন সে জেসমিনের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

জেসমিনকে হঠাৎই সে দেখতে পেল বিচের দিকে হেঁটে আসছে এবং একা। এরকম একা জেসমিনকে সাধারণত পাওয়া যায় না। জেহান আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত হেঁটে জেসমিনের কাছে এলো। জেসমিন অবাক হয়ে বলল, তুমি কি সকালেই এসেছ বিচে?

হ্যাঁ। আ…আর তোমাকে ধন্যবাদ।

কেন?

তুমি গতকাল আমাকে ‘ধন্যবাদ’ লিখে মেসেঞ্জারে উত্তর দিয়েছিলে।

ও আচ্ছা। তুমি আসলেই ছবিগুলো সুন্দর তুলেছ। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। স্বীকার করতেই হয় ক্যামেরায় তোমার হাত ভালো।

শুনে বড় খুশি হলাম।

দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। তাদের গন্তব্য সাগরের দিকে। জেহান সিদ্ধান্ত নিল এখনই বলবে মুক্তোর মালাটার কথা। যদি মালা পছন্দ হয় তাহলে সে বলবে ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা, যা থাকে কপালে।

জেহান যখন এরকম ভাবছে তখন হঠাৎই জেসমিন বলল, জেহান তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি সত্য উত্তর দেবে।

অবশ্যই দেবে।

কারো সাথে এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবে না।

না করব না।

তুমি কলেজের রাশেদ ভাইকে নিশ্চয় চেন। সে আসলে মানুষটা কেমন?

এরকম কিছু শুনবে বলে মোটেও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না জেহান। আমতা আমতা করে বলল, রা…রাশেদ ভাই!

হ্যাঁ, রাশেদ ভাই, ঐ যে লম্বা করে সুন্দর মতন দেখতে।

ভা…ভালো, ত…তবে…

জেসমিন ভ্রু কুচকে বলল, তবে কী?

একটু অহংকারী।

অহংকারী তো একটু হবেই, পুরুষ মানুষকে কি অহংকারী ছাড়া মানায়! মিনমিন করা পুরুষ মানুষকে কেউ পছন্দ করে না, তাই না?

জেহান কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। রাশেদ মোটেও অহংকারী না, সে বানিয়ে বলেছে এ কারণে যেন জেসমিন আর রাশেদকে পছন্দ না করে। এখন দেখছে, রাশেদের পক্ষেই সাফাই গাইছে জেসমিন। সারাজীবন শুনে এসেছে অহংকার পতনের মূল, আর এখন শুনছে অহংকার পুরুষের গুণ। জেসমিন কি সত্যি তাহলে প্রেমে পড়ে গেছে রাশেদের? ভাবতেই মাথাটা গুলিয়ে উঠল জেহানের। এমন একটা পরিস্থিতিতে কীভাবে মুক্তোর মালাটা জেসমিনকে দেবে ঠিক বুঝতে পারছে না।

জেসমিন, জেসমিন!

শান্তা ডাক দিল জেসমিনকে। জেসমিন আর দাঁড়াল না, চলে এলো শান্তার কাছে। শান্তা পানিতে নেমেছে। বলল, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পানিতে আয়।

পানির মধ্যে পা ডুবাল জেসমিন।

তোর ব্যথাটা কমেছে?

হ্যাঁ, কমেছে।

প্যারাসিটামলে ভালো কাজ হয়েছে তাহলে।

প্যারাসিটামলে নয়, ব্যথা কমেছে ডাক্তার হাডসনের স্পর্শে।

কথাটা বলতে গিয়েও বলল না জেসমিন। উপরে নিচে মাথা ঝাঁকাল শুধু। তবে ডাক্তার হাডসনের কথা মনে হতে নিজের মধ্যে ভিন্ন এক অনুভূতি কাজ করতে শুরু করল। ভালোলাগার পাশাপাশি কিছুটা অস্বস্তিও যেন আছে ঐ অনুভূতির মাঝে।

কী ভাবছিস?

না, কিছু না।

মনে হচ্ছে কিছু একটা ভাবছিস।

প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জেসমিন বলল, মহেশখালী যাওয়ার সময় আজ সাথে ছাতা নিতে হবে, তাই না? অনেক রোদ নাকি?

হ্যাঁ, ঐরকমই বলেছেন ম্যাডাম। চল যাই, আগে নাস্তা করে নেই। : নাস্তার পর হাতে তাহলে খানিকটা সময় পাওয়া যাবে।

চল তাহলে। যাওয়ার আগে এইখানে আর আসা হবে না।

কেন হবে না? আগামীকাল রওনা দেয়ার আগে আবার আসব। আর…

আর কী?

বিয়ে করে হানিমুনে আসবি না?

কী যে বলিস!

আমি অবশ্যই আসব। কক্সবাজারের মতো সুন্দর জায়গা আর নেই। আমার এত ভালো লেগেছে তোকে বুঝাতে পারব না। আমি হানিমুন এই কক্সবাজারেই করব। আর তুই রাশেদ ভাইকে…

ফাজলামি করিস না। চল যাই।

জেসমিন আর শান্তা যখন ফিরে যাচ্ছে, জেহান তখন চার হাত-পা টান করে শুয়ে আছে বালুর উপর। হঠাৎ তার কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে, বড় কষ্ট! তার মনে হচ্ছে এ জীবনে সে জেসমিনকে কখনো পাবে না, কখনোই না। আজ অনেক প্রস্তুতি নেয়ার পরও জেসমিনকে মনের কথা বলতে পারেনি। শুধু ‘আপু’ শব্দটা আজ সে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেনি। এই যা সাফল্য। কিন্তু তার এই সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে জেসমিনকে মনের কথা বলতে না পারার ব্যর্থতায়। তাই তো কিছুতেই সে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারছে না। চোখ দিয়ে পানি আসছে তো আসছেই, আর বিড়বিড় করে গাইছে,

প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়।

*

রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা দিল সবাই। এই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। কারণ আগামীকাল চলে যাবে তারা। যারা এসেছে তাদের প্রায় সবাই প্রথমবার এসেছে কক্সবাজারে, এজন্য আনন্দ-উচ্ছ্বাসটা তুলনামূলকভাবে বেশি। সন্ধ্যার পর থেকে অবশ্য জেসমিন খানিকটা চুপ হয়ে গেছে। কারণ আজ রাতে ডাক্তার হাডসন আবার আসবেন তার কক্ষে। পরতে বলেছেন। লাল শাড়ি, আর খোলা রাখতে বলেছেন জানালা।

নিজের কক্ষে আসার পর জেসমিন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। সে ঠিক বুঝতে পারছে না রাতে ডাক্তার হাডসনের তার কাছে আসার বিষয়টা সত্য না মিথ্যা। বাস্তবে সত্তর আশি বছর আগে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া একজন মানুষের তার কাছে আসা অসম্ভব। অথচ ডাক্তার হাডসন আসছেন এবং তার ব্যথা কমিয়ে দিচ্ছেন। বিষয়টা অলৌকিক বলেই তার ধারণা এবং সে জানে পৃথিবীতে অলৌকিক অনেক কিছু ঘটে। এজন্য ডাক্তার হাডসনের আগমনের বিষয়টিকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। তার থেকে বড় কথা, সে অনুভব করছে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতি তার ভালো লাগে। এই অনুভব বা উপলব্ধির ব্যাখ্যা কী তা সে জানে না।

দুটো শাড়ি এনেছিল জেসমিন। একটা লাল আর একটা নীল। নীলটা পরতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। ডাক্তার হাডসনের পছন্দকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত এমন ভাবনা থেকে নীল শাড়িটাকে উপেক্ষা করল। তবে ব্লাউজটা পরল নীল। যদিও লাল শাড়ির সাথে নীল ব্লাউজ ম্যাচিং করে না, তারপরও সে পরবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।

শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতে নিজেই অবাক হয়ে গেল জেসমিন। তাকে সত্যি সুন্দর লাগছে। এমনিতেই সে সুন্দর, সম্ভবত তার কলেজে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে সে নিজে। আশেপাশের ছেলেদের চাহনি আর কথোপকথনে বুঝতে পারে। তার বান্ধবীরাও বলে একই কথা। তবে আজ যেন তাকে বেশি সুন্দর লাগছে। কপালে টিপ পরবে কি পরবে না ভাবল কিছুক্ষণ। পরে বাদ দিল টিপ পরার সিদ্ধান্তটা। এসে দাঁড়াল বাইরের বারান্দায়। সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে শরীরে। দারুণ লাগছে, মনে হচ্ছে যেন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

আকাশটাও যেন আজ বড় সুন্দর। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মেঘগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি উজ্জ্বল। সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে জোছনা যেন বৃষ্টি হয়ে এসে পড়ছে ধরণির বুকে। সোনালি জোছনা, দারুণ লাগছে দেখতে।

জেসমিন ঘড়ি দেখল। রাত বারোটা বাজে। তার মানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। কিন্তু ডাক্তার হাডসনের কোনো দেখা নেই। কেমন যেন অস্থিরতা অনুভব করছে নিজের মধ্যে। তাহলে ডাক্তার হাডসন কি তার উপর রাগ করলেন? কেন করবেন? সে এমন কিছু করেনি যার জন্য ডাক্তার হাডসন তার উপর রাগ করতে পারেন। তার পছন্দমতো লাল শাড়িই তো পরেছে আজ। আর হ্যাঁ, ডাক্তার হাডসন যদি না আসে তাহলে কী-ইবা আসে যায়। ডাক্তার হাডসনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই যদি হয়, তাহলে কেন সে তার অপেক্ষায় আছে? কেন আর তার জন্য লাল শাড়ি পরেছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেল না জেসমিন। তার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। তাই আর বাইরে থাকল না, বারান্দা থেকে এসে ঢুকল কক্ষের মধ্যে।

জেসমিন শুয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে তোলা ছবিগুলো দেখল কিছুক্ষণ। ছবিগুলো দেখার পর ডাক্তার হাডসনের আগমনের জন্য সে যেন আরো বেশি উতলা হয়ে উঠল। তাকাল দক্ষিণের জানালার দিকে। জানালার ওপাশে বারান্দা। না নেই, ডাক্তার হাডসন নেই। অথচ তার আসার কথা, আজ এই রাতে!

একটা সময় বেশ হতাশ হয়ে পড়ল জেসমিন। অনুমান করল ডাক্তার হাডসন আর আসবেন না। এমন একটা ভাবনা দারুণভাবে মর্মাহত করল তাকে। তার মনে হতে লাগল আজ রাত তার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের রাত। এত কষ্টের যে সে সহ্য করতে পারছে না। কষ্টের তীব্রতা গতকালকের তলপেটের ব্যথার থেকেও বেশি। পার্থক্য শুধু, গতকাল ছিল শারীরিক কষ্ট আর আজ মানসিক।

হঠাৎ জেসমিনের মনে হলো নীল ব্লাউজ তার পরা ঠিক হয়নি। হয়তো এজন্যই রাগ করে আছেন ডাক্তার হাডসন। এমন মনে হতে ব্লাউজটা খুলে ফেলল শরীর থেকে। এখন শুধু ব্রেসিয়ার পরা। তার উপর লাল শাড়ি।

খাট থেকে উঠে জেসমিন এলো আয়নার সামনে। তার নিজেকে এখন অনেকটাই বিধ্বস্ত লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, কাঁধের উপর থেকে পড়ে গেছে শাড়ি। শাড়িটা আর আগের জায়গায় তুলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, এতটুকুও শক্তি নেই শরীরে। যে কোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে সে। ঘুরতে শুরু করেছে মাথাটা, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু।

আয়নায় হঠাই যেন দেখতে পেল ডাক্তার হাডসনকে। ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই ফর্সা চেহারা, নীল পাঞ্জাবি। নিজের আবেগকে আর আটকে রাখতে পারল না জেসমিন। উলটো ঘুরেই জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। তারপর আবেগভরা কণ্ঠে বলল, এত দেরি করলেন কেন আপনি?

ডাক্তার হাডসন বললেন, আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তুমি সত্যি আমাকে অনুভব করো কি না।

অবশ্যই করি, অবশ্যই করি। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না।

না, করো না।

মাথা উঁচু করে জেসমিন বলল, কী বলছেন আপনি!

সত্য বলছি। যদি আমাকে অনুভব করতে, তাহলে অবশ্যই আমাকে ‘তুমি করে বলতে।

জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, আ…আমি আপনাকে ‘তু…তুমি’ করে বলব!

হ্যাঁ বলবে, আমি চাই তুমি এখন থেকে আমাকে তুমি করে বলবে।

জেসমিন নিজের ঠোঁট কামড়ে একটু সময় নিল। তারপর দুই হাতে ডাক্তার হাডসনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আর তুমি কোনোদিনও দেরি করবে না।

ডাক্তার হাডসন উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বললেন, আমি দেরি করতে চাই না, কখনো না। তোমার কাছেই থাকতে চাই।

আমিও যে তোমাকে আমার কাছে রেখে দিতে চাই।

কথাগুলো বলতে বলতে জেসমিন নিজেই আলতোভাবে একটা চুমু খেল ডাক্তার হাডসনের মুখে। তারপর শরীরটাকে এলিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনের বুকের মধ্যে। ডাক্তার হাডসন তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এলেন খাটের উপর। তারপর শুইয়ে দিয়ে বললেন, জেসমিন, তুমি সুন্দর! অপূর্ব সুন্দর।

জেসমিন চোখ বন্ধ করে বলল, শুধু তোমার জন্য।

সত্যি!

হ্যাঁ, শুধু তোমার জন্য। এই তোমার জন্যই আমি আজ লাল শাড়ি পরেছি, দক্ষিণের জানালা খোলা রেখেছি। আমি চাই না, তুমি আর আমাকে ছেড়ে চলে যাও, এক মুহূর্তের জন্য না। আমি থাকতে চাই, থাকতে চাই তোমার ঐ বুকের মাঝে, হারিয়ে যেতে চাই তোমার ঐ গহিন ভালোবাসায়। আ…আ…আমি বোধহয়…

হ্যাঁ বলো জেসমিন। তুমি বোধ…হ…য়…

আ…আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেক অনেক ভালোবাসা…

তোমার ভালোবাসার স্পর্শ আমি অনুভব করছি।

জেসমিন দুই হাতে আবার জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। ডাক্তার হাডসনও নিজের মধ্যে টেনে নিলেন জেসমিনকে। জেসমিন অনুভব করল, তার ভালো লাগছে, অসম্ভব ভালো লাগছে। তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে, অনুভূতিও যেন স্বর্গীয়। ডাক্তার হাডসন যতই তার শরীর থেকে শাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন ততই ভালো লাগার অনুভূতিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এক সময় সে অনুভব করল, তার আর ডাক্তার হাডসনের মাঝে কোনো দূরত্ব নেই, নেই কোনো বাধাও। তারা দুজনে মিলে যেন একজন, শুধুই একজন। পরস্পরকে কাছে পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে নেই কোনো সংশয়, শঙ্কা কিংবা জড়তা। পরিপূর্ণ ভালোবাসার আনন্দে আজ দুজনেই তারা তৃপ্ত

*

শিক্ষা সফর শেষ। গাড়ি এসে থেমেছে কলেজে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান দেবে। জেসমিন গাড়ি থেকে নামলে এগিয়ে এলো জেহান। বলল, তোমার জন্য একটা রিকশা ঠিক করে ফেলেছি।

জেসমিন অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?

হু, উঠে পড়ো।

আমি কি তোমাকে রিকশা ঠিক করতে বলেছি?

জেহান বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, না।

তাহলে রিকশা ঠিক করলে কেন?

ইচ্ছে করলে গাড়িতে যেতে পার। আমার জন্য গাড়ি এসেছে।

তোমার গাড়িতে যাব কেন? না, আমি একাই যাব।

একটু থেমে জেসমিন আবার বলল, আচ্ছা জেহান, আমি লক্ষ করেছি। দুই-তিনদিন হলো তুমি আমাকে আপু ডাকছে না। ভাববাচ্যে কথা বলছ। কেন?

ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল জেহান। তাড়াতাড়ি বলল, না আপু, আসলে আমি তো তোমাকে আপুই ডাকি, আপু, আপু।

ঠিক আছে, দেখা হবে পরে, আসি তাহলে।

জেসমিন সামনে দাঁড়ানো আর-একটা রিকশায় গিয়ে উঠল। জেহান দেখল রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। জেসমিন রিকশায় উঠার পর রাশেদও উঠে বসল। তারপর হুড টেনে দিল। এখন খুব কাছাকাছি বসতে পারবে দুজন, আবার বাইরে থেকে কেউ দেখতেও পাবে না। সবকিছু দর থেকে দেখল জেহান। এভাবে জেসমিনের সাথে বসার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল তার, অথচ আজ রাশেদ সেই স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করে দিল। কী ভয়ানক কষ্ট।

এদিকে রিকশা চলতে শুরু করেছে। জেসমিন বলল, আপনি উঠেই গেলেন রিকশায়!

হ্যাঁ, উঠে পড়েছি। এখন থেকে আর রাখঢাক করার কিছু নেই।

কিন্তু সবাই দেখলে কী ভাববে?

ভাবাভাবির কী আছে। আমরা একজন অন্যজনকে পছন্দ করি, এই কথা সবাই জানলে তো দোষের কিছু নেই, তাই না?

না, না, এখন জানানো যাবে না। বাবা-মা সবাই খুব ঝামেলা করবে।

ঠিক আছে। তুমি যদি না চাও…

না, তা বলছি না, তবে বোধহয় আমাদের আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

আমি রাজি আছি, তোমার জন্য হাজার বছর ধৈর্য ধরতেও রাজি। আর আজকের জন্য ধন্যবাদ, কিছুক্ষণের জন্য হলেও তোমার পাশে বসতে পেরেছি। খুব শখ মোটরসাইকেলে তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও যাব। কবে যাবে তা আমাকে জানাবে। আসি আজ, রাতে ফোনে কথা হবে।

কথাগুলো বলে নেমে গেল রাশেদ। জেসমিন লম্বা শ্বাস নিল। রাশেদ পাশে বসায় আতঙ্কিত ছিল ঠিকই, তবে ভালোও লাগছিল। এখন নেমে যাওয়ায় স্বস্তি পাচ্ছে। আসলেই সে বাড়ির সবাইকে ভয় পায়। কেউ তাকে শিক্ষা সফরে আসতে দিতে চায়নি। জোর করে এসেছে। এতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু ভালোই কেটেছে। শেষ সময়ে এসে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তাই রাশেদ রিকশা থেকে নেমে যাওয়ায় আতঙ্ক কেটে গেছে।

জেসমিনরা থাকে তার দাদার বাড়িতে। দাদা এখন বেঁচে নেই। পৈতৃক সূত্রে যতটুকু জায়গা তারা পেয়েছে সেখানে ছোট্ট একটা অর্ধপাকা বাড়ি আছে। ঐ ঘরেই থাকে জেসমিন, তার বাবা, মা আর ছোট ভাই। বাবা মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সবাই হেডস্যার বলে ডাকে। মা নিলুফার ইয়াসমিন গৃহিণী, আর ছোট জমজ দুই ভাই জয় আর জনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তার মা নিলুফার ইয়াসমিন গৃহিণী হলেও শিক্ষিত এবং সবকিছু নিজের নখদর্পণে রাখেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, আদব-কায়দা, ভদ্রতার ব্যাপারে অতি সতর্ক তিনি। নিজে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন এবং সবাইকে বলতেও উদ্বুদ্ধ করেন। একসময় সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতেন, এখন আর সেই অভ্যাস নেই। সংসার আর আর্থিক সংকটের কারণে চর্চাগুলো কমে গেছে। তবে অভাবে থাকলেও সুখে আছে। তারা। তেমন কোনো ঝুটঝামেলা নেই পরিবারে।

কক্সবাজার থেকে বাড়ির সবার জন্যই ছোট বড় উপহার নিয়ে এসেছে। জেসমিন। উপহার পেয়ে দারুণ খুশি সবাই। জয় আর জনির জন্য এনেছে বড় সামুদ্রিক শামুকের খোল। খোলটা হাতে নিয়ে জয় বলল, এত বড় শামুকের খোল!

জেসমিন বলল, কানে লাগিয়ে দেখ, কোনো শব্দ হয় কি না।

শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে।

এই শব্দ সমুদ্রের গর্জনের শব্দ।

এবার জনি চোখ বড় বড় করে বলল, তাই নাকি!

সবাই তাই বলে। যখন সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে হবে শামুকটা কানে লাগিয়ে নিবি। দেখবি কী যে ভালো লাগবে। মনে হবে তুই সমুদ্রের পাড়ে আছিস। আর এই যে নে, বার্মিজ আচার। দশটা আছে। তোদের বন্ধু বান্ধবরে দিবি।

ঠিক আছে আপা।

বড় স্বাদের আচারগুলো।

দেখেই মনে হচ্ছে।

খালি দেখলে হবে নাকি, একটা খেয়ে দ্যাখ।

জয় আর জনি আচার মুখে দিয়ে বলল, উমম! তারপর দুজনেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দুজনের চেহারা হুবহু এক। জনির শুধু কপালে একটা দাগ আছে। ছোটবেলায় সিঁড়ি থেকে পড়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছিল। ঐ দাগটা স্থায়ী হয়ে গেছে। দাগের সুবিধা হলো, জনিকে চেনা যায় সহজে। তা না হলে দুজনের মধ্যে কে জয় আর কে জনি, চিনতে পারা বড় কঠিন। দুজনের একটা অভ্যাস, সবসময় একসাথে থাকবে, একই সাথে খেলবে, একই সাথে ঘুরতে যাবে। জমজ ভাই-বোনদের মধ্যে মিল থাকে ঠিকই। কিন্তু জয় আর জনির মিল যেন খানিকটা বেশিই।

জেসমিনদের বাড়িতে বড় বড় তিনটা ঘর। একটাতে তার বাবা-মা থাকেন, একটাতে থাকে সে। আর একটাতে জয় আর জনি। বাড়ির সামনে লম্বা একটা বারান্দা, বারান্দার এক কোনায় রান্নাঘর। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা ডাইনিং কাম ড্রইং রুমও আছে। সম্পূর্ণ বাড়িটা পাঁচফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে একটু ফাঁকা জায়গা আছে। ঐ জায়গায় ফুল আর সবজি চাষ করে জেসমিন। তাদের বাড়ির সাথেই লাগোয়া জেহানদের বিশাল দোতলা বাড়ি। জেহানের বাবা অনেক বড় কাপড়-ব্যবসায়ী। ঐ বাড়ির সবার সাথে তাদের সদ্ভাব আছে। তবে বড়লোক হলে যা হয়, পাত্তা দিতে চায় না আশেপাশের গরিবদের! জেহানের বাবা-মা খানিকটা অহংকারীও বটে! ইদানীং যেন অহংকারটা বেড়েছে। তবে জেহান ভালো এবং পরোপকারী, উপলব্ধি করে জেসমিন। আজ তার জন্য রিকশা ঠিক করে রেখেছিল। অথচ সে রিকশাটা নেয়নি, কাজটা যে ঠিক হয়নি বুঝতে পারছে সে। তবে এটাও সত্য, তাকে জিজ্ঞেস না করে জেহানের রিকশা ঠিক করা উচিত হয়নি। যাইহোক, জেসমিন সিদ্ধান্ত নিল পরে কথা বলে জেহানের মনোকষ্ট সে দূর করে দেবে। শত হলেও, জেহান তার প্রতিবেশী এবং বয়সে ছোট। ছোটদের প্রতি বড়দের একরকম দায়িতৃবোধ থাকা উচিত। এই দায়িত্ববোধ থেকেই সে অনুধাবন করছে, জেহানকে অহেতুক আর কষ্ট দেবে না।

জেসমিন রাতে ঘুমাতে গেল সাড়ে দশটার সময়। কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসার ভ্রমণে খুব ক্লান্ত ছিল সে। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়েও পড়ল। তবে হঠাৎ অনুভব করল সে একা নেই খাটে। আরো একজন আছে। যিনি আছেন তিনি আর কেউ নন, ডাক্তার হাডসন। নিজ বাড়িতে, নিজের কক্ষে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতিতে তার আতঙ্কিত হওয়ার কথা। কিন্তু সে আতঙ্কিত হলো না। বরং খুশিই হলো। মনে মনে যেন কামনা করছিল ডাক্তার হাডসনকে। তাই নিজেই মুখ গুঁজে দিল ডাক্তার হাডসনের বুকের মধ্যে। আর অনুধাবন করল, ধীরে ধীরে ডাক্তার হাডসনও তাকে টেনে নিচ্ছে হৃদয়ের একেবারে গভীরে।

*

তিন মাস পর।

কলেজ থেকে ফেরার পর হঠাই মাথা ঘুরতে শুরু করল জেসমিনের। একইসাথে তলপেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে লাগল। সাথে সাথে শুয়ে পড়ল বিছানায়। চিৎকার করে ডেকে উঠে মা, ও মা।

দৌড়ে এলেন নিলুফার। বললেন, কী হয়েছে?

পেটে খুব ব্যথা করছে মা।

কোথায়?

এখানে, এই যে তলপেটে।

হাত দিয়ে নাভির চারপাশটা দেখিয়ে দিল জেসমিন।

নিলুফার কিছু বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ মেয়ের এরকম পেটে ব্যথার কারণ কী হতে পারে? দেরি করলে সমস্যা হতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি খবর দিলেন জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেনকে।

প্যারাসিটামলে ব্যথা না কমায় নিয়ে আসা হলো কেরানীগঞ্জের হিউম্যানিটি ক্লিনিকে। সদ্য যোগদান করা মধ্যবয়সি গাইনির ডাক্তারকে পাওয়া গেল। নাম ফারজানা আক্তার। বেশ সময় নিয়ে তিনি পরীক্ষা করলেন জেসমিনকে। তারপর বাইরে এসে টেনে টেনে বললেন, আপনারা কি কিছু বুঝতে পারছেন?

জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেন অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে বুঝব? আমরা তো ডাক্তার না।

ডাক্তার না হলেও বোঝা যায়।

ঠিক বুঝলাম না।

বিয়ে হয়েছে কবে মেয়ের?

কী সব বলছেন আপা!

ফারজানা আক্তার খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কবে? আর তার স্বামীও বা কে?

নাজমুল হোসেন কিছু বলছেন না দেখে ফারজানা এবার হেসে দিয়ে বললেন, মিষ্টি খাওয়ান। আপনি নানা হতে চলেছেন।

আ…আ…

হ্যাঁ, আপনার মেয়ে প্রেগন্যান্ট।

কী সব বলছেন আপা! জেসমিন প্রেগন্যান্ট হবে কীভাবে? ওর তো বিয়েই হয়নি।

ডাক্তার ফারজানা ভ্রু কুঁচকে বললেন, তাহলে বোধহয় অন্য সমস্যা আছে। যাইহোক, আমি কিছু টেস্ট দিচ্ছি। করে ফেলুন।

কথাগুলো বলে ডাক্তার ফারজানা ডাক দিলেন পারুলকে। একটা কাগজে কয়েকটা টেস্ট লিখে দিয়ে বললেন, সাসপেকটেড প্রেগন্যান্সি কেস। টেস্টগুলো করে দ্রুত ফলাফল দিতে বলো।

তারপর আবার নাজমুল হোসেনের দিকে ফিরে বললেন, আমি দেখি টেস্টে কী পাওয়া যায়। রাত নয়টার পর জানতে পারবেন। এখনো পাঁচ ঘণ্টা বাকি। ইচ্ছে করলে অপেক্ষা করতে পারেন আবার বাসায়ও চলে যেতে পারেন। আমি ব্যথানাশক একটা ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি। আশা করছি পনের বিশ মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে। আর সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।

আধঘণ্টার মধ্যে জেসমিনের ব্যথা কমে গেল। তবে ব্যথা শুরু হয়ে গেল তার বাবা আর মায়ের বুকের মধ্যে। কী অবিশ্বাস্য কথা শুনে এলো তারা। ভাগ্য ভালো যে ডাক্তার কথাগুলো জেসমিনের সামনে বলেননি। সেক্ষেত্রে সর্বনাশ হয়ে যেত! নাজমুল হোসেন তার স্ত্রীকে বললেন, তুমি এখন কিছু বোলো না জেসমিনকে, আগে রিপোর্টগুলো আসুক।

আমি তো ভয়েই মরে যাচ্ছি। বুকটা কেমন কাঁপছে।

আমার ধারণা ডাক্তার কোথাও ভুল করছে।

অভিজ্ঞ ডাক্তার। ভুল করবে কেন?

হতে পারে। মানুষেরই তো ভুল হয়। যাইহোক, জেসমিন যেন কিছু জানে। আর বাইরের কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু অনুমান করতে না পারে।

তা পারবে কীভাবে?

জয় আর জনিও যেন জানে না কিছু। ওরা ছোট মানুষ, বুঝবে না। শেষে আবার উলটাপালটা কী বলে বসে!

না, না, জানবে না।

নাজমুল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগছে শরীরটা। এক কাপ চা দাও আমাকে।

দিচ্ছি।

চিনি দিও খানিকটা।

তুমি তো চায়ে চিনি খাও না।

আজ খেতে ইচ্ছে করছে।

সাথে আর কিছু দিব?

থাকলে দাও।

নিলুফার চায়ের সাথে বিস্কুটও দিলেন নাজমুল হোসেনকে। তবে বিস্কুট খেতে পারলেন না, খুবই খারাপ লাগছে তার। চায়ে দুই চুমুক দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলেন। দমটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে বিশুদ্ধ বাতাসের বড় অভাব। সারাটা জীবন তিনি সৎ পথে চলেছেন, লোভহীন একটা জীবন অতিবাহিত করেছেন। মূল লক্ষ্য ছিল শান্তি। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই ছিলেন। অথচ আজ তিনি কী শুনছেন! তার অবিবাহিত মেয়ে জেসমিন গর্ভবতী। বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছেন যেন প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টে এমন কোনো ফলাফল না আসে।

রাতে মসজিদে এশার নামাজ পড়লেন নাজমুল হোসেন। তারপর এলেন হিউম্যানিটি ক্লিনিকে। ডেলিভারি বুথ থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে আর ডাক্তারের কাছে গেলেন না। নিজেই দেখলেন রিপোর্টগুলো। স্পষ্ট লেখা

আছে, প্রেগন্যান্সি পজেটিভ, অর্থাৎ জেসমিন গর্ভবতী! নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। ডাক্তার এখন নেই। নিজের ভুল হতে পারে ভেবে কর্তব্যরত একজন নার্সকে দেখালেন রিপোর্টগুলো। নার্স দেখে মিষ্টি হেসে বলল, কার রিপোর্ট এগুলো?

আমার মেয়ের।

মিষ্টি খাওয়ান তাড়াতাড়ি। আপনি নানা হতে চলেছেন।

আ…আপনি কি সত্যি বলছেন!

জি সত্য বলছি।

নার্স রিপোর্টগুলো দিয়ে চলে গেল। নাজমুল হোসেন অনুভব করলেন তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ঘামছেন এখন, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। বুঝতে পারলেন জীবনে ভয়াবহ এক বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তিনি, বিপদ নয়! মহাবিপদ!

*

ডাক্তার তরফদার বসে আছেন তার চেম্বারে। তার সামনে একটি বাচ্চা বসা। বয়স নয় বছর, নাম ইকবাল। চোখ দুটো স্বচ্ছ নীল। দেখলে কেমন যেন মায়ার সৃষ্টি হয়। সাথে এসেছে তার মা রিতা। খুব অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। ডাক্তার তরফদার বললেন, ইকবালের সমস্যা কী?

রিতা চোখ বড় বড় করে বলল, স্যার মেলা বড় সমস্যা।

কী সমস্যা?

স্যার ও একবার যা দ্যাখে তা ভুলে না। সব মনে রাখবার পারে।

এটা তো ভালো লক্ষণ।

স্যার যা পড়ে সব মুখস্থ হইয়া যায়।

দারুণ ক্ষমতা!

কঠিন কঠিন শব্দ যা আমরা দ্বিতীয়বার মনে রাখবার পারি না ইকবাল সব মনে রাখবার পারে।

সত্যি?

জি স্যার।

তাহলে বলতেই হয় ইকবাল খুব ক্ষমতাবান। তো তুমি কী করো? আর ইকবালের বাবা কোথায়? সে কী করে?

স্যার ইকবালের বাবা একটা গার্মেন্টসে লাইনম্যান পদে চাকরি করে। আমি বাসায়ই থাকি। ঘর সামলাই। মাঝে সেলাইয়ের কাজ করবার চেষ্টা করছিলাম। ইকবালের এই অসুখের পর থাইকা আমি আর পারতেছি না, ওরে সামলাতেই আমার সময় চইলা যায়।

ইকবাল তো অসুস্থ নয়, তার কিছু ক্ষমতা আছে বলছ, এটা দোষের কিছু না। যাইহোক, আমি ইকবালের সাথে কথা বলি।

ডাক্তার তরফদার এবার ইকবালের দিকে ফিরে ডাক দিলেন, এসো বাবা, আমার কাছে এসো।

ইকবাল কোনো কথা বলল না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ডাক্তার তরফদারের দিকে।

ডাক্তার তরফদার মিষ্টি হেসে বললেন, কী নাম তোমার?

ইকবাল নিরুত্তর।

রিতা বলল, স্যার মাঝে মাঝে ও কথা বলে না। চুপ হইয়া যায়। কী যেন ভাবে। ওর ঐ দৃষ্টি দ্যাখলে আমার ভয় করে।

ডাক্তার তরফদার এবার নিজেই উঠে ইকবালের পাশের চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাকে কিছু কঠিন শব্দ বলব। তুমি মনে করতে পারো কি না আমি দেখব। যদি পারো বুঝব তুমি সত্যি অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। হ্যাঁ, এখন তাকাও আমার দিকে।

ইকবাল ডাক্তার তরফদারের দিকে তাকাল। ডাক্তার তরফদার বললেন, তুমি বলবে ‘সাইক্লো পেন্টানো পার হাইড্রো ফিনানথ্রিন’।

নিশ্চুপ ইকবাল।

ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি কী বলেছি, তুমি বলো।

ইকবাল একবার রিতার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, সাইক্রো পেন্টানো পার হাইড্রো ফিনানখ্রিন।

ডাক্তার তরফদার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি স্টেরয়েডের মূল রাসায়নিক স্ট্রাকচারের ‘মৌলিক রিং’-এর নাম বলেছিলেন। রসায়নের একজন ছাত্রের প্রথম প্রথম এই ‘মৌলিক রিং’-এর সঠিক উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়। আর নয় বছরের ইকবাল কিনা একেবারে সঠিক উচ্চারণটা বলল। তিনি বিস্মিত না হয়ে পারলেন না এবং বুঝলেন ইকবাল অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী।

এদিকে রিতা খুব উচ্ছ্বসিত। কারণ ইকবাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তার তরফদারের দিকে। ডাক্তার তরফদারের সামনে একটা কবিতার বই ছিল। বইটা হাতে নিয়ে তিনি ইকবালকে বললেন, আমি একটা কবিতা পড়ব। আমার পড়া শেষ হলে তুমি আমাকে মুখস্থ শোনাবে। ঠিক আছে?

ইকবাল আগের মতোই চুপ থাকল।

ডাক্তার তরফদার পল্লিকবি জসিম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম আট লাইন পড়ে শোনালেন ইকবালকে। তারপর বললেন, যতটুকু পড়েছি তুমি আমাকে শোনাও তো।

আটটা লাইন হুবহু মুখস্থ বলল ইকবাল।

ডাক্তার তরফদার কবিতার বই বন্ধ করে রিতার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, কবে থেকে ইকবালের এই ক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে?

স্যার ছয় মাস হলো। আমরা প্রথমে পাত্তা দেই নাই। এখন দেখতেছি, দিনে দিনে ও ওর ক্ষমতা দেখাইতেছে, আর কথা বলা কমায় দিতেছে।

কথার মাঝেই উঠে গেল ইকবাল। তারপর কাউকে কিছু না বলে ঢুকে গেল ভিতরের রুমে। ডাক্তার তরফদার তো অবাক। তবে তিনি ইকবালের পিছনে গেলেন না। বরং রিতাকে বললেন, তুমি যাও।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ইকবাল। তার হাতে পরির পায়েস। তিনটা বাটি এনেছে সে। একটা দিল তার মাকে, একটা ডাক্তার তরফদারকে। আর একটা সে খেতে শুরু করল।

ডাক্তার তরফদার বড়ই অবাক হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, এই বাসার অন্যতম স্বাদের খাবারটা ইকবাল নিয়ে এসেছে। কীভাবে বুঝল?

স্যার জানি না। ইদানীং ইকবাল অনেককিছুই বুঝবার পারে। এজন্য আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।

ভয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। ও ছোট মানুষ। ওকে অনেক অনেক ভালোবাসবে। সময় দেবে। আমি এই সপ্তাহের মধ্যে তোমাদের বাসায় একদিন আসব। এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না। শুধু একটাই পরামর্শ, সবসময় ইকবালের সাথে থাকবে, ইকবালকে আপন করে রাখবে।

কোনো ওষুধ দেবেন না স্যার?

কী জন্য?

ইকবালের ব্রেইনের ক্ষমতা যেন কইমা যায়, যেন আমাগো মতো হয়।

ইকবাল সুস্থ আছে। তার কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। আমি তাকে আরো পর্যবেক্ষণ করব। আর হ্যাঁ মনে রাখবে, ওষুধে নয়, মনের অসুখ মন দিয়ে সারাতে হয়। তবে এটা সত্য, ইকবাল অসুস্থ নয়।

জি স্যার, তারপরও আমি..

কথা শেষ করতে পারল না রিতা। ইকবাল উঠে আবার ভিতরে গেল। সেও গেল তার পিছন পিছন। বের হয়ে এলো কিছুক্ষণ পর। ইকবাল এবার একটা ব্যাগের মধ্যে অনেকগুলো পরির পায়েস নিয়েছে। পরি এখন দুইভাবে পায়েস তৈরি করে। পেয়ালায়, আবার ছোট ছোট মাটির বাটি কিংবা প্লাস্টিকের কাপে। প্রায় বিশটা পায়েস ভরা কাপ নিয়েছে ইকবাল। লজ্জিত ভঙ্গিতে রিতা বলল, স্যার, ফ্রিজের পাশেই একটা পলিথিনের ব্যাগ আছিল। একা একাই সে ব্যাগে ভইরা সবগুলা পায়েস নিয়া আইছে।

ডাক্তার তরফদার বললেন, ইকবালের পছন্দ হয়েছে, তাই নিয়েছে। দোষের তো কিছু নেই। ওকে নিতে দাও।

কী লজ্জার কথা!

লজ্জার কিছু নেই। আমি ওকে আরো পায়েস দেব।

ডাক্তার তরফদার চেয়ার থেকে উঠে এসে এবার ইকবালের দিকে ঝুঁকলেন। বললেন, তোমার যখন পায়েস খেতে ইচ্ছে হবে চলে আসবে। ঠিক আছে?

ইকবাল মিষ্টি হাসল। তারপর পা বাড়াল বাইরের দিকে। ভাবখানা এমন যেন সব সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিচ্ছে। তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে না। কিছুটা পথ এগিয়ে আবার ফিরে এলো সে। বলল, ডাক্তার তুমি বড় ভালো মানুষ।

রিতা ধমক দিয়ে উঠে বলল, ডাক্তার বললি ক্যান? স্যার বল। আর ‘তুমি’ কইরা বলতেছিস ক্যান? ‘আপনি’ কইরা বল।

তারপর রিতা ডাক্তার তরফদারের দিকে ফিরে বলল, স্যার, দ্যাখছেন, কত বড় বেয়াদব! আপনেরে ‘তুমি’ কইরা বলে!

এদিকে মায়ের ধমক খেয়ে ইকবাল বেশ ভয় পেয়েছে, নীল চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। সে একবার রিতার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। শুদ্ধ ভাষায় বলল, ডাক্তার, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।

ইকবালের কথা শুনে রিতা মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে, আবার ‘তুমি’ করে বলছে ইকবাল! সে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসল ইকবালের গালে। ইকবাল একেবারে চুপ হয়ে গেল।

ডাক্তার তরফদার রিতাকে ধমক দিয়ে বললেন, এসব কী করছো! ও ছোট মানুষ। এরকম আচরণ করতে আমি যেন আর না দেখি তোমাকে।

রিতা এবার হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর বলল, স্যার আমি ইকবালরে আগে কখনো মারি নাই। আইজই প্রথম মারলাম। আসলে নিজেরে নিয়ন্ত্রণ করবার পারি নাই, আমারে ক্ষমা কইরা দিবেন স্যার।

ডাক্তার তরফদার ইকবালকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, তুমি অনেক বুদ্ধিমান ইকবাল। আমি তোমাদের বাড়িতে এসে তোমার সাথে সময় কাটাব, গল্প করব। ঠিক আছে?

ইকবাল কিছু বলল না। তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে।

দেখে খুব খারাপ লাগল ডাক্তার তরফদারের, এদিকে রিতা তো কাঁদছেই। ডাক্তার তরফদার কী করবেন যখন ভাবছেন তখন দেখলেন ইকবাল বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সামনে একটা চেয়ারে সুন্দর চেহারার তেরো-চৌদ্দ বছরের একজন কিশোর বসে ছিল। সে এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল। তার হাতে একটা পায়েসের কাপ দিয়ে বের হয়ে গেল ইকবাল। রিতা তখন হাঁটতে শুরু করেছে ইকবালের পাশে। তার হাতে পায়েসের ব্যাগ।

ডাক্তার তরফদারের কাছে যে রোগী আসে তাদের অধিকাংশই আঠারো বছরের উপরে। আর অল্পবয়সিদের সাথে তাদের অভিভাবক থাকে। বসে থাকা ছেলেটির সাথে কোনো অভিভাবক নেই দেখে খানিকটা অবাকই হলেন তিনি। সামনে এসে বললেন, কী নাম তোমার?

লাজুক ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল, জেহান স্যার।

জেহান, আগে এই নাম শুনিনি। তোমার নামের কি কোনো অর্থ আছে?

জি স্যার আছে। জেহান শব্দের অর্থ উজ্জ্বলতা।

ও আচ্ছা। এসো, ভিতরে এসো।

জি স্যার।

আর কেউ নেই সাথে?

না স্যার।

কী করো তুমি?

পড়াশুনা করি। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে।

তাই নাকি। বয়স কত তোমার?

সতের বছর হতে আর একমাস বাকি

কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার বয়স তেরো-চৌদ্দ বছর। যাইহোক, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন, কারণ প্রকৃত বয়সের ছাপ তোমার চেহারায় পড়ছে না। অথচ মানুষ বয়স ধরে রাখার জন্য, নিজের চেহারা সুন্দর করার জন্য কত চেষ্টাই না করছে। পার্লারে যাচ্ছে, দামি কসমেটিকস ব্যবহার করছে, ভেষজ সামগ্ৰী শরীরে মাখছে, লেসার মেশিনের নিচে শরীর পেতে দিচ্ছে, ঠোঁট-নাক কেটে কসমেটিক সার্জারি করছে। অথচ মানুষ বুঝতে চায় না, মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য চেহারায় নয়, মনে। চেহারার কসমেটিক সার্জারির পরিবর্তে মনের শুদ্ধি সার্জারির গুরুত্ব অনেক বেশি। যাইহোক, এসো ভিতরে এসো, তোমার কথা শুনি।

ডাক্তার তরফদার ভিতরে প্রবেশ করে পিছনে ফিরলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন না জেহানকে। তিনি আবার বাইরে বের হয়ে এলেন। না নেই, জেহান নেই। অবাকই হলেন তিনি, এক কিশোর হঠাৎ এসে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল! তবে একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত, জেহান সুস্থ নয়, অসুস্থ। তার অসুস্থতার মাত্রা কী ধরনের কথা না বললে জানা যাবে না। অবশ্য একটা বিষয়ে তিনি আশাবাদী, জেহান আবার আসবে এবং অল্পদিনের মধ্যেই।

*

রাত সাড়ে নয়টা। জেসমিন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘরে প্রবেশ করলেন নিলুফার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকলেন, জেসমিন, জেসমিন!

জেসমিন মায়ের দিক মুখ ফিরিয়ে উলটো করে শুলো। নিলুফার বললেন, টেবিলে খাবার দিছি, খেতে আয়।

আমার ক্ষুধা নেই মা।

সেই দুপুরে কয়টা ভাত খেয়েছিস। আর কিছু খাসনি। না খেলে তো মারা যাবি।

না মা, আমার কিছু হবে না, তুমি নিশ্চিত থাকতে পার।

কীভাবে নিশ্চিত থাকব? যে বিপদ আমাদের পরিবারের উপর!

মা তুমি চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কীভাবে ঠিক হবে? বিয়ে করিসনি, পেটে বাচ্চা নিয়ে বসে আছিস! এই কথা মানুষজন জানলে মুখ দেখাব কীভাবে? তোর বাবা তো এখনই ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছে না। কে তোর এই সর্বনাশ করল! রাশেদ।

তু…তুমি রাশেদ ভাইয়ের কথা জানলে কীভাবে?

আমি আগেই জেনেছি। কানাঘুষা তাড়াতাড়ি ছড়ায়। যা হবার হয়েছে। তুই যদি চাস, তাহলে আমি রাশেদের সাথে কথা বলতে পারি।

কী কথা?

বিয়ে করে ফেলবি দুজন।

জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, এই বয়সে আমি বিয়ে করব।

আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। এই বয়সে বাচ্চা নিয়ে ফেলেছিস, বিয়ে করতে দোষ কোথায়? এখন না করলে পরে রাশেদের পরিবারও রাজি হবে না।

রাশেদ ভাইয়ের কথা বারবার আনছ কেন?

সে-ই তো তোর এই সর্বনাশ করেছে। তার কথা আনব না কেন?

না রাশেদ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই।

তাহলে তোর সন্তানের বাবা কে?

জেসমিন চুপ হয়ে গেল।

নিলুফার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই বলছিস না কেন? আর কত জিজ্ঞেস করব। জিজ্ঞেস করতে করতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেল।

জেসমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মা, তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

তুই তো সারাদিন একাই থাকিস। খাবার কি এই ঘরে দিয়ে যাব?

না।

আমি আসলে তোকে বুঝতে পারছি না। তোর উচিত আমাদের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। যেভাবে তুই গো ধরে বসে আছিস, তাতে আমাদেরই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যা খুশি কর, আর ভালো লাগে না। এই সংসার আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

রাগ করে চলে গেলেন নিলুফার। জেসমিন উঠে বাথরুমে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে নিল ভালোমতো। একটা বিষয় অবশ্য সত্য। মাঝে ক্ষুধা থাকলেও এখন তার ক্ষুধা কমে গেছে। খেতে ইচ্ছে করে না। না খাওয়ায় একটা সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, বমি হচ্ছে না। গত মাসে প্রায় প্রত্যেকদিনই বমি করত সে, খুব কষ্ট হতো। এখন আর অতটা হচ্ছে না। কষ্টটা একেবারে থাকে না যখন ডাক্তার হাডসন আসেন। রাতে দিনে যে কোনো সময় চলে আসেন তিনি। আজ জেসমিনের খুব ইচ্ছে করছে ডাক্তার হাডসনের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। তাই মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছে তিনি যেন রাতে আসেন। জেসমিন অবশ্য জানে। ডাক্তার হাডসন আসবেনই, কারণ এতদিন পর্যন্ত যখনই সে তাকে কামনা। করেছে তখনই তিনি এসেছেন। পৃথিবীতে এই একটা মানুষ কখনোই তাকে নিরাশ করেনি। প্রথম প্রথম ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে তার মিথ্যা বলে মনে হতো। কিন্তু যেদিন থেকে অনুভব করল সত্যি তার পেটে ডাক্তার হাডসনের সন্তান আছে সেদিন থেকে শতভাগ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বও সম্পূর্ণ সত্য। যদি সত্য না হতো, তার পেটে সন্তান আসবে কীভাবে? আর একটা বিশ্বাস তার জন্মেছে, তা হলো ডাক্তার হাডসন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তা না হলে এভাবে চাইলে তিনি তার কাছে আসতে পারতেন না। আর তিনি যখন আসেন, জেসমিন অনুভব করে তার আর কোনো দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থাকে না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয় সে।

জেসমিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। হঠাই হালকা বাতাসের ধাক্কায় কয়েকটা চুল এসে পড়ল তার মুখে। চোখ খুলে দেখে চারদিকে হালকা লালচে আলো। আর সেই আলোতে তারই পাশে বসে আছেন ডাক্তার হাডসন। সেই নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা। চোখ দুটোও নীল, গভীর সমুদ্রের টলটলে হালকা নীল পানির মতো, কী সুন্দর! খালি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। জেসমিনের ইচ্ছা তার সন্তানের চোখও নীল হবে, সমুদ্রের পানির মতো স্বচ্ছ নীল!

ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আজ তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব জেসমিন।

কোথায়?

হাডসন হিলে।

হাডসন হিল তো অনেক দূর! সেই কক্সবাজার।

হ্যাঁ, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আজ রাতটা তুমি আমার ওখানে থাকবে। তারপর শেষ রাতে আবার তোমাকে দিয়ে যাব।

আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?

অবশ্যই পারব। তবে একটা শর্ত আছে আমার।

কী শর্ত?

আমাকে তুমি করে বলতে হবে।

জেসমিন লাজুক ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কীভাবে ‘তুমি করে বলব আপনাকে?

বিষয়টা বয়সের নয়, শুধুই সম্পর্কের। তুমি আমাকে একবার ‘তুমি’ বলা শুরু করে আবার আপনি বলতে শুরু করেছ।

আপনি অনেক গুণী মানুষ। এরকম গুণী মানুষকে তুমি করে বলা ঠিক না। আমি পারব না, আপনাকে আপনি করেই বলব।

ডাক্তার হাডসন খানিকটা নিচে ঝুঁকে এলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, না, ‘তুমি’ করে বলবে, শুধুই ‘তুমি’।

না, না…

হ্যাঁ, ‘তুমি’, শুধুই ‘তুমি’। আগে একবার পেরেছিলে, আজও পারতে হবে এবং আজীবনের জন্য।

জেসমিন চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে টেনে টেনে বলল, তু…তু…মি, তু…তুমি…

এই তো হয়েছে। এখন তৈরি হয়ে নাও, লাল শাড়ি পরবে।

লাল শাড়ি!

হ্যাঁ, লাল শাড়ি।

ঠিক আছে।

জেসমিন লাল শাড়িটা পরল। তারপর হাত ধরল ডাক্তার হাডসনের। মুহর্তেই ভালোলাগার এক অজানা শিহরন খেলে গেল তার সমস্ত শরীরে। সে অনুভব করল যেন উড়ছে, হাওয়ায় উড়ছে।

জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন এখন হাডসন হিলে। খালি পায়ে প্রথমে তারা বালুতে নেমে এলো। জেসমিনের মনে হতে লাগল পৃথিবীতে আজকের চাইতে সুখের দিন বুঝি আর নেই। চারপাশটা কী সুন্দর! একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্র, চাঁদের আলোতে অপূর্ব লাগছে দেখতে। সমুদ্রের তীরে পড়ে থাকা পাথরটাকে আজ যেন একটু বেশি সুন্দরই মনে হচ্ছে। কেমন চকচক করছে। ঐ পাথরের উপরেই এসে বসল দুজন। সাগরের হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে মুখে। একেবারে জুড়িয়ে যাচ্ছে মনটা।

ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত নিজের মধ্যে নিয়ে বললেন, তুমি সুন্দর জেসমিন, অপূর্ব সুন্দর!

জেসমিন কিছু বলল না, শুধু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

তোমার কি ভালো লাগছে জায়গাটা?

উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল জেসমিন।

তুমি কিন্তু কথা বলছ না!

এবার জেসমিন মৃদুস্বরে বলর, কী কথা বলব?

ভালোবাসার কথা।

আমি বলতে পারি না। শুধু অনুভব করতে পারি।

অবশ্য এটা সত্য, ভালবাসা যতটা না বলতে পারার, তার থেকে অনেক বেশি হলে অনুভবের। মুখে বললেই ভালোবাসা হয় না, অনুভব করতে হয়। তুমি কি আমাকে অনুভব করো?

আবারো উপরে নিচে মাথা দোলাল জেসমিন।

হঠাৎই ঝাঁপটা একটা বাতাস এসে জেসমিনের চুলগুলোকে মুখের উপর নিয়ে এলো। ডাক্তার হাডসন হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন চুলগুলো। চুল সরাতে না সরাতেই আর একটা বাতাসের ঝাঁপটা জেসমিনের শাড়ির আঁচলটা কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দিল। এবার অবশ্য ডাক্তার হাডসন ঠিক করে দিলেন না আঁচলটা। জেসমিন নিজের হাত দিয়ে শাড়ি ঠিক করতে গেলে ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত ধরে বললেন, না, তুমি আমার, তোমার সবকিছুই আমার।

জেসমিন কিছু বলল না, নিজের মাথাটা এলিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনের কাঁধে। ডাক্তার হাডসন ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল জেসমিনকে। তারপর কাছে টেনে নিতে লাগল, অনেক অনেক কাছে!

*

রাত দুটা। জেহান বসে আছে তার ঘরে। ঘুম আসছে না। ইদানীং তার ঘুম আসে না। বড় অস্থিরতায় থাকে। মূল কারণ জেসমিন। সময় যত যাচ্ছে ততই জেসমিন তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। তাই জেসমিনকে হারানোর অজানা একটা ভয় কাজ করছে তার মধ্যে। নিজের ব্যর্থতার জন্য নিজেকেই দায়ী করে সে। কারণ এখন পর্যন্ত নিজের ভালোবাসা ভালোলাগার কথা বলতে পারেনি জেসমিনকে। বেশ কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে কেন যেন ভয় ভয় করে, মুখ থেকে কথা বের হয় না। শেষে অন্যকিছু বলে আসতে হয়, আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে পার করতে হয় দিনটা।

জেহান সবুজ রঙের ডায়ারিটা বের করল। এই ডায়ারিটা গোপনে সংরক্ষণ করে সে। ডায়ারির পাতায় পাতায় জেসমিনকে লেখা তার চিঠি। সে লেখে ঠিকই কিন্তু একটাও পাঠাতে পারে না। সেই আগের কারণ, কেমন ভয় ভয় করে, চিঠি পাওয়ার পর আবার কী ভাববে জেসমিন! আজও জেহান একটা চিঠি লেখা শুরু করল।

প্রিয় জেসমিন,
ভালোবাসা নিও। এখন রাত দুইটা। অথচ তোমার চিন্তায় ঘুম আসছে না। তুমি ইদানীং কেমন যেন চুপ হয়ে গেছ। বাড়ি থেকেও বাইরে বের হও না। কলেজে তো যাওই না। জানি না কী হয়েছে তোমার। আজ পুরো বিকেলটা বসেছিলাম ছাদে। আশা ছিল তুমি একবার তোমাদের বাগানে বের হবে। কিন্তু বের হওনি। অথচ আগে প্রত্যেক বিকেলে তুমি বাগানে কাজ করতে। গাছগুলোকে তুমি যখন পানি দিতে আর পশ্চিমের হেলে পড়া সূর্যের আলো তোমার মুখে এসে পড়ত, আমি তোমার সৌন্দর্যে সত্যি পাগল হয়ে যেতাম। কী সুন্দর তুমি! আমি শুধু তোমাকে দেখি আর দেখি! মনে হয় সারাটাদিন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি এত সুন্দর কেন! তুমি কি জানো তোমার হাসি আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেয়, আমার সমস্ত চঞ্চলতাকে স্থবির করে দেয়, আমি হয়ে পড়ে এক মূর্তি, ভালোবাসার মূর্তি। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি জেসমিন, দারুণ ভালোবাসি। অথচ সেই ভালোবাসার কথা তোমাকে বলতে পারছি না, বুঝাতে পারছি না। আমি অধম, সত্যি অধম। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমাকে বলব, আমার ভালোবাসার কথা তোমাকে বলব আর জয় করব তোমার মন। তারপর আমাদের জীবন হবে আনন্দের, বড় সুখের। তবে তুমি সত্যি পালটে যাচ্ছ, চুপচাপ থাকছ সবসময়। তোমাদের বাসায় গেলে খুব একটা কথাও বলো না, যদিও আগে বলতে। আমি অনুভব করি, তোমার কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। কেউ কিছু বলে না। হেডমাস্টার স্যার আর তোমার আম্মা দুজনকেও কেমন যেন চিন্তিত দেখায় সবসময়, কথা বলতে গেলে মনে হয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছি না কেন। তোমার এই মন খারাপ থাকা, বিষণ্ণ থাকা আমাকে এতটাই উদ্বিগ্ন করেছে যে আমি গিয়েছিলাম বিখ্যাত মনোচিকিৎসক ডাক্তার তরফদারের কাছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, তোমার বিষণ্ণতা কীভাবে দূর করা যায় তা জানা। আমি তার সাথে কথা বললেও তোমার বিষয়টা নিয়ে শেষ মুহূর্তে আর কথা বলতে পারিনি। কারণ আতঙ্কিত ছিলাম, যদি তিনি জিজ্ঞেস করেন তুমি আমার কী হও, তাহলে কী উত্তর দেব? আসলে আমি তোমার জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এই না-পারা আমার জীবনের আর-এক ব্যর্থতা। জানি না তোমার জন্য আমাকে কত হাজারবার ব্যর্থ হতে হবে। আমি তোমাকে চাই, মন থেকে চাই। সামনাসামনি না পারলেও মনে মনে ভোমার কাছে আবেদন করছি, নিবেদন করছি, তুমি আমার হও। জানি না, কত সহস্ত্র নিবেদনে হবে তুমি আমার। তবে এটা সত্য, তোমার জন্য ব্যর্থ হতে, হারতে আমার লজ্জা লাগে না, কষ্ট লাগে না। বরং এই ভেবে তৃপ্তি পাই যে আমি হারলেও হারছি আমার প্রিয়তমার জন্য।
শুভরাত্রি!
প্রিয়তমা আমার।

চিঠি লেখা শেষ করার পর মনের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রশান্তি অনুভব করছে জেহান। সবসময়ই সে লক্ষ করেছে যখন জেসমিনকে সে গভীরভাবে অনুভব করে, একটা চিঠি লিখলে শান্ত হয়ে উঠে মনটা। এখন কিছুটা হলেও ভালো লাগছে। তাই সে বিছানায় এলো। অনুভব করছে ঘুম দরকার তার, আজ সারাটা দিন অস্থিরতায় থাকায় ক্লান্তিও গ্রাস করেছে তাকে। তাই শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে জেসমিনদের বাড়িতে এলো জেহান। এই বাড়িতে আসার ক্ষেত্রে তার কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে বয়স যত বাড়ছে যাতায়াত ততই কমে আসছে। জেসমিন নিজেও আগে তাদের বাড়িতে আসত। ইদানীং আসে না বললেই চলে। গত ছয় মাসে তো একবারও আসেনি।

বাড়ির বারান্দায় দেখা হলো জয়ের সাথে। জয় মাথা উঁচু করে বলল, ভাইয়া, আমার চকলেট কোথায়?

জেহান পকেট থেকে চকলেট বের করে জয়কে দিলে। জয় খুশি হয়ে বলল, আমি জনিকে দিয়ে আসি।

ঠিক আছে, তোমার আপু কোথায়?

ঘরে আছে। তুমি যাও। আমি একটু আগে কথা বলে আসছি।

আর তোমার আম্মু?

রান্নাঘরে, ইলিশ মাছ রাঁধতেছে।

কথাগুলো বলতে বলতে জয় চলে গেল তাদের ঘরে। জনি ওখানে আছে।

জেহান এখন জেসমিনের ঘরের দরজার সামনে। মনে মনে ঠিক করল আজ সে ‘আপু’ সম্বোধন করবে না। আর পারলে নিজের ভালোবাসার কথাটাও বলবে, বলবে ডাক্তার তরফদারের কথা। এরকম একটা ভাবনা থেকে দরজায় টোকা দিল। তারপর ঢুকে গেল ভিতরে।

জেসমিন চেয়ারে বসে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, জেহান তুমি!

তোমার সাথে কথা বলতে এলাম। কলেজে যাচ্ছ না, বাইরে বের হচ্ছ না, কেন?

ম্লান হাসল জেসমিন। বলল, শরীরটা একটু খারাপ।

কী হয়েছে?

দুর্বল দুর্বল লাগে।

ডাক্তার দেখাওনি?

হ্যাঁ দেখিয়েছি, ওষুধও খাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে।

তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি খুব অসুস্থ। অনেকটা শুকিয়ে গেছ। চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে। কী ব্যাপার বলল তো!

জেহান, তুমি অত চিন্তা করো না। কলেজ কেমন চলছে?

ক্লাস তো হচ্ছে। কিন্তু সবাই জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছো? কিছু তো বলতে পারি না। আসলে তোমার অসুখটা কী তাও জানি না। টেবিলের উপর দেখছি আবার অনেক ওষুধ।

অধিকাংশই ভিটামিন আর আয়রন ট্যাবলেট। আর ঐগুলো যেগুলো দেখছ, ব্যথার ওষুধ, সাথে গ্যাস্ট্রিকের।

কীসের ব্যথা?

তলপেটে ব্যথা। কলেজে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে?

হ্যাঁ, ঐ ব্যথা না কমে গেল!

এখনো কমেনি। হঠাৎ হঠাৎ ওঠে। এত বেশি যে সহ্য করা যায় না, মনে হয়…

কী মনে হয়?

থাক ওসব কথা। তুমি কি আমার একটা উপকার করতে পারবে?

কী উপকার?

বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয়।

জেহান নড়েচড়ে বসে বলল, অবশ্যই করতে পারব। আর সবকিছু গোপনও রাখব। তুমি আমার উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারো।

জেহান এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন এরকম একটা মুহূর্তের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। একই সাথে সে অনুভব করছে, এখনই মোক্ষম সময়। নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা এই সুযোগে তার বলা উচিত। সে যখন এরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে বইয়ের ভাজ থেকে একটা খাম বের করে তাকে দিল জেসমিন। বলল, তুমি এই চিঠিটা রাশেদ ভাইকে দেবে।

জেহান তোতলাতে তোতলাতে বলল, রা…রা…রাশেদ ভাই!

হ্যাঁ, খুব অস্থিরতায় ভুগছেন উনি। আর বলবে যেন আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা না করে।

জেহান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। ডিজিটাল এই যুগে প্রেমের গভীরতা কত বেশি হলে চিঠির আদানপ্রদান সম্ভব! তার ইচ্ছে হলো বলতে যে সে চিঠি দিয়ে আসতে পারবে না, কারণ সে জেসমিনকে ভালোবাসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বলল। জেসমিন কষ্ট পাক এমন কিছু সে করতে চায় না, জেসমিনের সুখ আর শান্তিই তার মূল লক্ষ্য।

বাইরে আসতে দেখা হলো জেসমিনের মা নিলুফারের সাথে। তিনি বললেন, কখন এসেছ জেহান?

এই তো কিছুক্ষণ হলো খালাম্মা।

তোমার আম্মা কেমন আছেন?

ভালো।

যাব যাব করে যাওয়া হয় না তোমাদের বাড়িতে। দেখি একদিন যাব।

আসবেন খালম্মা।

একটু থেমে জেহান আবার বলল, একটা কথা বলি…খা…লাম্মা, জেসমিনের শরীর বোধহয় খুব খারাপ। একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালো একজন ডাক্তার দেখানো উচিত।

নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ডাক্তার দেখিয়েছি, লাভ হয়নি। একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞকে দেখাতে বলেছে ডাক্তার। তোমার হেডস্যার চেষ্টা করছে। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখাব। আসো, মুড়ি খাও, ঝালমুড়ি মাখিয়েছি।

না খালাম্মা, আজ খাব না। অন্য একদিন খাব। আসি।

সালাম দিয়ে বের হয়ে এলো জেহান। তার চোখে পানি। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তার নিজের পছন্দের মানুষের চিঠি কিনা তাকে পৌঁছে দিতে হবে তার চিরশত্রুর কাছে। কী অবিশ্বাস্য! তারপরও সে কাজটা করবে, করবে এই ভেবে যে সে কথা দিয়ে এসেছে জেসমিনকে।

*

নিলুফার রান্নাঘর গুছিয়ে শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন রাত দশটার দিকে। প্রথমে বিছানা গুছালেন তিনি। শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে তার। অবশ্য আজ, প্রায়ই ক্লান্ত লাগে। জেসমিন গর্ভবতী, এই সংবাদটা শোনার পর থেকেই মানসিক অবসাদ প্রতিদিনই বাড়ছে। এজন্য জোর পান না শরীরে। মন ভালো না থাকলে যে শরীর ভালো থাকে না এই সত্যটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন তিনি।

নাজমুল হোসেন ঘরে ঢুকলেন অনেকটা নিঃশব্দে। ওষুধের দোকানে গিয়েছিলেন তিনি। নিলুফার বললেন, ওষুধ পেয়েছ?

উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে নাজমুল হোসেন বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। এই যে ট্যাবলেট। আজ রাতে খাইয়ে দেবে। তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গর্ভপাত হবে।

নিলুফার কাঁপা হাতে লাল রঙের ওষুধ দুটো নিলেন।

নাজমুল হোসেন আবার বললেন, জেসমিন রাজি হবে তো?

রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে! কার সন্তান পেটে ধরেছে এখন পর্যন্ত বলল না। ঐ সন্তান জন্ম দিলে সমাজে মুখ থাকবে নাকি আমাদের? আজ সারাদিন তো ব্যথায় ভুগল। ক্লিনিকেও নিতে হয়েছে। কলেজে পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারল না। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন এই ওষুধ না খেয়ে উপায় কী?

আমার নিজের যতটা না কষ্ট হচ্ছে, ওর কথা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এই বয়সে কত বড় একটা ভুল করে ফেলল!

শুধু ওর দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সমাজেরও দোষ। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন, কম্পিউটারে ইউটিউব, টেলিভিশনে শুধু উলটাপালটা হিন্দি সিরিয়াল, এইগুলা দেখেই তো নষ্ট হচ্ছে সবাই।

তুমি ঠিকই বলেছ। তবে সমাজের কথা চিন্তা করে এখন আর লাভ নেই। আগে ঘর সামলাই। আমার কাছে সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।

শুধু এলোমেলো না, রহস্যও আছে এর মধ্যে।

কী রহস্য?

গত তিন মাসে আমি অনেকদিন সকালে জেসমিনকে লাল শাড়ি পরে শুয়ে থাকতে দেখেছি। ও রাতে ঘুমায় সালোয়ার কামিজ পরে, অথচ সকালে দেখি শাড়ি। কী অদ্ভুত! রাতে শাড়ি পরে ঘুমাবে কেন?

কই! আগে বলোনি তো!

ঠিক ঐভাবে সন্দেহ হয়নি। হয়তো ভেবেছিলাম শখ করে পরেছে। বিষয়টা কেমন যেন সন্দেহজনক।

রাতে কি তাহলে বাইরে যায়?

তা তো সম্ভব না। সামনের গ্রিলে তালা দেয়া থাকে। ওর ঘরের জানালায়ও গ্রিল লাগানো। বাইরে যাবে কীভাবে? আবার চাবিও তো থাকে আমাদের ঘরে।

তালার দুইটা চাবি, আর-একটা কোথায়?

ওটাও আমার কাছে।

তাহলে?

ঠিক বুঝতে পারছি না। ওর কাণ্ডকারখানা যেন কেমন! বাচ্চা পেটে, খুব যে টেনশনে আছে মনে হয় না। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও গায়।

নাজমুল হোসেন মাথা নেড়ে বললেন, না না, এভাবে বলো না। জেসমিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। লক্ষ করেছ?

হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের সবকিছু খুলে বলবে না! ওর আচরণে মনে হয় আমরা ওর শত্রু। আমরা যে ওর মঙ্গল চাই তা ও বুঝতে পারছে না।

এমন একটা বিষয়, কথা বলাও অস্বস্তিকর। যাইহোক, তুমি ওকে ওষুধ দুটো খাইয়ে দাও। ওষুধ খাওয়ানোর পর তলপেটে ব্যথা উঠতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে ওর উপর।

আমি তো চাই জেসমিনের ঘরে ঘুমাতে। জেসমিন রাজি হয় না। দেখি, আজকেও বলে দেখি।

কথাগুলো বলে ওষুধ হাতে নিলুফার এলেন জেসমিনের ঘরে। জেসমিন শুয়ে ছিল। জানালা দিয়ে দেখছিল বাইরের চাঁদ। নিলুফার আসলে নিজে থেকেই বলল, কী সুন্দর চাঁদ, দেখেছ মা?

হা, পূর্ণিমা বোধহয়।

আজ না, আগামীকাল।

বুঝলি কীভাবে?

চাঁদটা একটু ছোট ছোট মনে হচ্ছে।

রাতে বাইরে তাকিয়ে আছিস, ভয় করছে না?

কীসের ভয়?

কতকিছুর ভয়ই তো থাকে। তুই যেন ইদানীং বুঝেও অনেককিছু বুঝতে চায় না। শোন, ঝামেলা যা হবার হয়েছে। এখন সবকিছুর সমাধান করতে হবে। তোর বাবা ওষুধ নিয়ে এসেছে। এই ওষুধ দুটো খেয়ে নে।

জেসমিন অবাক হয়ে বলল, কীসের ওষুধ!

নিলুফার কোনো ভণিতা ছাড়াই বললেন, গর্ভপাতের ওষুধ। এই ওষুধ খেলে পেট খালি হয়ে যাবে। তখন তুই নিশ্চিন্ত হতে পারবি। আমরাও বেঁচে যাব।

কী বলছ এসব!

কী বলছি মানে!

আ…আমি একটা মানুষকে মেরে ফেলব!

মানুষকে মারছিস কোথায়? জন্মই তো হয়নি ওর।

হয়নি, তবে জীবন তত সৃষ্টি হয়েছে, হৃদস্পন্দন তো আছে। আমি কীভাবে একটা মানুষকে হত্যা করব!

নিলুফার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, গর্ভপাত মানুষ হত্যার জন্য না, তোর জন্য চিকিৎসা। তুই যা করছিস! নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি। এই যে নে পানি, ওষুধ দুটো খেয়ে নে। আর দুই-একদিনের মধ্যে তোকে একজন মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তোর বাবা ডাক্তার ঠিক করছে।

ঠিক আছে ডাক্তারের কাছে যাব। তবে ওষুধ এখন খাব না।

তো কখন খাবি?

পরে খাব। টেবিলের উপর রেখে যাও।

এখন খেলে কী হয়?

জেসমিন বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মা।

আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?

না। যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

কথা শেষ করে আবার চাঁদের দিকে মুখ ফেরাল জেসমিন। নিলুফার আর কিছু বললেন না! টেবিলের উপর ওষুধ আর পানি রেখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বড় অস্বস্তি লাগছে তার।

জেসমিন বিছানা থেকে উঠল আধ ঘণ্টা পর। তারপর টেবিল থেকে ওষুধ দুটো নিয়ে বাথরুমে গেল। বেসিনে ফেলে ছেড়ে দিল কল। দুটো ওষুধই গলে হারিয়ে গেল পানির মধ্যে।

জেসমিন মৃদু একটা হাসি দিল। এতক্ষণ নিজের মধ্যে একরকম আতঙ্ক কাজ করলেও কেন যেন এখন বড় ভালো লাগছে। আজ তার ইচ্ছে হচ্ছে লাল শাড়ি পরে ডাক্তার হাডসনের সাথে সময় কাটানোর। বলবে, তাকে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার জন্য। জায়গাটা তার বড় পছন্দের। যখনই যায়, তখনই ভালো লাগে। এই পর্যন্ত কতবার যে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। নির্জন পাহাড়ে সে আর শুধু তার প্রিয় ডাক্তার হাডসন! মাঝে মাঝে ভাবে সারাটাজীবন যদি ঐ হাডসন হিলে কাটিয়ে দিতে পারত।

ভাবনায় সুন্দর একটা ভালোলাগা নিয়ে চোখ বন্ধ করল জেসমিন। কতক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে ছিল বলতে পারবে না। ঠুক ঠুক শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকাল। তার ঘরের জানালার ওপাশে শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল বুঝি ডাক্তার হাডসন এসেছে। পরে যখন ‘জেসমিন, জেসমিন’ ডাক শুনল ভুল ভাঙল তার। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ।

জেসমিন অবাক হয়ে বলল, ভাইয়া আপনি!

হ্যাঁ। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। তাই আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না।

এত রাতে এসেছেন! এখন কয়টা বাজে!

সাড়ে বারোটা।

আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! শুকিয়ে গেছ অনেকটা, চোখের নিচে কালি পড়েছে।

মৃদু হাসল জেসমিন। তারপর টেনে টেনে বলল, এজন্যই আপনাকে চিঠিতে লিখেছি যে আমাকে ভুলে যান। আমার ভালোবাসা আপনার জন্য নয়। চিঠিটা কি দেয়নি জেহান?

হ্যাঁ দিয়েছে। ঐ চিঠি পেয়েই মন খারাপ হয়ে গেছে। তুমি আমার ফোন পর্যন্ত ধরছ না ইদানীং।

ঐ যে বললাম, আপনার জন্য আমার আর ভালোবাসা নেই ভাইয়া, আমার ভালোবাসা নীল চোখের ছায়ার জন্য।

নীল চোখের ছায়া!

হ্যাঁ। নীল চোখ।

কী সব বলছো জেসমিন!

সত্য বলছি। এজন্য অনুরোধ করব আর আমাকে ফোন করবেন না, চিঠি লিখবেন না। আমার কাছে কোনোদিন আসবেনও না। আমি সত্যি অন্য কারো হয়ে গেছি। আর এটাও সত্য, কখনো আপনার ছিলাম না, এখনো নেই। মাঝে হয়তো আপনার সাথে কথা বলেছি, রিকশায় উঠেছি, মোটরসাইকেলে ঘুরতে গিয়েছি…

শুধু ঘুরতেই যাওনি, আমরা দুজনে দুজনার…

জেসমিন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, প্লিজ ভাইয়া, যা কিছু ঘটেছে নিজের মধ্যেই রাখুন। আমি চাই না কোনো কারণে আপনি বিব্রত হন, আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক।

তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না জেসমিন।

প্লিজ আপনি যান। বাবা-মা এখনো জেগে আছে। যে কোনো সময় চলে আসতে পারে। আর-একটা কথা, কোনোদিনও এখানে আসবেন না। ভুলে যাবেন আমাকে, চিরদিনের জন্য। একটা কথা সত্য, আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না।

আ…আমি…

জেসমিন আবার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নিষেধ করল রাশেদকে। ফিসফিস করে বলল, আপনি চলে যান, সম্ভবত মা এদিকে আসছে, পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

রাশেদ আর কথা বলল না। চলে যাওয়ার জন্য লাফ দিয়ে পিছনের দেয়ালের ওপর উঠল। জেসমিন অবশ্য ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকল। নিলুফার ঢুকলেন ভিতরে। কপালে হাত রাখলেন জেসমিনের। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, আমার এত সুন্দর মেয়েটার কী যে হয়ে গেল!

*

জেহানের মনটা খারাপ। কারণ জেসমিন আজও পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। হিউম্যানিটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সারাদিন ওখানে ছিল। সন্ধ্যার পর নিয়ে আসা হয়েছে বাসায়। সে গিয়েছিল দেখতে। কিন্তু কথা বলতে পারেনি। কারণ ঘুমিয়ে ছিল জেসমিন। অথচ জেসমিনের সাথে তার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কয়েকদিন আগে যেদিন শেষ কথা হয়েছিল, রাশেদকে দেয়ার জন্য চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিল জেসমিন।

জেহান তার সবুজ ডায়ারিটাতে আবার লিখতে শুরু করল,

প্রিয় জেসমিন, মন ভালো নেই। কারণ, তোমাকে আজ দেখতে পেলাম না। তুমি অসুস্থ হলে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে যাই। কিছু ভালো লাগে না। শুধু মনে হয় তুমি কখন সুস্থ হবে আর তোমাকে দেখতে পাব। আজ তুমি পরীক্ষা দিতে পারলে না, তার মানে সামনের এইচএসসি পরীক্ষা তুমি দিতে পারবে না। বড় দুঃসংবাদ তোমার জন্য। তবে মন খারাপ কোরো না। আমি তো আছি। সামনে হয়তো আমাদের সাথেই তোমার ক্লাস করতে হবে। আমি নিশ্চিত করে বলছি, তোমাকে যত সাহায্য করতে হয় করব, তোমাকে ক্লাসনোট দেয়া, পড়া বুঝিয়ে দেয়া, অ্যাসাইনমেন্ট করে দেয়া সব আমার দায়িত্ব। ক্লাসের ফাঁকে তোমার সাথে সিঙ্গারা পুরি খাওয়ার আমার বড় শখ। দুজনে সিরাজ মামার দোকানে বসব আর সিঙ্গারা খাব। আমি কিন্তু তখন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। তুমি নিষেধ করতে পারবে না। সত্যি কথা কী, তোমার অবস্থান আমার মনে নয়, মনের অনেক অনেক গহিনে, যেখানে অন্য কেউ কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না। ঐ জায়গাটা শুধু তোমার, শুধুই তোমার। যখনই প্রয়োজন হবে, আমি তোমাকে বুকের ঐ গহিন থেকে বের করে আনব, তারপর দেখব, দেখব, আর দেখতেই থাকব। কেন জানো? তুমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর। তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো প্রিয়তমা আমার।

চিঠি লেখা শেষ করার পরও ঘুম আসছে না জেহানের। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে ছাদে উঠে এলো সে। হাঁটাহাঁটি করতে থাকল এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। জেসমিনদের বাড়ির প্রান্তে যখন আসে তখন প্রত্যেকবারই চোখ রাখে বাড়ির উপর, যদি একবার জেসমিনকে দেখা যেত। সে জানে জেসমিনকে দেখা যাবে না, তারপরও মন যে বারবার চায়!

হঠাৎই জেহানের চোখ পড়ল একজন পুরুষ বের হয়ে যাচ্ছে জেসমিনদের বাড়ির পিছনের দেয়াল ডিঙিয়ে। প্রথমে মুখটা দেখা না গেলেও পরে যখন পিছন ফিরল তখন দেখা গেল। আর কেউ নয় রাশেদ। এত রাতে রাশেদ এখানে ভাতেই ভাঙা মনটা আরো ভেঙে গেল জেহানের। তার মানে রাতে রাশেদকে বাড়িতে আসতে দিচ্ছে জেসমিন। কী অবিশ্বাস্য! যে জেসমিন আজ অসুস্থ, ক্লিনিকে ছিল সারাদিন, পরীক্ষা দিতে পারেনি, এমনকি সে নিজে গিয়েও দেখা করতে পারেনি, সেই জেসমিন কিনা আজ রাতেই কথা বলছে রাশেদের সাথে। নিশ্চয় ফোনে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভাবতেই শরীর কাঁপতে শুরু করল জেহানের। ভয়ংকর এই কষ্টটা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ছাদেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে লাগল পানি। সিদ্ধান্ত নিল আজ সে কাঁদবে, যতক্ষণ ইচ্ছা হবে কাঁদবে। কেঁদে কেঁদে নিজের বুকের কষ্ট লাঘব করবে।

জেহান কতক্ষণ ছাদে বসে ছিল বলতে পারবে না। একসময় নিচে এলো, তারপর আবার টেনে নিল ডায়ারিটা। লিখতে শুরু করল,

প্রিয় জেসমিন, তুমি ভাবছ অন্যের প্রতি তোমার ভালোবাসা থাকলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যাবে। না মোটেও না। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বড় নিখাদ, বড় খাঁটি। দিন যত যাবে এই ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকবে। জানি না বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। দুঃখ, এই ভালোবাসা তোমাকে দেখাতে পারছি না। তুমি আমাকে ভালোবাসো বা নাই বাসো, অন্তত আমার ভালোবাসাটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম, তাহলে অন্তত মনে শান্তি পেতাম। তুমিও বুঝতে পারতে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে কতটা ভালোবাসতে পারে, ভালোবাসার তীব্রতা আর গভীরতা কত দূর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, আমি নিজেকে তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারি না, বারবার ব্যর্থ হই। তুমি কি একবারের জন্য হলেও আমাকে বুঝতে পারো না? বুঝতে পারো না যে, তোমারই বাড়ির পাশের কেউ একজন তোমাকে দারুণ ভালোবাসে, তার হৃদয়ে শুধু তুমি, তুমি আর তুমি। একবার, শুধু একবার যদি তুমি বুঝতে পারতে আমি যে কী খুশি হতাম! যাইহোক, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারো, সেই অধিকার তোমার আছে। আমি তোমাকে নিষেধ করব না। তবে মনে রেখো, যাকে তুমি ভালোবেসেছ সে যদি তোমাকে ছেড়ে চলেও যায় আমি তোমাকে ঠিকই ভালোবাসব। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিনও কমবে না, কোনোদিনও না, শুধু বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে। এত বাড়বে যে হিমালয় পেরিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, আকাশ পেরিয়ে মহাকাশ, তারপর দূরে আরো দূরে… তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার ব্যাপ্তি সীমাহীন, প্রিয়তমা আমার।

চিঠি লেখা শেষ করার পর জেহান ডাইনিং রুমে এলো। পানি খেল এক গ্লাস। দেখল তার মা মরিয়মও ঘুম থেকে উঠেছেন। জেহানকে দেখে বললেন, কী রে, ঘুমাসনি?

না মা।

কেন?

ঘুম আসছে না।

কী বলছিস! কী হয়েছে?

জানি না মা, তুমি কি আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে?

আহারে আমার ছেলেরে! তোকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলে কাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। চল, চল।

শুয়ে পড়লে মরিয়ম জেহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। জেহান একসময় বলল, মা, আমি যদি তোমার কাছে কোনো সাহায্য চাই করবে?

অবশ্যই করব। কী হয়েছে তোর, বল তো।

কিছু হয়নি।

কিছু একটা তো হয়েছে। তা না হলে সাহায্যের কথা বলবি কেন?

বললে রাখবে কি না বলো?

আমি তোর মা। রাখার মতো হলে অবশ্যই রাখার চেষ্টা করব। কী হয়েছে বল!

জেহান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তার মাকে জেসমিনের কথা বলবে। যা থাকে কপালে হবে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। বলল, মা আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে আছে, নাম হাবিব। হাবিবের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক টাকা লাগবে চিকিৎসা করতে। তুমি কি ওকে আপাতত হাজার দশেক টাকা দিতে পারবে?

মরিয়ম মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করছিস! আমি তোর নানাকে বলে দিচ্ছি। তুই তো জানিস তোর নানা ডাক্তার আর তার ক্লিনিকও আছে। ওখানে হাবিবের ফ্রি চিকিৎসা করা হবে। আর দশ হাজার টাকা কালই তোকে দিয়ে দেব। তুই হাবিবকে দিয়ে আসিস। আরো যদি কিছু করা লাগে, বলবি। এটা তো ভালো উদ্যোগ, আমি চাই তুই এইসব ভালো উদ্যোগের সাথে থাকবি।

জেহান তার মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। মরিয়ম ভাবলেন তার সন্তান বড় খুশি হয়েছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পেলেন না যে কী অসম্ভব এক কষ্ট ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে জেহানের হৃদয়টা!

*

পড়ন্ত বিকেল।

ডাক্তার ফারজানা আক্তারের কাছে এসেছেন নাজমুল হোসেন। সকালে এসেছিলেন তার স্ত্রী আর জেসমিনকে নিয়ে। আলট্রাসনোগ্রাম করতে দিয়েছেন তিনি। সকালেই করিয়েছেন, তবে রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। ডাক্তার ফারজানাকে রিপোর্ট দেখিয়ে তারপর তিনি বাসায় যাবেন।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর যখন নিশ্চিত হলেন ডাক্তার আসবেন তখন বেশ অস্থির হয়ে পড়লেন নাজমুল হোসেন। কী করবেন ভাবতে শুরু করলেন। পারুল নামের যে নার্স সবসময় সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে তাকে রিপোর্টগুলো দেখালেন নাজমুল হোসেন। পারুল আগে থেকেই চিনত নাজমুল হোসেনকে, তিনি যে স্কুলের হেডমাস্টার তাও জানত। বলল, স্যার, পেটের সন্তান তো বড় হয়ে গেছে!

নাজমুল হোসেন তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না…

রিপোর্ট যে ডাক্তার লিখেছেন উনার মতামত তো প্রেগন্যান্সিরই। আর এই যে পেটের ভিতরের ছবি দেখুন, বাচ্চাটা বেশ বড় হয়েছে। মাথা, শরীর বোঝা যাচ্ছে।

এখন আমি কী করব?

অ্যাবরশনের জন্য যে ওষুধ দিয়েছিলাম সেগুলো খাওয়াননি।

না, খাওয়াইনি।

সর্বনাশ, সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা বড় হয়ে গেলে অ্যাবরশন মানে গর্ভপাত আর সম্ভব হবে না।

আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

ফারজানা ম্যাডাম বোধহয় আর আসবেন না।

আসবেন না মানে!

ম্যানেজমেন্টের সাথে সকালে তার ঝগড়া হয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন আর আসবেন না। ফোনে কথা বলতে পারেন। কিন্তু লাভ হবে না। রিপোর্ট না দেখে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।

অন্য কোনো ডাক্তার কি দেখানো যাবে?

আর কোনো গাইনির ডাক্তার নেই। আসলে কি জানেন স্যার, কেরানীগঞ্জে কোনো ডাক্তার থাকতে চায় না। সবাই থাকতে চায় ঢাকায়।

আমি তাহলে কী করব?

আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি আপনার মেয়ের পেটের সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখতে দেবেন, কি দেবেন না। পরিবারের সবার সাথে কথা বলুন। যদি জন্ম দিতে চান তাহলে নিয়মিত চেকআপ করাবেন। আর যদি না দিতে চান, দুই-একদিনের মধ্যেই গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দেবেন। আমি আবার ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সিদ্ধান্ত আপনার। যত দেরি হবে, বিপদ তত বাড়বে। তখন হাসপাতালে ভর্তি করানো ছাড়া উপায় থাকবে না।

কথাগুলো বলে পারুল একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিল।

নাজমুল হোসেন বাসায় ফিরলেন রাত নয়টার দিকে। হাতে ওষুধ। মন খারাপ করে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। তারপর বাসায় ফিরেছেন। সবকিছু শোনার পর নিলুফার বললেন, আমাদের কিছু করার নেই এখন। ওষুধ খাওয়াতেই হবে জেসমিনকে। বড় বেয়াড়া হয়ে গেছে। ও। আমার কানে আজ একটা কথা এসেছে।

কী কথা?

রাশেদ নামের যে ছেলেটার সাথে ওর সম্পর্ক হয়েছিল তার সাথে মোটরসাইকেলে দূরে নাকি ঘুরতেও গিয়েছিল কয়েকবার।

নাজমুল হোসেন চোখ বড় বড় করে বললেন, কে বলল তোমাকে এই কথা?

আমাদের বাসায় যে রহিমা বুয়া কাজ করে, সে বলেছে।

তার মানে জেসমিনের পেটে যে বাচ্চা আছে তা রহিমা বুয়াও জানে!

অনেকেই জেনে গেছে।

কী সর্বনাশ!

এই কথা দিনের পর দিন লুকিয়ে রাখবে কীভাবে? তবে আমি এখনো স্বীকার করিনি কারো কাছে। স্বীকার করা যাবে না। তার আগেই ওষুধ খাইয়ে কলেজে পাঠাতে হবে জেসমিনকে। তা না হলে সন্দেহ বাড়তেই থাকবে।

তুমি কি নিশ্চিত হয়ে বলছ যে রাশেদের সাথে অনেক দূরে ঘুরতে যেত জেসমিন?

হ্যাঁ। সন্ধ্যায় আমি জেসমিনের বান্ধবী শান্তাকে ডেকেছিলাম। ওর কাছ থেকেও শুনেছি।

শান্তা কি জানে বাচ্চার কথাটা?

সরাসরি আমার সাথে কথা হয়নি। তবে আমার ধারণা ও অনুমান করতে পেরেছে।

নাজমুল হোসেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেয়ারে বসে বললেন, আমার যে কী হবে? স্কুলের ছেলেমেয়েরা জানলে আর হেড মাস্টারগিরি থাকবে না। বড় বিপদে পড়ে যাব।

তুমি অত ভেবো না। আজ আমি ওকে ওষুধ খাওয়াবোই খাওয়াবো।

নাজমুল হোসেন আর কোনো কথা বললেন না। শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বড় ক্লান্ত লাগছে তার নিজেকে। নিলুফার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, খাবে না?

ক্ষুধা নেই।

মন খারাপ কোরো না। আমি একটা ব্যবস্থা করছি। আশা করছি আমাদের আপদ-বিপদ সব দূর হয়ে যাবে। কেন এ কথা বলছি জানো? জ্ঞাতসারে আমরা কখনো কোনো অন্যায় করিনি। আশা করছি বড় ধরনের কোনো বিপদে আমরা পড়ব না।

মুদু হাসলেন নাজমুল হোসেন। বললেন, আমরা তো মহাবিপদের মধ্যে আছি।

এই বিপদ থেকে আল্লাহই আমাদের উদ্ধার করবেন। আমি খাবার গরম করছি, তুমি খাবে। তারপর আমি যাব জেসমিনের কাছে। জেসমিনও রাতে খায়নি। ওকেও খাওয়াতে হবে।

জেসমিন অবশ্য রাতে খেল না। ওষুধ খাওয়ার কথা বলাতে প্রচণ্ড রেগে উঠল। নিলুফারও ছাড়লেন না আজ। বললেন, তুই যদি ওষুধ না খাস, তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি। তোর জন্য আজ আমাদের মানসম্মান সব শেষ!

এবার জেসমিন কিছু বলল না, চুপ করে বসে থাকল।

এই যে পানি, ওষুধ খা।

আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকল জেসমিন।

নিলুফার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। ঠাস করে একটা চড় কষালেন জেসমিনের গালে। তারপর পানি আর ওষুধ এগিয়ে দিলেন। জেসমিন এবারও ওষুধ নিল না। শুধু তার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।

হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে শুরু করল নিলুফারের। তিনি জীবনেও জেসমিনের গায়ে হাত তোলেননি। আজ প্রথম তুললেন। ভয়ানক এক কষ্টে মুষড়ে উঠল বুকটা। আর অপেক্ষা করলেন না, ফিরে এলেন নিজের কক্ষে। নাজমুল হোসেন তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে বুঝলেন ওষুধ খায়নি জেসমিন। মনটা তারও খারাপ হয়ে গেল। তাদের সংসারটা যে ধ্বংস হতে চলেছে তা এখন সম্পূর্ণই উপলব্ধি করছেন তিনি।

নাজমুল হোসেন কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলতে পারবেন না। তার ঘুম ভাঙল পাশের বাড়ির জেহানের চিৎকারে। সে চিৎকার করে বলছে, সবাই বের হয়ে আসেন, বের হয়ে আসেন, জেসমিন আত্মহত্যা করতেছে, আত্মহত্যা করতেছে।

জেহানের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে বের হয়ে এলো সবাই। দেখল বাড়ির সামনে যে আমগাছটা আছে সেই আমগাছের সাথে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করছে জেসমিন। নিচে একটা চেয়ার। চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে জেসমিন। এখন ঝুলতে শুরু করেছে শরীরটা।

নাজমুল হোসেন জেসমিনের কাছে পৌঁছানোর আগে জেহান পৌঁছাল। দুই পা ধরে উপরের দিকে উঁচু করে ধরল জেসমিনের শরীর যেন গলায় চাপ না পড়ে। নাজমুল সাহেব কাছে আসতে বলল, স্যার, আমি ছাদে হাঁটতেছিলাম, হঠাৎ দেখি আত্মহত্যা করছে জেসমিন।

জেসমিনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন নাজমুল হোসেন। এর মধ্যে আশেপাশের অনেকেই জেগে গেছে। তাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কেন জেসমিন আত্মহত্যা করতে গেল?

*

কয়েকদিন পর জেহান কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে। পথে দেখল রাশেদ তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছে। জেহান বিশ্বাস করে জেসমিনের বর্তমান অবস্থার জন্য রাশেদই দায়ী। কারণ সে রাতে রাশেদকে জেসমিনদের বাড়ি থেকে গোপনে বের হয়ে আসতে দেখেছে। কিন্তু জেসমিন কেন সবকিছু সবাইকে বলে দিচ্ছে না ঠিক বুঝতে পারছে না।

জেহান, জেহান!

ডাক দিল রাশেদ।

রাশেদের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তারপরও পা বাড়াল জেহান।

কেমন আছো তুমি?

ভালো ভাইয়া।

তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।

হ্যাঁ, বলেন।

রাশেদ জেহানকে নিয়ে খানিকটা সরে এলো যেন তাদের কথা কেউ শুনতে না পায়। তারপর চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী অবস্থা জেসমিনের?

আপনি খোঁজ নিচ্ছেন না কেন? ওকে তো আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এভাবেই বলতে ইচ্ছে হলো রাশেদের। তবে সে বলল না। রাশেদকে কিছুটা হলেও ভয় পায়। কারণ রাজনীতি করতে শুরু করেছে। সে। ইদানীং কিছু গুন্ডা টাইপের তোক নিয়ে ঘুরে। শেষে বলল, ভালো না, আজ একজন মানসিক ডাক্তারকে দেখাবে।

জেসমিন কি পাগল হয়ে গেছে?

না, হয়নি।

আমার মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। তা না হলে মানসিক ডাক্তার দেখাবে কেন? কয়েকদিন আগে নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। তুমি তাকে বাঁচিয়েছ।

হ্যাঁ।

অত রাতে তুমি জানলে কীভাবে যে সে আত্মহত্যা করবে?

আমি ছাদে হাঁটছিলাম।

প্রতি রাতেই কি তুমি ছাদে হাঁটো?

না।

তাহলে যেদিন জেসমিন আত্মহত্যা করবে সেদিনই হাঁটছিলে। কীভাবে এতটা মিলল? তুমি কি আগে থেকে জানতে যে আত্মহত্যা করবে জেসমিন।

কী যা তা বলছেন ভাইয়া! আমি জানব কীভাবে?

রাশেদ টেনে টেনে বলল, তুমি ছোট মানুষ। সবকিছু জানার চেষ্টা করবে না। আর মনে রাখবে, অল্পবয়সে সবকিছু জানা ভালো না। তোমার কাজ পড়াশুনা করা, পড়াশুনা করবে। ঠিক আছে?

জি ভাইয়া।

আমি আগে কখনো জেসমিনদের বাড়িতে যাইনি। ভাবছি একবার যাব। কখন গেলে ভালো হয়?

জেহান বুঝতে পারল ডাহা মিথ্যা কথা বলছে রাশেদ। সে নিজে রাশেদকে দেখেছে জেসমিনদের বাড়ি থেকে বের হতে। তাও গভীর রাতে। আর আজ কিনা বলছে সে আগে কখনো জেসমিনদের বাড়িতে যায়নি।

রাশেদ আবার বলল, তুমি কি একটু কথা বলতে পারবে জেসমিনের সাথে? আমি সত্যি তার সাথে দেখা করতে চাই।

তাকে ফোন করেন।

ফোন ধরছে না।

আমার সাথেও তো কথা হয় না।

তারপরও তোমার বাসা তো পাশেই।

আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।

তুমি তাহলে আমাকে জানাবে। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব। আসলেই তুমি খুব ভালো জেহান। এজন্যই তোমাকে এতটা পছন্দ করি। চলো ঐ দোকানে যাই, চা খাই।

না ভাইয়া, আমি চা খাব না। আসি।

আমাকে ফোন দেবে কিন্তু।

আচ্ছা ভাইয়া।

জেহান মাঝে মাঝে গাড়িতে করে কলেজে আসে। আজও গাড়ি এনেছে। গাড়িতে উঠে হাঁপাতে লাগল সে। হাঁপানোর কারণটা অবশ্য বুঝতে পারছে। রাশেদকে সে ভয় পেতে শুরু করেছে। দুটো কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ রাশেদ রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার পর থেকে খানিকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, আর দ্বিতীয় কারণ হয়তো রাশেদ অন্যায় করতে শুরু করেছে। প্রথম অন্যায় করেছে জেসমিনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। এ কারণেই জেসমিন আজ প্রেগন্যান্ট। খবরটা সে ভাসাভাসা শুনেছে, নিশ্চিত নয়। ঠিক করেছে, জেসমিনের সাথে দেখা করতে পারলে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে। তবে এটা সত্য জেসমিনের পেটটাকে হালকা উঁচু মনে হয়েছে তার। আর এর জন্য রাশেদই যে দায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশেদ এখন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে একটা প্রশ্ন উঠছে, রাশেদ আবার কেন কথা বলতে চাচ্ছে জেসমিনের সাথে? হিসাবগুলো মিলছে না। আর হিসাব না মিললে সে অস্থির হয়ে ওঠে। এজন্য তার মধ্যে অস্থিরতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

জেহান বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর দুপুরে ঘুম দিল। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মোবাইল ফোনের রিং-এর শব্দে ঘুম ভাঙল তার। ফোন করেছে জেসমিন। জেসমিনের ফোন দেখে হাত-পা কাঁপতে শুরু করল তার। ফোন ধরতে, ওপাশ থেকে জেসমিন বলল, কেমন আছো?

ভা…ভালো। তুমি!

তোমাকে ধন্যবাদ জেহান। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ।

ইয়ে… মানে…

তুমি না থাকলে হয়তো আমার লাশটা এতদিন পচে-গলে যেত।

কিছু বলতে গিয়েও পারল না জেহান, চুপ থাকল।

জেসমিন বলল, তবে কি জানো?

কী?

আমাকে তুমি বাঁচাতে পারবে না।

কী বলছ আপু?

সত্য বলছি।

আ…আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। তুমি তো বেঁচেই আছ। এখানে বাঁচা…

হ্যাঁ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করব। তুমি আর কতক্ষণ ঠেকাবে আমাকে?

তু…তুমি আত্মহত্যা করবে কেন?

আমার বাবা-মা আমার জন্য বড় কষ্টে আছে। জয় আর জনি এখনো বুঝতে পারছে না, তবে এটা সত্য, ওরাও একসময় কষ্ট পাবে আমার জন্য। আসলে কি জানো, আমার কিছু করার নেই, আমি… বড় অসহায়… আমি পারছি না… আর পারছি না…।

কথার মাঝেই কেঁদে উঠল জেসমিন। তারপর লাইন কেটে দিল।

জেসমিনের ফোন পাওয়ার পর খুব অস্থির হয়ে পড়ল জেহান। সে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠল। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না জেসমিনকে। একবার ভাবল জেসমিনদের বাড়ি যাবে। পড়ে বাদ দিল সেই চিন্তাটা, তার কেন যেন মনে হচ্ছে ইদানীং জেসমিনদের বাড়ির কেউ চায় না তাদের বাড়িতে অন্য কেউ আসুক।

জেহান আরো কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর পা বাড়াল বাইরে।

*

ডাক্তার তরফদার মানিকগঞ্জ এসেছেন। উদ্দেশ্য একজন রোগী দেখা। রোগীর বাড়িতে আছেন তিনি, নাম হামিদ। একটা ঘরের মধ্যে তার দুই হাত শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোমরেও একটা শিকল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিন ভাই, এক বোন তারা। ভাইদের মধ্যে হামিদ ছোট। অন্য দুই ভাই তার কোনো খবর রাখে না। বোনই মূলত দেখাশুনা করে হামিদকে। হামিদের প্রিয় একটা কাজ হলো বাঁশি বাজানো। তার একটা বাঁশের বাঁশি আছে। পাশেই থাকে। মাঝে মাঝে বাজায়। বড় করুণ সুর ঐ বাঁশির। কলেজে একটা অনুষ্ঠানে তার ঐ বাঁশির সুর শুনেই তার প্রেমে পড়েছিল ‘শিরিন’।

ডাক্তার তরফদার হামিদকে দেখা শুরু করেছেন বছরখানেক হলো। তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। তিনি সবসময় আসতেও পারেন না। আবার হামিদের বোন হুশনারও এমন আর্থিক সংগতি নেই যে তাকে ঢাকা নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করাবে। তাই ডাক্তার তরফদার মাঝে মাঝে আসেন। আজ শেষ রাতে হঠাৎই তার হামিদের কথা মনে পড়ে। তখনই রওনা দেন মানিকগঞ্জের উদ্দেশে।

হামিদের বোন হুশনার বিয়ে হয়েছে পাশের বাড়িতে। এজন্য হুশনা যত্ন নিতে পারে হামিদের। অন্য দুই ভাই একই বাড়িতে থাকলেও তাদের অতটা সহমর্মিতা নেই যতটা আছে হুশনার। আগে হামিদের মা হামিদের যত্ন নিত, কিন্তু বছর তিনেক হলো সে মারা গেছে। তারপর থেকে হুশনাই দেখাশুনা করছে হামিদের।

হামিদের যে আচরণ তাতে তাকে প্রচলিত সমাজে ‘পাগল’ বলবে সবাই। ডাক্তার তরফদারের কাছে সে ক্রনিক এন্ড কমপ্লেক্স সিজোফ্রেনিয়ার (Chronic and Complex Schizophrenic) রোগী। তাকে সুস্থ করা সত্যি দুরূহ কাজ। তারপরও ডাক্তার তরফদার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে অবস্থা কিছুটা ভালো, মানুষ চিনতে পারে। তবে যে কোনো সময় আবার অবনতি হতে পারে। যখন মানসিক অবস্থা খুব খারাপ থাকে তখন সবাইকে সে ‘শিরিন মনে করে। শিরিন ছিল উপজেলা শহরের এক মেয়ে যাকে হামিদ ভালোবাসত। একই কলেজে পড়ত তারা। শিরিনের বাবা সরকারি কাজের জন্য এখানে বদলি হয়ে এসেছিলেন। শিরিন ভর্তি হয়েছিল হামিদদের কলেজে। প্রেমের সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছিল তাদের। কিন্তু শিরিনের বাবা-মা রাজি না হওয়ায় একুশ বছর আগে বিয়ে হয়ে যায় শিরিনের। তারপর থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে হামিদ। কয়েকবার শিরিনের শ্বশুড়বাড়ি সিলেট গিয়েও বিরক্ত করেছিল। একবার শিরিনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রচণ্ড মারপিট করে হামিদকে। দুইমাস হাসপাতালে থাকার পর মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয় তার। যে কোনো মেয়েকে দেখলেই সে ‘শিরিন’ মনে করা শুরু করে। তার হাত ধরে প্রেমের কথা বলতে থাকে। থানায় অভিযোগ পড়তে থাকে। মামলাও হয় কয়েকটা। তবে ‘পাগল’ বলে খালাস পেয়ে যায়। শেষে সিদ্ধান্ত হয় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার। সেই কারণে আজ অবধি প্রায় বিশ বছর ধরে শিকল বন্দি হামিদ। মাঝে মাঝে হুশনা তাকে ঘরের বাইরে নেয়। তাও অল্প সময়ের জন্য।

হামিদ সবসময় একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে থাকে। টুর নিজ পর্যন্ত বিস্তৃত প্যান্টটা। একটা মাদুর আছে বসে থাকা আর শোয়ার জন্য। প্রস্রাব-পায়খানার বোধশক্তি তার আগে ছিল না। তবে ডাক্তার তরফদার চিকিৎসা করে বুঝাতে পেরেছেন যে তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ঘরের মধ্যেই একটা মালশা আছে, ওখানেই সে প্রাকৃতিক ডাকের কাজগুলো সারে। আর এগুলো পরিষ্কার করে হুশনা। একজন বোন যে ভাইয়ের কতটা আপন হতে পারে, হুশনাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

হামিদকে দেখতে এলে ডাক্তার তরফদার সাথে করে ডালিম নিয়ে আসেন। কারণ ডালিম হামিদের খুব প্রিয়। হামিদ ডালিমের ভক্ত হয় শিরিনের সাথে সম্পর্কের সময়। শিরিনের পছন্দ ছিল ডালিম। শিরিন নাকি প্রায়ই তাকে ডালিম উপহার দিত। শিরিনের দেয়া ডালিম বড় যত্ন করে খেত সে।

ডাক্তার তরফদার আজও ডালিম নিয়ে এসেছেন। ডালিম কেটে দিলে খাবে না হামিদ। আস্ত দিতে হবে। নিজে ভাঙবে, তারপর একটা একটা করে রোয়া খাবে। লাল একটা রোয়া মুখে দিয়ে হামিদ বলল, স্যার বড় মিষ্টি।

ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার মজা লাগছে।

হামিদ মাথা দুলিয়ে বলল, জি স্যার, মেলা মজা। আমি যখন স্যার সুস্থ হবো, তখন কী করব জানেন স্যার?

কী করবে?

বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সবজায়গায় ডালিম গাছ লাগাব, শত শত ডালিম গাছ, হাজার হাজার ডালিম গাছ, লাখ লাখ ডালিম গাছ। বাংলাদেশ হবে ডালিমের বাংলাদেশ, লাল লাল ডালিম। ডালিমগুলা পাইকা গাছে ঝুইলা থাকবে। আমি শিরিনরে মেলা ডালিম দিব, মেলা। আর কারে দিব জানেন স্যার?

না জানি না।

আপনেরে দিব। তয় বেশি না, একটা।

ডাক্তার তরফদার কিছু বললেন না। কেন যেন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। হামিদের বলার ধরনটা একেবারে শিশুর মতো।

হামিদ আবার বলল, স্যার আর একজনরে দিব।

কে সে?

আমার মায়েরে দিব, মা।

তাই নাকি?

জি স্যার। মা প্রত্যেকদিন আমারে দেখবার আসে। ডালিম নিয়া আসে। তয় আমার জন্য ডালিম কিনতে মায়ের বড় কষ্ট হয়। ক্যান, জানেন স্যার? মায়ের অভাব। গরীব মানুষ তো, অত টাকাপয়সা নাই। মায়ে মেলা ভালো। আসলে কি জানেন স্যার? সব মা-ই ভালো। মায়ের মুত্যু হইলেও সন্তানের পাশে থাকে, যতদিন সন্তান বাঁইচা থাকে তারে আঁচলের নিচে আগলায় রাখে। সব সন্তানেরা বুঝবার পারে না, আমি পারি।

ডাক্তার তরফদারের কী যে হলো তিনি বলতে পারবেন না। তার চোখে পানি চলে এলো। মাঝে মাঝে তিনি প্রকৃতির উপর খুব রাগ হন। প্রকৃতি পৃথিবীর সুন্দর মনের মানুষগুলোকে এত কষ্ট দেয় যে সহ্য করা যায় না। হামিদের তেমন কোনো দোষ নেই, দোষ ছিল শুধু একটাই সে শিরিনকে ভালোবেসেছিল। তাই আজ বিশটি বছর শিকলবন্দি সে। তার থেকেও কষ্টের তার স্বপ্ন কোনোদিন হয়তো পূরণ হবে না। কারণ তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। কিছুক্ষণ আগে রক্তে গ্লুকোজ মেপেছেন তিনি। গ্লুকোজের মাত্রা চব্বিশ। ক্রনিক ডায়াবেটিসের রোগী সে। হার্টের অবস্থাও ভালো না। হৃদস্পন্দন অনিয়মিত। সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোনো ওষুধ হামিদ খাবে না। এজন্য দিন যত যাচ্ছে অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে।

হঠাই হামিদ ডেকে উঠল, স্যার!

বলল হামিদ।

স্যার আমার একটা কথা শুনবেন?

কী কথা?

আগে বলেন শুনবেন।

আচ্ছা শুনব।

আমারে একটু শিরিনের কাছে নিয়া যাবেন। মেলা দিন হইল তারে দেখি না, আমারে না দেইখাও হে বড় কষ্টে আছে।

ঠিক আছে নিয়ে যাব।

কবে নিবেন স্যার?

আমি শিরিনের সাথে কথা বলে নেই।

জি স্যার, বলেন। ঐ দিন আমারে একটা সুন্দর কাপড় কিনা দিবেন। আসলে কি জানেন স্যার, আমি তারে কত ভালোবাসছি আপনেরে বুঝাবার পারব না।

তুমি শিরিনকে অনেক ভালোবাস, তাই না?

তারে আমি মেলা ভালোবাসি, মেলা। আমার বুকের মইধ্যে খালি তার জন্যই সব ভালোবাসা, সব স্যার।

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাই ডুকরে কেঁদে উঠল হামিদ। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যার আমার মনে বড় কষ্ট, আমার একটা সুন্দর কাপড়ও নাই স্যার। শিরিন যদি দ্যাখে আমার কোনো ভালো কাপড় নাই, কী যে কষ্ট পাবে! আমি তারে কষ্ট দিবার চাই না স্যার, কষ্ট দিবার চাই না। আমার খুব শখ তারে আমি একটু বাঁশি বাজায় শুনাব। আমার বাঁশি বড় পছন্দ করত সে। কতদিন আমার বাঁশি শুনে না। কী যে কষ্টে আছে স্যার, আপনেরে বুঝাবার পারব না।

ডাক্তার তরফদার কী বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। হামিদকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন। হামিদের প্রত্যেকটা কথা তার বুকের মধ্যে বিধে। তার এরকম কিছু রোগী আছে যাদের জন্য তিনি অনেককিছু করতে চান। অথচ কিছু করতে পারেন না। মেডিক্যাল সায়েন্স, সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, প্যারাসাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, সার্জিক্যাল সায়েন্স, স্পিরিচুয়াল সায়েন্স, মেডিটেশনাল সায়েন্স, ফিজিওথেরাপি সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই রোগীরা। একজন ডাক্তার হিসেবে একজন রোগীর জন্য কিছু করতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা ঐ ডাক্তার ছাড়া আর কেউ বোঝে না। কিন্তু ডাক্তার তরফদার মাঝে মাঝে অনুধাবন করেন, বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতি তার ক্ষমতা দিয়ে মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দেয় যে প্রকৃতির কাছে মানুষের বিজ্ঞান বড় তুচ্ছ।

হামিদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে হামিদ পানি খেতে চায় না। ডাক্তার তরফদার নিজেও অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। একপর্যায়ে হামিদ খানিকটা রেগে ডাক্তার তরফদারের দিকে বোতলও ছুঁড়ে মারল। ডাক্তার তরফদার তারপরও চেষ্টা করে গেলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিফলই হতে হলো তাকে। একজন মানুষের দৈনিক যেখানে দুই লিটার পানির প্রয়োজন হামিদ সেখানে এক গ্লাস পানিও খেতে চায় না। এটা খুব খারাপ লক্ষণ।

ডাক্তার তরফদার যখন বিদায় নিলেন হামিদ তখন তার বাঁশিতে সুর তুলল,

প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়।

এক বুক কষ্ট নিয়ে ডাক্তার তরফদার বাসায় ফিরে এলেন। গেট দিয়ে প্রবেশের সময় দেখলেন সুন্দর চেহারার একটা ছেলে বসে আছে বারান্দায়। তিনি কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলল, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমার নাম জেহান, আগে একবার এসেছিলাম।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কয়েকদিন আগে তুমি কিছু বলতে এসেছিলে আমাকে। না বলেই চলে গিয়েছিলে।

জি স্যার।

আসো ভিতরে আসো।

আচ্ছা স্যার।

ডাক্তার তরফদার ঘড়ি দেখলেন। বিকেল চারটা। মানিকগঞ্জ থেকে তার আরো আগে ফেরার কথা ছিল। পারেননি এ কারণে যে গাবতলীতে খুব জ্যাম ছিল। ঘণ্টাতিনেক ওখানেই নষ্ট হয়েছে।

ডাক্তার তরফদার জেহানকে বসিয়ে রেখে হাত-মুখ ধুতে গেলেন। এসে দেখেন জেহান নেই। তবে একটা চিঠি রেখে গেছে সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে খুললেন সাদা খামের চিঠিটা। ভিতরে টানা টানা অক্ষরে লেখা,

স্যার,
আমার সালাম নিবেন। ক্ষমা করবেন এই কারণে যে আপনার সাথে সামনাসামনি সব কথা বলার সাহস আমার নেই। কারণ আপনি অনেক বড় মানুষ। অনেক সুনাম আপনার। সেই তুলনায় আমি একেবারেই নগণ্য, ক্ষুদ্র। আমার থেকে ক্ষুদ্র মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর নেই। যাইহোক, স্যার আবারো সালাম নিবেন। আমি চিঠি লিখছি আমার নিজের জন্য নয়। একজনের জীবন বাঁচানোর জন্য। তাকে বাঁচানোর জন্য আপনার সাহায্য বড় প্রয়োজন। যদি অসহায় এক মেয়ের জীবন বাঁচাতে চান, তাহলে স্যার চিঠির উলটো পাশে লেখা নম্বরে আমাকে ফোন করবেন। আমি জানি আপনি ফোন করবেনই করবেন। কারণ আপনি চান না কেউ আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যাক। আপনি বড় উদার আর ভালো মনের মানুষ। এখন থেকে প্রত্যেকটি মুহূর্ত আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকব। বিষয়টি অতীব জরুরি।
ইতি
জেহান

ডাক্তার তরফদার চিঠিটা পরপর তিনবার পড়লেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দুই মিনিট সময় নিলেন। চিঠিটা ছোট হলেও যে খুব গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে পারছেন তিনি। তা না হলে জেহান কখনোই তার কাছে আসত না, আগেও সে তার কাছে এসেছিল। তিনি ঠিক করলেন আত্মহত্যার ঘটনাটা প্রতিহত করবেন। তাই ফোন করলেন জেহানের চিঠির উলটো পাশে দেয়া ফোন নম্বরে। পরপর তিনবার ফোন করে যখন ফোন নম্বরটা বন্ধ পেলেন তখন সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বিতীয় কোনো উপায়ে জেহানকে তার খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

শুধু ফোন নম্বর থেকে ঠিকানা বের করতে হলে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন কোম্পানি কিংবা পুলিশের সহায়তা লাগবে। যদিও জেহান লিখেছে যে ফোনটি তার, তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে ফোনটি অন্য কারো কি না। প্রতারণা বা হয়রানির বিষয়টাও মাথায় রেখেছেন ডাক্তার তরফদার। সেক্ষেত্রে যার ফোন নম্বর তার ঠিকানা খোঁজা সমীচীন হবে না।

সবকিছু বিবেচনা করে ডাক্তার তরফদার থানায় আসাটাকেই যৌক্তিক মনে করলেন। থানার ওসি সাহেব আগে থেকেই তাকে চেনেন। সবকিছু শুনে একটা আবেদন চাইলেন ওসি সাহেব। ডাক্তার তরফদারের আবেদনের ভিত্তিতে একটা জিডি হলো। ওসি সাহেব বললেন, স্যার চিন্তা করবেন না, আমি মোবাইল ফোনের মালিকের ঠিকানা আপনাকে দেব। প্রয়োজনে পুলিশও আপনাকে সাহায্য করবে। তবে আমাদের কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন।

ডাক্তার তরফদার রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। রিকশা থেকে নামার পর তার কেন যেন বড় ক্লান্ত মনে হলো যুবকবয়সি রিকশাওয়ালাকে। ইচ্ছা করেই এক শ টাকা বেশি দিলেন। তারপর বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বড় ক্লান্ত তুমি, খুব কি খারাপ লাগছে?

মনটা ভালো নাই স্যার।

কেন?

সারাদিন খালি কাম আর কাম। সকাল থাইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাড়ির সবাইর শুধু চাওয়া আর চাওয়া। এই চাওয়া-পাওয়ার যেন শ্যাষ নাই স্যার। ভাবখানা এমন যেন আমি তাগো জন্য কিছু করি নাই। অথচ স্যার যা আয় হয় সবই ব্যয় করি সংসারের জন্য।

মৃদু হাসলেন ডাক্তার তরফদফার। তারপর বললেন, মানুষ তোমার কাছ থেকে কী পেয়েছে সেই হিসাব তোমাকে সাধারণত সে দেবে না, তোমার কাছ থেকে কী কী পায়নি সেই হিসাব তোমাকে বারবার শোনাবে।

একটু থেমে ডাক্তার তরফদার আবার বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে পানিশূন্যতা রয়েছে তোমার শরীরে। দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি খাওয়ার নিয়ম। তুমি রিকশা চালাও, পানি আরো বেশি খেতে হবে তোমাকে। পানি শরীরকে যেমন ঠান্ডা রাখে মনে এনে দেয় প্রশান্তি। ভালো থেকো।

গেটের ভিতর ঢুকলেন ডাক্তার তরফদার। সারাদিন বড় ব্যস্ততায় কেটেছে তার। ক্লান্তও লাগছে। বাড়ি ফিরে দেখেন দুজন রোগী বসে আছে। তাদের সাথে কথা শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে নিলেন। তারপর আবার ফোন করলেন জেহানকে। না, ফোন বন্ধ। তিনি নিশ্চিত হলেন বড় ধরনের কোনো রহস্য আছে জেহানের কার্যক্রমে। এই রহস্যটা তাকে ভেদ করতেই হবে।

*

হাডসন হিলে ডাক্তার হাডসনের হাত ধরে হাঁটছে জেসমিন। হাডসন হিলকে আজ বেশি সবুজ মনে হচ্ছে। চারদিকে ছোট বড় প্রত্যেকটি গাছে নতুন পাতা। এ যেন সবুজের মেলা! জেসমিন বলল, আজ এত সবুজ কেন চারপাশটা?

ডাক্তার হাডসন বললেন, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ছোট ছোট গাছগুলো সতেজ হয়ে উঠেছে। এজন্য সবুজ লাগছে সব।

আগে হাডসন হিল কখনো এতটা সবুজ ছিল না।

তা ছিল না। এতটা সুন্দরও ছিল না।

না না, হাডসন হিল সবসময় সুন্দর।

হয়তো, তুমি যেদিন প্রথম এসেছ সেদিন থেকেই বেশি সুন্দর।

জেসমিন ডাক্তার হাডসনের চোখে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। ডাক্তার হাডসন বললেন, সত্যি জেসমিন তুমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর! তুমি

আমার জীবনটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছ।

তাই বুঝি!

হ্যাঁ।

তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসছ না কেন?

তুমি কি থাকতে পারবে এই পাহাড়ে, গুহার মধ্যে? মাঝে মাঝে ভয় পাই। বড় কষ্ট হবে তোমার।

তুমি থাকতে পারলে আমি পারব না কেন?

হয়তো পারবে। তবে এখানে বেঁচে থাকাটা একেবারে সহজ না। আমি তো আছি বহুদিন ধরে। তো প্রায় সত্তর আশি বছর। ভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবে তোমাকে নিয়ে আসব, দ্রুতই নিয়ে আসব। আর…

আর কী?

ডাক্তার হাডসন টেনে টেনে বললেন, তোমার সন্তানের পরিচর্যা দরকার। এখানে এই জায়গায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এজন্য ভাবি চিকিৎসার অভাব হয় কি না।

তুমি ডাক্তার। তুমি থাকতে চিকিৎসার ঘাটতি হবে কেন?

শুধু ডাক্তার থাকলে হবে না। ওষুধপত্র, সরঞ্জামাদি থাকতে হবে। তবে তোমাকে নিয়ে আসার কথা ভাবছি। তোমাকে অবশ্য ধৈর্য ধরতে হবে। অধৈর্য হয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে, এটা ঠিক না।

আসলে মায়ের কথায় বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। সহ্য করতে পারছিলাম না আর, ঐদিন আশা করছিলাম তুমিও পাশে থাকবে। কিন্তু তুমি এলে না। তাই একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।

হতাশা মানুষকে শেষ করে দেয়। হতাশ হবে না। সামনে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

জেসমিন খানিকটা অস্থির হয়ে বলল, আমি আর বাড়ি থাকতে চাচ্ছি না। বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে। করে না।

কেন?

জানি না, আমি সত্যি এখানে চলে আসতে চাই। তোমার কাছে।

ডাক্তার হাডসন মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, সময় হলেই নিয়ে আসব, চলো আজ তোমাকে পাহাড়ের উপর নিয়ে যাব।

পাহাড়ের উপর।

যে পাহাড়টার নিচে আমাদের গুহা ঐ পাহাড়টার চুড়ায় উঠার একটা পথ আছে। এদিকে মানুষজন না আসায় বহুদিন ধরে বন্ধ আছে পথটা। চলো যাই। তবে ধীরে ধীরে উঠতে হবে, তা না হলে হাঁপিয়ে উঠবে।

পেটে সন্তান নিয়ে কি পাহাড়ে উঠা ঠিক হবে?

আমি আছি, সমস্যা হবে না। খারাপ লাগলে বলবে।

আমার কিন্তু ভয় করছে।

ভয় পাবে না, মনে সাহস রাখো। আর আমি তো আছি।

আসলেই, তুমি থাকলে মনে বড় জোর পাই।

কথা বলতে বলতে পাহাড়ে উঠার পথের কাছে চলে এলো দুজন। পথটা প্রথম দিকে ভালো থাকলেও পরের দিকে অমসৃণ বেশি। ছোট-বড় পাথর অনেক। ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত ধরে রেখেছেন। অসুবিধা হচ্ছে না এগিয়ে যেতে। তবে মাঝপথে বড় একটা চওড়া পাথর থাকায় দাঁড়াতে হলো। পাথরটা প্রায় বুক সমান উঁচু। উপরে উঠতে হলে এই পাথরে উঠতে হবে প্রথমে। ডাক্তার হাডসন বললেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠার ক্ষেত্রে এটাই বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ উঠতে পারবে না। দ্বিতীয় কাউকে টেনে তুলতে হবে। এজন্য এই পাহাড়ের চূড়ায় সবাই উঠতে পারে না। তবে আমি একা উঠতে পারি। কারণ দীর্ঘদিনের চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

ডাক্তার হাডসন পাথরের উপর এতটাই সাবলীলভাবে উঠে গেলেন যে দেখে অবাকই হলো জেসমিন। তারপর তাকে টেনে তুললেন উপরে। দুজন আবার হাঁটতে শুরু করল। দুপাশে এখন বড় বড় সেগুন গাছ। এক-একটা গাছ এত মোটা যে দেখে সত্যি অবাক হচ্ছে জেসমিন। বলল, এই গাছগুলোর বয়স কত হবে?

এক শ বছরের নিচে হবে না।

এক শ বছর!

হু, এক শ বছর তো হবেই। আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখনো এই গাছগুলো এমনই বড় ছিল। মাঝের এই বছরগুলোতে শুধু মোটা হয়েছে।

আমি সত্যি অবাক হচ্ছি।

সামনে আরো বড় আর মোটা গাছ আছে। এই গাছগুলো এই পাহাড়ের বিশেষ সৌন্দর্য। একেবারে সবুজ করে রেখেছে চারপাশটা। চলো এগোই।

একসময় হাডসন হিলের চূড়ায় এসে পৌঁছাল দুজন। সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল জেসমিনের। নিজের অজান্তেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, এত সুন্দর! সাগরটাও অপূর্ব! আর কতদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

হ্যাঁ, সাগর উপর থেকে দেখলে ভালো লাগে।

আমার সত্যি দারুণ লাগছে।

জায়গাটা আমারও পছন্দের। নাম কী রেখেছি জানো? হিল টপ।

সুন্দর নাম।

ঐ পাথরটা দেখতে পাচ্ছ, চলল ওটার উপর গিয়ে বসি।

হ্যাঁ, চলো। পাথরটার নাম কী জানো?

কী নাম?

লাভ স্টোন।

লাভ স্টোন!

হু, এখানে বসলে শুধু একজন অন্যজনকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে। তুমি যখন বসবে তখন দেখবে আমার কাঁধে মাথা রেখে বসার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার।

জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন ‘লাভ স্টোনের উপর বসল। হাডসন বললেন, একটা কাজ করতে পারি আমরা। এই লাভ স্টোনের উপর আমাদের নাম লিখে রাখতে পারি।

কীভাবে নাম লিখব?

পাথর দিয়ে। আমি তোমার নাম লিখব আর তুমি আমার নাম লিখবে। পারবে?

জেসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, অবশ্যই পারব।

ডাক্তার হাডসন ছোট ছোট দুটো চোখা পাথর নিয়ে এলেন। একটা দিলেন জেসমিনকে আর একটা নিলেন নিজে। তারপর দুজনেই পাথরের উপর ঘষে ঘষে নাম লিখতে শুরু করল। জেসমিন লিখছে ডাক্তার হাডসনের নাম, আর ডাক্তার হাডসন লিখছেন জেসমিনের নাম।

পাথরের উপর পাথর দিয়ে লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে বড় পাথরটাতে ছোট পাথর দিয়ে আঘাত করতে হচ্ছে। এতে শব্দ হচ্ছে। সময় যত যাচ্ছে শব্দ যেন তত বাড়ছে। শব্দটা কানে বাজছে, একসময় জেসমিন শব্দটা সহ্য করতে পারল না। দুই হাতে কান চেপে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু শব্দ হচ্ছেই, একই সাথে তাকে কেউ ডাকছেও। কে ডাকছে ঠিক বুঝতে পারল না। যখন চোখ খুলল, বুঝল সে শুয়ে আছে তার ঘরে। আর দরজায় কড়া নেড়ে তাকে ডাকছে তার মা।

তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামল জেসমিন। কখন সকাল হয়ে গেছে টের পায়নি। সিদ্ধান্ত নিল আগে লাল শাড়িটা পালটে ফেলবে। লাল শাড়ির জন্য আজ আর সে বকা খেতে চাচ্ছে না!

*

ডাক্তার তরফদার রাত এগারোটার সময় ঠিকানা পেয়েছিলেন। থানা থেকে একজন সাব-ইন্সপেক্টর এসে দিয়ে গেছে। মোবাইলের সিম রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে আবুল হাসেম নামের একজনের নামে, ঠিকানা কেরানীগঞ্জ। নাম দেখে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার তরফদার, সিমটা তাহলে জেহানের নয়। অবশ্য জেহানের বয়স কম, এজন্য তার অভিভাবক কারো সিমটা কিনে দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। হয়তো জেহান ব্যবহার করছে। সেক্ষেত্রে তাকে আরো নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হতে হবে। তাই তিনি আর গত রাতে কেরানীগঞ্জ যাওয়ার চিন্তা করেননি। তাছাড়া, রাত হয়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তির কারণেও যাওয়া সম্ভব ছিল না।

ডাক্তার তরফদার থানার জিডিতে লিখেছিলেন যে, একজন মেয়ে আত্মহত্যা করবে বলে একজন ছেলে তাকে খবর দিয়েছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে মেয়েটির জীবন রক্ষা যোক বলে আবেদন করেন জিডিতে। এই জিডি মূলে মোবাইলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর জোগাড় করা হয়েছে এবং সংবাদদাতা হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে থানা থেকে। বিষয়টার সম্পূর্ণই আইনগত ভিত্তি রয়েছে। ডাক্তার তরফদার এই বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকেন, আইনের বাইরে কিংবা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এরকম কিছু তিনি কখনোই করেন না। গতরাতে সাব-ইন্সপেক্টর এলে তদন্ত শুরু করবে কি না জানতে চায়। ডাক্তার তরফদার সম্মতি দিয়ে বলেছেন, তিনি তদন্ত চান, তবে জেহানের পরিচয় যেন ফাঁস না হয়। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে, জেহান নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় অথবা জেহানের কোনো মানসিক সমস্যা আছে। এই মানসিক সমস্যার কারণেই তার আগ্রহটা বেশি।

রাতে গাঢ় ঘুম হয়েছে ডাক্তার তরফদারের। সকালে এক কাপ গরম চা খাওয়ার পর একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেল শরীর। তিনি আর দেরি করলেন না, চলে এলেন কেরানীগঞ্জে। যে ঠিকানা তাকে দেয়া হয়েছে সেটা একটা দোতলা বাড়ির ঠিকানা। বাড়িটাকে খুব বেশি আধুনিক মনে হলো না। তবে প্রাথমিকভাবে বাড়ির মালিক বিত্তবান বলে ধারণা করলেন তিনি।

ডাক্তার তরফদার সকালেও কয়েকবার কল করেছেন। কিন্তু বন্ধ পেয়েছেন জেহানের নম্বর। তার ধারণা এই বাড়ির আশেপাশেই থাকে জেহান। হঠাৎ তার মনে হলো তিনি অতিআগ্রহ দেখাচ্ছেন কি না। পরে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন এই ভেবে যে, না তিনি সঠিক পথেই আছেন। কারণ কিশোরবয়সি জেহান পরপর দুবার তার কাছে সমস্যা নিয়ে এসেছে কিন্তু বলতে পারেনি। তাকে সাহায্য করা তার নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি একজন মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে এই সংবাদও পেয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে ঐ আতাহত্যা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করাও তার কর্তব্য। এজন্য তিনি খুঁজছেন জেহানকে।

বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা মুদি দোকান আছে। পাশে একটা হোটেল। ডাক্তার তরফদার হোটেলের ভিতরে বসে চায়ের অর্ডার দিলেন। যে ছেলেটা চায়ের অর্ডার নিল সে কিশোরবয়সি। তাকে জেহানের কথা জিজ্ঞেস করতে সাথে সাথে বাড়িটা দেখিয়ে বলল, ঐ বাড়িতে থাকে স্যার।

তোমার পরিচিত?

হ স্যার। বাড়ির সবাই প্রায়ই সিঙ্গারা-পুরি নেয় এই হোটেল থাইকা।

তুমি কি জেহানকে ডেকে আনতে পারবে?

আমি ডাকলে আসবে কি না জানি না। তারা মেলা বড়লোক। তয় আমার সাথে পরিচয় আছে, কথাবার্তা অতডা হয় না।

তুমি জেহানকে গিয়ে বলবে যে ডাক্তার তরফদার এসেছে।

ঠিক আছে স্যার।

কী যেন নাম তোমার?

বুল।

ঠিক আছে বাবুল। আর যদি না আসে যেন এখনই আমার সাথে ফোনে কথা বলে। এই যে আমার নম্বর। বিষয়টা বড় জরুরি। বলবে আমি মাত্র পনেরো মিনিট থাকব এখানে, তারপর চলে যাব।

আচ্ছা স্যার।

ডাক্তার তরফদার চায়ের সাথে একটা সিঙ্গারা নিলেন। সিঙ্গারা সত্যি বড় স্বাদের হয়েছে। উপরের অংশে সাদা সাদা, মাঝে আবার পোড়া পোড়া। মুখে দিলে মচমচ করে। আলুর সাথে বাদাম দেয়া হয়েছে, পিয়াজের পরিমাণও বেশি। প্রকৃত সিঙ্গারার যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার সবগুলোই আছে এই দোকানের সিঙ্গারায়। এরকম সিঙ্গারা এখনকার মানুষ বানাতে পারে না। সবই কেমন যেন কৃত্রিম হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি তিনি অনুভব করেন, দিন যত যাচ্ছে ততই কৃত্রিমতায় ভরে উঠছে পৃথিবী। একদিন ভালোবাসাও কৃত্রিম হয়ে যাবে। কৃত্রিম ঐ ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে মানুষকে। মানুষ তখন জানবে না, কোনো একদিন এই পৃথিবী ভরপুর ছিল অকৃত্রিম, উপভোগ্য আর অফুরন্ত ভালোবাসায়।

বাবুল ফিরে এলো দুই মিনিট পর। বলল, স্যার আমি কইছি। কিন্তু জেহান ভাইজান কিছু বলে নাই।

ও আচ্ছা। তুমি আমাকে আর-একটা সিঙ্গারা দাও।

জি স্যার।

তবে এখন না, জেহান এলে দেবে।

জেহান ভাইজান আসবে কি না ঠিক জানি না।

আমি জানি আজ সে আসবে।

আইচ্ছা স্যার।

ঠিক চার মিনিট পর জেহান এলো। তার চোখে-মুখে ভয়। ডাক্তার তরফদার নিজেই কাছে ডাকলেন তাকে। বসতে বললেও বসল না প্রথমে। সিঙ্গারা খেতে বললে তখন বসল।

ডাক্তার তরফদার অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন এইসব ক্ষেত্রে কোন কথা দিয়ে শুরু করলে জেহানের কাছ থেকে কথা বের করা যাবে। তিনি সরাসরি বললেন, মেয়েটি কে যে আত্মহত্যা করবে?

স্যা…স্যা…র…

তাড়াতাড়ি বলে ফেলল। দেরি কোরো না। তুমি যদি তাকে পছন্দও করে থাকো আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে সাহায্য করব।

আ…আমি স্যার…

আমি মেয়েটির নাম জানতে চাচ্ছি এবং ঠিকানা।

কাউকে বলবেন না স্যার।

না, বলব না। তুমি আমার সাহায্য চেয়েছ, তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। এখন বলো মেয়েটির নাম কী, আর ঠিকানা কোথায়?

স্যার নাম জে..জেসমিন। আর ঠিকানা পাশের ঐ বাড়ি।

হাত দিয়ে জেসমিনদের বাড়ি দেখিয়ে দিল জেহান। ডাক্তার তরফদার কিছুটা আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে জেহান আবার চলে না যায়। এখন তিনি নিশ্চিত জেহান যাবে না। কারণ জেহানের জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল জেসমিনের নাম উচ্চারণ করা এবং বাড়ির ঠিকানা বলা। সে কঠিন কাজটা সম্পাদন করেছে। এখন ফলাফল চাইবে। এমনই হয়ে থাকে।

ডাক্তার তরফদারের অনুমানই সত্যি হলো। সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে জেহান বলল, স্যার, জেসমিনকে বাঁচাবেন কীভাবে?

আমি ওদের বাড়ি গিয়ে কথা বলব।

জেহান চোখ বড় বড় করে বলল, আমার কথা আবার বলে দেবেন নাকি স্যার?

তোমার কথা কেউ জানবে না।

ধন্যবাদ স্যার, বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

আমি যদি জেসমিনদের বাড়ি যাই, জেসমিনের বাবা-মা কি আমার সাথে কথা বলবেন?

জানি না স্যার। তারা তো বাড়িতে এখন কাউকে ঢুকতে দেয় না।

কেন?

স্যার সত্য কা বলব?

সত্যই তো বলবে।

জেসমিন কীভাবে যেন প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে স্যার।

ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, কে এই কাজটা করেছে?

রাশেদ। আমাদের কলেজের ছাত্র। জেসমিনের সাথে প্রেম ছিল। আগে ঘুরতেও যেত একসাথে। এমনকি রাতে জেসমিনদের বাড়িতেও এসেছে। আমি নিজে দেখেছি। মাঝরাতে পিছনের দেয়াল টপকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর জেসমিনের খোঁজখবর রাখে না। ফার্স্ট ইয়ারের এক নতুন মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাজনীতি করছে।

তোমার সাথে কথা হয় জেসমিনের?

আগে হতো। এখন আর হয় না। কয়েকদিন আগে জেসমিন যখন রাতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম। তারপর একবার ফোন করেছিল, ধন্যবাদ দিতে। আর বলেছিল আবার আত্মহত্যা করবে। তখনই আমি আপনার কাছে যাই।

আমাকে চিনলে কীভাবে?

স্যার আমার এক বন্ধুর মা পাগল ছিল। আপনি সুস্থ করে দিয়েছেন। সে আপনার গল্প বলেছে আমাকে। যেদিন জেসমিন ফোন করে আবার আত্মহত্যার কথা বলল, আমার আর ভালো লাগছিল না। তাই আপনার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি।

এখন তো সবকিছু বলতে পারছ।

পারছি স্যার। কিন্তু অনেক সময় অনেক কিছু বলতে পারি না।

জেসমিনকে কি বলেছ তোমার ভালোবাসার কথা?

ডাক্তার তরফদার সরাসরি প্রশ্নটা করলেন জেহানকে।

জেহান মাথা নিচু করে বলল, স্যার, অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।

কেন?

আমার থেকে সে বয়সে বড়।

তাহলে তাকে ভালোবাসো কেন?

মাথাটা আরো নিচু হয়ে গেল জেহানের। বিড়বিড় করে বলল, স্যার আমি জানি না, জেসমিনকে দেখলেই আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। জেসমিন এত সুন্দর! স্যার আমি কোনো কথা বলতে পারি না।

তুমি কি জেসমিনকে এখনো ভালোবাসো? মানে জেসমিন অন্য কারো সন্তান ধারণ করছে জেনেও।

এবার জেহান মাথা উঁচু করল। তার চোখে পানি। বিড়বিড় করে বলল, স্যার, আমি জেসমিনকে সবসময়ই ভালোবাসি।

এই কথাটা কি অন্য কেউ জানে?

না স্যার।

জেসমিন কি বুঝতে পারে যে তুমি তাকে ভালোবাসো?

না স্যার।

তাকে তুমি তোমার ভালোবাসার কথা, তোমার ভালোলাগার কথা বলোনি কেন?

ভয়ে বলিনি স্যার। তবে বুঝতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।

জেসমিন এবং তার পরিবার সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনে ডাক্তার তরফদার বললেন, ঠিক আছে তুমি বাসায় যাও। আমি চেষ্টা করব জেসমিনকে বাঁচিয়ে রাখতে, তার আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে। আর হ্যাঁ মনে রেখো, ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া যতটা না কষ্টের, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারা অনেক অনেক বেশি কষ্টের। এই কষ্টটা এক-দুই দিনের নয়, আজীবনের। তাই বুকের মধ্যে ভালোবাসা চেপে না রেখে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে মন যেমন হালকা হয়, ভালোবাসায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

*

ডাক্তার তরফদার এলেন নাজমুল হোসেনের স্কুলে। স্কুলেই ছিলেন তিনি। ডাক্তার তরফদার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, যে কোনোভাবেই হোক, আমি জানতে পেরেছি আপনার মেয়ে জেসমিন বড় ধরনের সমস্যায় আছে।

নাজমুল হোসেন বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আসলে আপনি কী বলতে চাইছেন?

আমি জেসমিন এবং আপনাদের সাহায্য করতে চাই।

কেন?

মানুষ হিসেবে অন্য একজন মানুষের জীবন বাঁচানো নৈতিক দায়িত্ব। ঐ দায়িত্ববোধ থেকেই বলছি কথাগুলো। আপনার মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। কোনো কারণে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে ঐ কারণ দূর না করতে পারলে আবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। একজন মানুষ নিজেই যদি নিজেকে হত্যা করতে চায় কতক্ষণ আপনি তাকে আটকে রাখবেন, বরং তার সমস্যাটা চিহ্নিত করে তা দূর করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আমার মনে হয় না জেসমিনের সমস্যা আপনি দূর করতে পারবেন।

চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।

তা নেই। কিন্তু আপনি অনেক বড় মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ হবেন নিশ্চয়। আসলে এই চিকিৎসার অনেক খরচ। আমি…

আমি তো আপনার কাছে কোনো খরচ চাইনি।

তারপরও…

অর্থ অনেক কিছু মানি, তবে আপাতত আমার প্রয়োজন নেই। বরং প্রয়োজন একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা। আমি জেসমিনের সাথে কথা বলতে চাই।

জেসমিন তো কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না ইদানীং। এমনকি ওর ছোট ভাইদের সাথেও কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে।

ডাক্তার তরফদার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, এটা ভালো লক্ষণ না। অর্থাৎ জেসমিন একা হয়ে যাচ্ছে। একাকিত্ব মানুষের বড় শত্রু। মানুষ সামাজিক জীব, মানুষকে একা থাকার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। মানুষ যত একা থাকবে বিষণ্ণতা ততই জেঁকে ধরবে। বাড়বে আত্মহত্যারও ইচ্ছা।

নাজমুল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আমার স্ত্রীও চায় না কেউ এখন জেসমিনের সাথে দেখা করুক।

এই কথার অর্থ হলো আপনারা কিছু গোপন করতে চাচ্ছেন।

এখন আর কিছু গোপন নেই, সবই ফাঁস হয়ে গেছে।

তাহলে আমাকে বিস্তারিত বলতে তো আপত্তি থাকা উচিত নয় আপনার। আর আমাকে চিকিৎসার সুযোগও দিতে পারেন। চিকিৎসা না হলে শুধু জেসমিন নয়, আপনার স্ত্রীও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আর ইতিমধ্যে আপনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, আপনার চোখ ঐরকমই বলছে।

আমার মতো অবস্থা হলে আপনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন।

স্বীকার করছি। এজন্যই সহায়তা করতে চাই আপনাদের।

চলুন তাহলে।

স্কুল থেকে বাড়ি দূরে নয়। দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এই দশ মিনিটে ডাক্তার তরফদার যতটুকু পারলেন জেসমিন সম্পর্কে তথ্য নিলেন নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে। শুধু এটুকু অনুধাবন করলেন যে, হেডমাস্টার নাজমুল হোসেন মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত, তবে কাউকে তিনি কিছু বুঝতে দেন না।

বাড়ির একেবারে কাছাকাছি আসতে ডাক্তার তরফদার বললেন, কার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল জেসমিনের?

আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। কিছুই বলে না জেসমিন।

তারপরও কাউকে না কাউকে তো আপনারা সন্দেহ করছেন?

রাশেদের কথা আপনাকে বলেছি। ওর সাথেই সম্পর্ক ছিল জেসমিনের।

রাশেদ কি জানে যে জেসমিনের পেটে সন্তান আছে?

আমাদের করো সাথে কথা হয়নি। জেসমিনের মা একবার ভেবেছিল রাশেদের পরিবারের সাথে কথা বলবে। কিন্তু নিশ্চিত প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। জেসমিন মোটেও সহযোগিতা করছে না। একটু খুলে বললেই হতো। এখন তো আর আমাদের উপায় নেই। বাচ্চার জন্ম দিতেই হবে। সমাজে কী লজ্জায়ই না পড়ব আমরা!

মানুষের জীবনে নানারকম আপদ-বিপদ আসে। আবার এইসব আপদ বিপদ মানুষই মোকাবেলা করে। আপনি এত চিন্তা করবেন না। দেখি কী করা যায়!

বাড়ির বারান্দায় একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হলো ডাক্তার তরফদারকে। নাজমুল হোসেন ডাকতে গেলেন জেসমিনকে। জেসমিন অবশ্য বের হতে রাজি হলো না। উলটো রাগ হয়ে বলল, আমাকে বিরক্ত কোরো না বাবা।

তুই একটু বুঝতে চেষ্টা কর।

না, আমি যাব না, আমার মতো থাকব। আর আমাকে নিয়ে তোমরা এত চিন্তা কোরো না। বাড়িতে ডাক্তার আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই এখন, আমি সুস্থ আছি।

যিনি এসেছেন উনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

আমার মন ভালো আছে।

কিন্তু আমাদের কারো মন তো ভালো নেই। তোকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। তোর জীবনটা সুন্দর করার জন্য কত কী-ই না আমরা করছি, আর তুই আমাদের সহযোগিতা করছিস না।

জেসমিন তার বাবার চোখে তাকাল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে সরাসরি এলো ডাক্তার তরফদারের সামনে। একটা চেয়ারে বসে বলল, নিন আমাকে পরীক্ষা করুন। আমার কোনো অসুখ নেই, অথচ সবাই মিলে আমাকে এখন অসুস্থ বানাচ্ছে।

ডাক্তার তরফদার হেসে দিয়ে বললেন, আমি তো তাই বলছি, তুমি অসুস্থ নও, সবাই তোমাকে অসুস্থ বলছে।

তাহলে আপনি এসেছেন কেন?

এসেছি সবাইকে বুঝাতে যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ।

এখন বলে দিন।

ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি কি একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?

কী প্রশ্ন?

নাজমুল হোসেন আর নিলুফার পাশেই ছিলেন। ইশারা করতে তারা দরজার ওপাশে চলে গেলন। ডাক্তার তরফদার বললেন, এই বাসায় তোমাকে কে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ মনে করে?

সবাই।

তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে।

কী কাজ?

ঘরের মধ্যে না থেকে বাসার কাজগুলো করবে, কঠিন কাজ না। সহজ কাজগুলো। দেখবে সবাই তোমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে।

জেসমিন কিছু বলল না। ঝিম মেরে বসে থাকল।

ডাক্তার তরফদার এবার বললেন, তুমি কি আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?

জেসমিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। পুরো পানিটুকু খেলেন ডাক্তার তরফদার। তারপর বললেন, তোমার যখন খারাপ লাগবে তখন তুমি আমার চেম্বারে আসতে পারো। এই যে ভিজিটিং কার্ড। এখানে সবকিছু লেখা আছে। জানি আমার সাহায্য হয়তো তোমার লাগবে না। তারপরও যদি মনে করো আসতে পারো। ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি এখন তোমার ঘরে যেতে পারো।

জেসমিন তার ঘরে চলে গেল। ডাক্তার তরফদারকে নাস্তা করার কথা বললেও অপেক্ষা করলেন না তিনি। বাইরে বের হয়ে এলেন। নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললেন, জেসমিন সুস্থ নয়, মারাত্মক অসুস্থ। অসুস্থতার কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। হতে পারে অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে এজন্য। মারাত্মক অপরাধবোধ কাজ করছে ওর মধ্যে। এজন্য সে মানসিক চাপেও আছে। আজ থেকে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করবেন না ওর সাথে। আচরণ এমন করবেন যেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। বরং আপনারা খুশিই হয়েছেন তার পেটে সন্তান আসার জন্য, ব্যাপারটা যেন এমন থাকে। আর হ্যাঁ, জেসমিনের দুজন বান্ধবীর নাম আমাকে দেবেন যারা ওর খুব ঘনিষ্ঠ। আমি কথা বলতে চাই ওদের সাথে। আসি।

নাজমুল হোসেন কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখ দিয়ে পানি আসে আসে অবস্থা।

ডাক্তার তরফদার চলে আসার সময় ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না, পুরোটা সময় ছাদের উপর থেকে তার উপর নজর রাখছিল জেহান।

*

ডাক্তার তরফদার বাসায় এসে লম্বা একটা ঘুম দিলেন। শরীরটা তার ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে। কারণটাও বুঝতে পারছেন না। শরীরে তার তেমন কোনো রোগ নেই। নেই ডায়াবেটিসও। তবে লক্ষণটা মনে হচ্ছে ডায়াবেটিসের। রক্তে গ্লুকোজ মাপার একটা ডিজিটাল মেশিন আগে থেকেই বাসায় ছিল। ঐ মেশিনে রক্তের গ্লুকোজ মাপলেন তিনি। মাত্র চার দশমিক এক। বুঝলেন শরীরে শর্করার অভাবে এমন হচ্ছে। তার অন্যতম একটা প্রিয় খাবার হলো পোলাওয়ের চালের পাতলা জাউ আর শুকনো মরিচ পিয়াজ দিয়ে বানানো ঝলবেশি আলুভর্তী। ঠিক করলেন আজ তিনি তার প্রিয় খাবারটা খাবেন। কিন্তু করিম চাচার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরে বের হয়ে এসে দেখলেন বাগানেও নেই। করিম চাচাকে নিয়ে এই একটা সমস্যা। হুটহাট বাইরে চলে যায়। বাড়ির কুকুর ভুলু তাকে দেখে শুধু লেজ নাড়ছে। ভুলুও মাঝে মাঝে করিম চাচার সাথে বাইরে চলে যায়। তবে আজ যায়নি। বাড়িতেই আছে।

ডাক্তার তরফদার ঠিক করলেন তিনি আজ পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ খাবেনই। প্রয়োজনে নিজে রান্না করবেন। অবশ্য রান্নাঘরে এসে বড় অবাক হলেন। করিম চাচা তার জন্য পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ বেঁধে রেখেছে। আলু ভর্তাও করেছে, সাথে শুকনো মরিচ ভর্তা। করিম চাচার এই ক্ষমতাটা অসাধারণ। সে বুঝতে পারে মানুষ ভবিষ্যতে কী চায় কিংবা মানুষের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে। একেবারে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে করিম চাচা। পৃথিবীতে তার মতো এতটা নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এমন কোনো মানুষ নেই বলেই বিশ্বাস করেন ডাক্তার তরফদার। অবশ্য তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সে নিজেই করে, অন্য কেউ জানতে চাইলে কখনোই বলে না। তার একটাই কথা, ভবিষ্যৎ জানতে চেও না, নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়ে নাও।

পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ তৈরি করার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। দুই লিটার পানিতে এক মুঠো সুগন্ধী পোলাওয়ের চাউল নিতে হবে। তারপর সিদ্ধ করতে হবে ধীরে ধীরে। একসময় সম্পূর্ণ চাল পানিতে গলে যাবে, হবে অনেকটা স্যুপের মতো। ইচ্ছে করলে একটা সিদ্ধ ডিম গুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। তারপর নিতে হবে একটা বাটিতে, সাথে শুকনো মরিচের ঝাল ঝাল আলুভর্তা থাকবে। বাটিতে যখন জাউ ঢালা হবে তখন যেন ধোয়া উড়ে জাউ থেকে, নাকে এসে লাগা বাসনা ক্ষুধাকে আরো চাঙা করে তুলবে। অতঃপর একটা চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে খেতে হবে। স্বাদ হবে একেবারে অমৃতের মতো।

ডাক্তার তরফদার বাটিতে জাউ নিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসলেন। বেশ সময় নিয়ে তিনি জাউ খেতে শুরু করলেন। স্বাদ সত্যি অসাধারণ। তার থেকে বড় কথা দুর্বলতা কেটে গেছে। নিজেকে সম্পূর্ণ সতেজ মনে হচ্ছে তার। তাই একটা কাগজ টেনে জেসমিন বিষয়ে লিখতে শুরু করলেন

জেসমিন সম্পর্কে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে জেসমিন গর্ভবতী। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে তা সে বলতে চাচ্ছে না। একজন মেয়ে সাধারণত এ ধরনের তথ্য লুকিয়ে রাখে না। রাখতে পারে তখনই যখন তাকে ভয় দেখানো হয় কিংবা সে নিজেই বিশ্বাস করে না যে সে গর্ভবতী। যেহেতু আলট্রাসনোগ্রামে বাচ্চার অবয়ব স্পষ্ট দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তার বাবা সেক্ষেত্রে সে যে গর্ভবতী, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাহলে কে তাকে ভয় দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। কারণ তার আশেপাশে এমন কেউ নেই যে তাকে ভয় দেখাতে পারে। রাশেদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল ঠিকই, কিন্তু রাশেদ যে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু রাশেদের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে জেসমিনের, কারণটা কী? হতে পারে ঐ গর্ভের সন্তান। রাশেদ হয়তো চাচ্ছে সন্তানকে মেরে ফেলতে, জেসমিন চাচ্ছে না। পৃথিবীতে কোনো নারীই চায় না তার গর্ভে সৃষ্ট হওয়া কোনো মানব ভ্রুণের মৃত্যু হোক। এজন্য হয়তো রাশেদ আর জেসমিনের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। জেসমিন হয়তো চেষ্টা করছে রাশেদকে বোঝনোর জন্য যে সন্তানকে সে জন্ম দিতে চায়। রাশেদ রাজি না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত সে। এই হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এই মুহূর্তে তার জীবন রক্ষার অন্যতম উপায় রাশেদ আর তার মধ্যে মিল করিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে কথা বলতে হবে রাশেদের সাথে। রাশেদ সবকিছু স্বীকার করবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ রাশেদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে চাচ্ছে এখন। সম্পর্কের বিষয়ে আরো নিশ্চিত হতে জেসমিনের ঘনিষ্ঠ কোনো বান্ধবীর সাথেও কথা বলা প্রয়োজন। তবে সবার আগে দরকার জেসমিনের উপর নজর রাখা। আত্মহত্যার চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য নজরদারি বড় জরুরি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে জেহান। জেহান সত্যি ভালোবাসে জেসমিনকে। কিন্তু জেসমিন জেহানকে ভালোবাসে না, ভালোবাসার সম্ভাবনাও কম। কারণ জেহান বয়সে ছোট। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে একজন মেয়ে সাধারণত তার থেকে কম বয়সি একটি ছেলেকে ভালোবাসার মানুষ কিংবা স্বামী হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত নয়। জেহানকে আজ জানানো হয়েছে যে ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া যতটা না কষ্টের, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারা অনেক অনেক বেশি কষ্টের। এই কষ্টটা এক-দুই দিনের নয়, আজীবনের। তাই বুকের মধ্যে ভালোবাসা চেপে না রেখে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে মন যেমন হালকা হয়, ভালোবাসার জয় হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে মনে হবে এমন কিছু কথা জেহানকে বলা ঠিক হয়নি, কিন্তু যৌক্তিকতা আছে। জেহানের বয়স এখনো আঠারো হয়নি। সে বয়ঃসন্ধিকালে আছে, টিনএজার। জেসমিনের প্রতি মারাত্মক দুর্বল। এই দুর্বলতা পরবর্তীকালে তার নিজের মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে যদি এখনই প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে তার নিজের মধ্যে আফসোস থাকবে না, অন্তত এই ভেবে মানসিক শান্তি পাবে যে সে চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি জেসমিনের প্রতি তার মোহ কেটে যাবে। এই মোহ কেটে যাওয়াটা বড় জরুরি। মোহ কাটার অন্যতম উপায় ভালোলাগার কথাটা জেহানকে দিয়ে বলানো। এজন্য ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথাগুলো বলা হয়েছে জেহানকে। তবে জেহান জেসমিনকে ভালোবাসার কথা বলতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ জেহান তুলনামূলকভাবে ভীতু ধরনের ছেলে। এই ভয়ই তার অস্থিরতা আর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবেই হোক এই ভয় আর অস্থিরতা তাড়াতে হবে। তা না হলে জেহান নিজেও অস্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করবে। যাইহোক, এখন মূল বিষয় হচ্ছে জেসমিনের গর্ভের সন্তানের পিতা কে তা খুঁজে বের করা। এজন্য জরুরি হলো রাশেদ এবং জেসমিনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে কথা বলা।

ডাক্তার তরফদার কলম রেখে আবার মনোযোগী হলেন জাউয়ের প্রতি। লেখায় অতিরিক্ত মনোযোগ থাকার কারণে শেষের দিকে জাউ খেতে ভুলে গিয়েছিলেন। ঠান্ডা হয়ে গেছে জাউ। চুলা থেকে আবার গরম জাউ নিয়ে এলেন। এসে বসলেন বারান্দায়। ভুলু তার পায়ের কাছে এসে কুঁইকুঁই করতে লাগল। তিনি বুঝলেন ক্ষুধা লেগেছে ভুলুরও। কুকুর জাউ খায় কিনা, ভাত খায় কিনা, ঠিক মনে করতে পারলেন না। তিনি উপলব্ধি করলেন, অনেক কিছুই তার ইদানীং মনে থাকে না, এটা ভালো লক্ষণ না।

ডাক্তার তরফদার পোলাওয়ের চালের জাউ এনে দিলেন ভুলুকে। জাউ থেকে ধোঁয়া উড়ছে, ভিতরে ঝাল আলুভর্তাও আছে, সুগন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। ভুলু বারবার শুঁকে ঘ্রাণ নিচ্ছে।

তিনি ভুলুকে বললেন, ভুলো খেয়ে দ্যাখো, রাজকীয় জাউ, অনেক আগে রাজা-বাদশাহরা খেত।

রাজা-বাদশা শব্দ শুনে লেজ নাড়াতে লাগল ভুলু। তারপর চার পায়ে খুব আরাম করে বসল। জাউ এখন তার মুখের সামনে।

ডাক্তার তরফদার এবার বললেন, খেয়ে নাও।

ভুলু নিচে তাকাল, জিহ্বাটা দিয়ে হালকা স্পর্শ করল জাউ। তারপর খেতেই থাকল, জাউ শেষ করতে খুব একটা সময় লাগল না তার। খাওয়া শেষে ঘেউঘেউ করে উঠল। বোঝা গেল আরো চায়।

ডাক্তার তরফদার উঠে গিয়ে পুরো জাউটুকু নিয়ে এলেন। তারপর ঢেলে দিলেন ভুলুর বাটিতে।

ভুলু মহাখুশি। লাফ দিয়ে উঠে দুবার চক্কর দিল ডাক্তার তরফদারের পাশে। তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে পোলাওয়ের চালের রাজকীয় জাউ খেতে শুরু করল।

ডাক্তার তরফদার হাতের বাটি থেকে নিজেও এক চামচ জাউ মুখে দিলেন। আজ জাউটা বেশি স্বাদের হয়েছে। কারণ করিম চাচা খাঁটি ঘি দিয়ে বানিয়েছেন আলুভর্তা! আর খাঁটি ঘিয়ের যে কোনো খাবারই বড় স্বাদের হয়!

*

ডাক্তার তরফদার শান্তার সাথে কথা বলতে কলেজে এসেছেন। শান্তার ফোন নম্বর তিনি জোগাড় করেছেন জেহানের কাছ থেকে। নিজেই ফোন করে সময় নিয়েছেন। এখন কথা বলছেন লাইব্রেরিতে বসে। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার তরফদার, জেসমিনের সাথে তোমার পরিচয় কতদিনের?

শান্তা ঠোঁট কামড়ে বলল, স্যার কলেজে উঠে পরিচয়।

আমি যতদূর জেনেছি তোমার সাথেই জেসমিন সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল।

জি স্যার। কলেজে আসার পর আমরা দুজন একসাথেই থাকতাম, পাশাপাশি বসতাম, ঘুরতাম, চা-নাস্তা খেতাম।

জেসমিনের সমস্যাটা তুমি নিশ্চয় শুনেছ?

জি স্যার শুনেছি। কথা বলতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর বাচ্চার বাবা কে? সুনির্দিষ্টভাবে কোনো উত্তর দেয়নি। খালাম্মা মানে জেসমিনের মা-ই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন যেন আমি বাচ্চাটার বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ও খুব বিরক্ত।

কেন?

জানি না স্যার। হয়তো কিছু লুকাতে চাচ্ছে। অবশ্য লুকাবেও বা কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

রাশেদের সাথে সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল জেসমিনের?

আমি ওকে নিষেধ করতাম। কিন্তু ও শুনত না। মাঝে মাঝে রাশেদ ভাইয়ার মোটরসাইকেলে করে অজানা কোথাও চলে যেত। জিজ্ঞেস করলে বলত না। শেষের দিকে ওদের ভালোবাসা এতটাই গম্ভীর হয়েছিল যে ক্লাস বাদ দিয়ে মোেটরসাইকেলে ঘুরত জেসমিন।

রাশেদ ছেলেটা কেমন?

প্রথমে ভালোই ছিল। মাস দুয়েক ধরে একেবারে পালটে গেছে। রাজনীতিতে ঢুকেছে। এখন একটা গ্রুপের নেতা সে। সবসময় ছয়-সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থাকে। শুনেছি স্থানীয় বাজারে চাদাবাজিও করে। কয়েকদিন আগে বাজারের দোকান মালিক সমিতির সাথে মারামারিও হয়েছে। থানায় জিডি হয়েছে। আর…আর…

আর কী?

জেসমিনকে বোধহয় ভুলে গেছে। খোঁজখবর নেয় বলে মনে হয় না। আর একটা মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখি ইদানীং। মেয়েটা অবশ্য সুবিধার না। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে হলেও আগেও একজনের সাথে প্রেম করেছে।

ডাক্তার তরফদার বুকের মধ্যে আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার কি মনে হয় রাশেদই জেসমিনের বাচ্চার বাবা?

অন্য কেউ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ জেসমিনকে একমাত্র রাশেদ ভাইয়ের সাথেই ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু একটা যুক্তি মিলছে না।

কী যুক্তি?

জেসমিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর বাচ্চা রাশেদের কি না। জেসমিন স্পষ্টভাবে বলেছে ‘না’। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম বাচ্চাটা কার তাহলে? মৃদু হেসে বলেছিল, আমি কারো জন্য বিপদের কারণ হতে চাই না, সব দায়িত্ব আমার। শুনে রাখ, বাচ্চাটার বাবা এমন কেউ যে তুই কল্পনাও করতে পারবি না। সময় হলে বাচ্চার বাবা ঠিকই বাচ্চার দায়িত্ব নেবে। আপাতত ধরে রাখ বাচ্চাটার বাবা এক মূর্তি যে কিনা আমাকে খুব ভালোবাসে। ছায়া হয়ে আমার কাছে আসেও।

মূর্তি কীভাবে বাচ্চার বাবা হবে? আবার ছায়া হয়ে আসবে? তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

কীভাবে বুঝবেন স্যার? জেসমিনের কথা তো আমিও বুঝিনি। আর এখন তো আরো বোঝা যায় না। সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকে।

জেসমিনের এই পরিবর্তনটা তোমার কবে থেকে চোখে পড়েছে?

কোন পরিবর্তন?

জেসমিনের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া, বিষণ্ণতায় ভোগা, কারো সাথে কথা না বলা।

শান্তা খানিকটা সময় নিয়ে বলল, স্যার মনে করতে পারছি না। সম্ভবত যখন থেকে বুঝতে পারে যে তার পেটে বাচ্চা আছে তখন থেকেই সে বেশি চুপ হয়ে যায়। তবে কক্সবাজার থেকে আসার পর পরিবর্তনটা চোখে পড়ে আমার। মাঝে মাঝে কী যেন ভাবত, অন্যমনস্ক হয়ে যেত।

ধন্যবাদ তোমাকে, আমার আর তেমন কিছু জানার নেই। নতুন কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানাবে। এই যে ভিজিটিং কার্ডে আমার ফোন নম্বর আছে। আর হ্যাঁ, তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আমি জেসমিনকে সাহায্য করতে চাই। যখন এই বিশ্বাসটা তোমার মধ্যে জন্মাবে তখন দেখবে অনেক নতুন তথ্য তোমার মাথায় আসছে।

স্যার আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।

আমি জানি। তারপরও তোমাকে বললাম যেন তুমি, আমি, আমরা সবাই মিলে জেসমিনকে সুস্থ করে তুলতে পারি।

জি স্যার।

ডাক্তার তরফদার রাশেদের সাথেও কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন। কলেজে একটা হোস্টেল আছে, রাশেদের সাথে দেখা করতে হোস্টেলে যেতে হবে। হাতে এখনো বিশ মিনিট সময় আছে। রাশেদ তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে তিনি খানিকটা শঙ্কিত। কারণ জেসমিনের প্রতি তার আর টান নেই বলে তার ধারণা।

বিশ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার তরফদার দুজন ছাত্রের সাথে কথা বললেন। মূল বিষয়-কলেজের রাজনীতি। রাজনীতির কথা বলতে রাশেদের কথাও এলো, তার চাঁদাবাজির কথা বলতেও ভুলল না দুই ছাত্রের কেউ। একই সাথে জানাল সে কলেজের জন্য একটা ত্রাস হয়ে উঠছে। নতুন যে হোস্টেল নির্মিত হবে, ঠিকাদারির কাজ নাকি তার পছন্দের মানুষকেই দিতে হবে। কলেজের একজন ছাত্র কীভাবে ঠিকাদার ঠিক করবে তা ঠিক বুঝতে পারলেন না ডাক্তার তরফদার। দিনে দিনে শিক্ষাব্যবস্থা যে একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে এই ঘটনা যেন তারই উদাহরণ।

কলেজে মাঠের পাশে বড় একটা আমগাছ আছে। সেই গাছের নিচে কথা বলতে শুরু করলেন ডাক্তার তরফদার আর রাশেদ। নিজের পরিচয় দিয়ে ডাক্তার তরফদার বললেন, আমি তোমার কাছে এসেছি শুধু একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য, তোমার উপর কোনো চাপ সৃষ্টি কিংবা তোমার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার জন্য নয়। যদিও বিষয়টি তোমার ব্যক্তিগত, তোমার কাছে জানতে চাইব তুমি কেন জেসমিনকে ছেড়ে চলে এসেছ?

রাশেদ সরু চোখে তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। তারপর টেনে টেনে বলল, জেসমিনই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

তাই বুঝি!

জি স্যার। আমাকে সে চিঠিও লিখেছে, এসএমএস দিয়েছে। সবই আছে আমার কাছে। হঠাৎ আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দেয় সে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও একদিন রাতে দেয়াল টপকে আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর বোধহয় দুবার ফোনে কথা হয়েছে আমাদের। আমিই ফোন করেছিলাম। এখন আর আমার ফোন ধরে না।

ডাক্তার তরফদার বড় অবাক হলেন। রাশেদের কণ্ঠ আর চোখের ভাষা শুনে বুঝতে পারছেন রাশেদ সত্য কথা বলছে।

রাশেদ আবার বলল, স্যার, তবে এখন আর আমার কোনো আগ্রহ নেই জেসমিনের প্রতি।

কেন?

সত্যমিথ্যা জানি না। তবে শুনেছি ও প্রেগন্যান্ট। তার মানে কী? নিশ্চয় কারো সাথে ওর সম্পর্ক আছে!

অনেকে বলছে, এই সন্তান তোমার।

কথাটা শোনার পর রাশেদের রেগে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাগল না। বলল, স্যার সবাই বলবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ জেসমিন আমার সাথে ঘুরেছে, আমার মোটরসাইকেলে উঠেছে, আমরা দূরেও গেছি ঘুরতে। তবে এটা সত্য আমাদের কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। অবশ্য…

অবশ্য কী?

শেষ যখন জেসমিনের সাথে আমার দেখা হয়, মানে যে রাতে আমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, জেসমিন আমাকে বলেছিল যে নীল চোখের ছায়াকে ভালোবাসে, আমাকে না।

নীল চোখের ছায়া কী?

জানি না স্যার। তবে ‘ছায়া’ শব্দটা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করেছে ও। ঐ দিনের পর আমি জেসমিনের সাথে একবার ফোনেও কথা বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম তার প্রেগন্যান্সির বিষয়টি। বেশ সাবলীলভাবে সে বলেছিল যে তার পেটের বাচ্চা নীল চোখের ছায়ার বাচ্চা। ঐ দিনও জিজ্ঞেস করেছিলাম, নীল চোখের ছায়া আবার কী? বলেছিল, তার মনের মধ্যে একটা জোছনা আছে, সেই জোছনায় একটা ছায়া আসে। ছায়াটার চোখ নীল। ঐ নীল চোখের ছায়াটাই তার সন্তানের বাবা। পেটের ঐ সন্তানকে সে খুব ভালোবাসে এবং সে চায় সন্তানের জন্ম হোক। যেহেতু আমি ঐ সন্তানের বাবা না, তাই আমাকে সে তার কাছে যেতে বারণ করেছে। আরো বলেছে সে দ্রুতই চলে যাবে নীল চোখের ছায়ার কাছে। ঐ ছায়া নাকি থাকে সমুদ্রের তীরে, পাহাড়ের ঢালে। জেসমিনের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল ও পাগল হয়ে গেছে। কথা বলার সময় কেমন যেন উদাস হয়ে যাচ্ছিল। তবে ওকে আমার মোটেও চিন্তিত মনে হয়নি। বরং মনে হচ্ছিল ঐ নীল চোখের ছায়ার কাছে যাওয়ার আনন্দে সে বিভোর। যেহেতু আমার প্রতি ওর আর কোনো আগ্রহ নেই, এজন্য আমিও আর ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি না। ধীরে ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি।

তুমি কি জেসমিনের কথা বিশ্বাস করেছ?

জেসমিন নিজের মুখে আমাকে বলেছে।

ডাক্তার তরফদার লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, রাশেদ ধন্যবাদ তোমাকে। আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যাই, সাবধানে থেকো, আর এই বয়সে রাজনীতিতে এতটা সম্পৃক্ত হবে না। বয়সটা পড়াশুনার। রাজনীতি করার জন্য সামনে অনেক সময় পাবে। তখন রাজনীতি করতে পারবে। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো।

ফিরে আসার সময় ডাক্তার তরফদার বড় চিন্তায় পড়লেন। কারণ তিনি নিশ্চিত রাশেদ তাকে মিথ্যা বলেনি। মানুষের কথা বলার ধরন আর দৃষ্টি দেখলে অনেকটাই বুঝতে পারেন তিনি। তাছাড়া কথাবার্তায় খুব সাবলীল ছিল রাশেদ। এরকম সাবলীলতা দিয়ে মিথ্যাকে ঢেকে রাখার ক্ষমতা মানুষের নেই বললেই চলে। তারপরও এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়নি, রহস্যের আরো গভীরে প্রবেশ করতে হবে-উপলব্ধি করলেন তিনি। আর কয়েকটা শব্দ তার মাথায় ঘোরাফেরা করতে লাগল। এই শব্দগুলো হলো নীল চোখ, ছায়া, পাহাড়, সমুদ্র, মূর্তি।

*

শেষ রাত। হাডসন হিলে সাগরের তীর ধরে হাঁটছে জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন। বরাবরের মতো জেসমিনের পরা লাল শাড়ি আর ডাক্তার হাডসন পরেছে নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। বাতাসের গতি আজ তুলনামূলকভাবে বেশি। এজন্য ভালোলাগাটাও যেন বেশি উপভোগ্য। দেখা হওয়ার পর দুজন প্রথমে বেশ কথা বলেছে। কিছুক্ষণ হলো চুপচাপ হাঁটছে।

বড় একটা ঢেউ পায়ে আছড়ে পড়তেই ডাক্তার হাডসন বললেন, কেমন লাগছে তোমার?

জেসমিন মিষ্টি হেসে বলল, অসাধারণ!

আমারও খুব ভালো লাগছে।

সত্যি?

হ্যাঁ, তোমার পাশে থাকতে, তোমার হাত ধরে হাঁটতে বড় ভালো লাগে।

হাত তো আজ ধরোনি তুমি!

ডাক্তার হাডসন মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে জেসমিনের বাম হাত ধরে বললেন, এই তো ধরলাম।

এই হাত আর ছাড়বে না।

ছাড়তে চাইও না।

জেসমিন এবার বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর এই হাডসন হিল থেকে যাব না।

ডাক্তার হাডসন ভ্রু কুঁচকে বললেন, কেন?

এই হাডসন হিল আমার দারুণ পছন্দের। আমার চিন্তা-চেতনা আর স্বপ্নে যে স্বর্গ, সেই স্বর্গ হলো হাডসিন হিল। যতদিন বেঁচে থাকব, এখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার পাশে, তোমারই পরশে।

কী সুন্দর করে কথা বলছ তুমি আজ!

জেসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এখানে এলে আমার কেন যেন দারুণ ভালো লাগে। ভালোলাগাটা আরো বাড়ে যখন তুমি পাশে থাকে। এজন্য বলতে পারো, এই হাডসন হিলের প্রেমে পড়ে গেছি।

ডাক্তার হাডসন চোখ বড় বড় করে বললেন, হাডসন হিলের প্রেমে পড়লে আমার কী হবে?

হাডসন হিল তো তোমারই। হাডসন হিলের প্রেমে পড়া মানে তোমার প্রেমে পড়া। তুমি অনুমতি দিলে আমি চলে আসব।

হঠাৎ এখানে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছ কেন?

বাড়িতে না আমার আর ভালো লাগে না। সবাই জেনে গেছে যে আমার পেটে একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা যে তোমার তা আমি কাউকে বলতে পারছি না।

বলছ না কেন?

কারণ তুমি আমার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকো না। তুমি থাকো এই হাডসন হিলে। কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে চলে আসব। তখন যে কেউ এলে দেখতে পাবে তোমাকে। ইদানীং বড় খারাপ লাগছে বাবা-মায়ের জন্য। বড় কষ্ট পাচ্ছে তারা। অহেতুক সন্দেহ করছে রাশেদ ভাইকে।

রাশেদ ভাই কে?

আমাদের কলেজের বড় ভাই। সে আমাকে খুব পছন্দ করত। আমরা দূরে ঘুরতেও গিয়েছিলাম। তোমাকে সবকিছু খুলে বলছি এ কারণে যে

আমি তোমার কাছে কিছু লুকাতে চাই না। রাশেদ ভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিল সত্যি, তবে তা জোরালো ছিল না। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমি অনুধাবন করি, আমার ভালোবাসাটা মূলত তোমারই জন্য।

ডাক্তার হাডসন কিছু বললেন না। চুপ থাকলেন।

জেসমিন আবার বলল, তুমি কি আবার আমার উপর রাগ করলে? তোমাকে আমি সরল মনে সবকিছু খুলে বলেছি।

মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। বললেন, না জেসমিন, রাগ করিনি। বরং তোমার স্পষ্টবাদিতা এবং সরলতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমারওতো স্ত্রী ছিল, তাকে বড় ভালোবাসতাম। তুমি সবই জানো। এই সমুদ্রে হারিয়ে গেছে সে। ভেবেছিলাম জীবনে আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু তোমাকে দেখার পর বুঝতে পারি, তোমার জন্য আমার এক মহাসমুদ্র ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে। ঐ ভালোবাসা তোমাকে দিতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আসলে কি জানো, আমাদের অতীত নিয়ে না ভেবে বর্তমান নিয়েই ভাবা উচিত। সহজ সরল কথাটা হলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটাই সত্য। কী বলো তুমি?

এবার জেসমিন দুই হাত দিয়ে ডাক্তার হাডসনের বাহু ধরল। তারপর নিজের ভরটা ডাক্তার হাডসনের শরীরে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমিই আমার সব, সবকিছু। আমি চলে আসব, আসব আমার এই সাগর তীরের স্বর্গে, যে স্বর্গে শুধু আছো তুমি, আর থাকব আমি।

ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আমি তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।

জেসমিন আর কিছু বলল না। পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। সমুদ্রের ঢেউগুলো যখন পায়ে এসে পড়ছে দারুণ ভালো লাগছে জেসমিনের। আর বাতাসের ছোঁয়া তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা সে পাছে তার প্রিয় মানুষ ডাক্তার হাডসনের ছোঁয়া যার একটু স্পর্শের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে সারাটা দিন।

হাঁটতে হাঁটতে তারা এলো নীল পাথরের কাছে। ডাক্তার হাডসন বললেন, উপরে উঠবে?

উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল জেসমিন।

নীল পাথরে উঠতে হাঁপিয়ে গেল জেসমিন। সে পাথরের উপর শুয়ে জোরে কয়েকবার দম নিল। তারপর বলল, আসলে এখন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

ডাক্তার হাডসন বললেন, খুব স্বাভাবিক। তোমার শরীরে তুমি তো শুধু একা নও, আরো একজন আছে, নতুন অতিথি।

তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু…

কিন্তু কী?

একটা বিষয় লক্ষ করেছি। ও না বড় হচ্ছে না।

বড় হচ্ছে না মানে?

মাসখানেক ধরে যেন আগের মতোই আছে। এতদিনে পেটটা তো আরো উঁচু হওয়া উচিত ছিল, তাই না?

কীভাবে বুঝলে?

ইন্টারনেটে দেখেছি।

ব্যতিক্রম হয়। তুমি এত চিন্তা কোরো না। বরং তোমার বেশি বেশি খাওয়াদাওয়া করা উচিত। পুষ্টির অভাব হলে গর্ভের সন্তান বড় হয় না।

তুমি একেবারেই খাওয়াদাওয়া করো না। কেন?

ভালো লাগে না।

এটা ঠিক না। ভালো লাগতেই হবে।

তোমার এখানে আসার পর খাব।

আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি এলে আমারও ভালো লাগবে। বড় বেশি অনুভব করি তোমাকে। একা একা আমারও ভালো লাগে না।

আমি চলে এলে তোমার একাকিত্ব আর থাকবে না।

কথার মাঝে বাতাসের ঝাঁপটায় চুল এসে পড়ল জেসমিনের মুখে। সেই চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ডাক্তার হাডসন হালকা একটা চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে। জেসমিন নিজেই এবার এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, দারুণ ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, কখনোই না, তুমিই আমার জীবন, তুমিই আমার প্রাণ।

*

নিলুফার বসে আছেন জেসমিনের সামনে। জেসমিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। নিলুফার বললেন, সিদ্ধ ডিমটা খেয়ে নে। শরীর ভালো থাকবে।

জেসমিন না তাকিয়েই বলল, আমার শরীর ভালো আছে মা।

তুই বললে তো হবে না। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোর শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে।

তুমি আমাকে নিয়ে এতটা ভেবো না।

তোকে নিয়ে না ভাবলে কাকে নিয়ে ভাববো?

জয় জনিকে নিয়ে ভাবো। ওরা ছোট।

নিলুফারের খুব রাগ উঠছে। কিন্তু তিনি ঠিক করে রেখেছেন আজ রাগবেন না। তাই নিজের রাগটা সামলে বললেন, বলতো, তুই রাতে লাল শাড়ি পরিস কেন?

জেসমিন খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আমার ভালো লাগে মা।

শাড়ি পরে ঘুমাতে ভালো লাগবে কেন?

তুমি বুঝবে না।

কেন বুঝব না?

মা, আমি তো বড় হয়েছি, তাই না? আমার নিজের কিছু সিদ্ধান্ত আছে না! এখনো কি সবকিছুতে তোমরা মতামত দেবে? আমার পছন্দ অপছন্দ বলে কি কিছু থাকবে না?

তুই এরকম রেগে যাচ্ছিস কেন?

কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। এখন তুমি যাও মা। খাবার থাক, ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নেব। আর আমার খাবার নিয়ে তুমি আর কখনো চিন্তা করবে না। আমি নিজেই নিজের যত্ন নিতে পারি।

নিলুফারের ইচ্ছে হলো জেসমিনের গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। কিন্তু কাজটা করলেন না তিনি। আগের মতোই অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলালেন। তার ইচ্ছা ছিল জেসমিনের গর্ভের সন্তানটা নিয়ে কথা বলবেন আজ। কিন্তু জেসমিনের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলেন এখন আর ঐ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তাই তিনি বের হয়ে নিজের কক্ষে এলেন। এসে দেখেন চেয়ারে বসে কী যেন লিখছেন নাজমুল হোসেন। জানতে চেয়ে বললেন, কী লিখছ?

বদলির আবেদন।

মানে!

এখানে আর থাকা যাবে না।

কেন?

বুঝতেই পারছ। জেসমিন যে সন্তানসম্ভবা তা সবাই জেনে গেছে। আশেপাশের মানুষগুলো এখন কীভাবে যেন আমার দিকে তাকায়। ছাত্রছাত্রীদের দিকেও তাকাতে পারি না আমি। এই রকম পরিস্থিতিতে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। আশেপাশের উপজেলায় চলে যেতে হবে।

তাহলে তো এই বাড়ি ছাড়তে হবে।

ভাড়া দিয়ে দেব।

কী বলছ?

আমি তো আর কোনো বিকল্প দেখছি না। মান-সম্মান নিয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। জেসমিনের জন্যও খারাপ লাগছে। ওর মানসিক অবস্থা নিশ্চয় আমাদের থেকে খারাপ।

জেসমিন তো নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছে।

তা করেছে। কিন্তু এখন তো আর তাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব না। বাচ্চাটাকে জন্ম দিতেই হবে। তখন তাকে লালনপালন করা, বড় করা সবই করতে হবে।

নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা কি দূরে কোনো জায়গায় বাচ্চাটার জন্ম দিতে পারি? তারপর হয়তো কোথাও রেখে আসলাম।

কোথাও রেখে আসব মানে?

এই যেমন ধরো, এতিমখানা।

তোমার কি মাথা খারাপ! জেসমিন মানবে নাকি? সে তো এখন পর্যন্ত বলল না বাচ্চার বাবা কে?

আমি নিশ্চিত রাশেদ।

প্রমাণ ছাড়া নিশ্চিত হওয়া কি ঠিক হবে?

তা হবে না। তবে একটা উপায়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারব। রাশেদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করে দিতে পারি। তখন ডিএনএ টেস্ট করতে হবে রাশেদকে। আমার বিশ্বাস বাচ্চা আর রাশেদের ডিএনএ মিলে যাবে।

সত্যি কথা বলতে কি কোনো মামলা-মোকদ্দমায় আমি যেতে যাচ্ছি না। এতে গন্ধ আরো বেশি ছড়াবে! পুলিশ জানতে চাইবে, উকিল জেরা করবে, শত্রুতা বাড়বে এলাকায়।

নিলুফার আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর জানতে চাইলেন, ডাক্তার তরফদার কিছু বলেছেন? উনি কি কিছু করতে পারবেন?

মনে হচ্ছে না। আজ সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন। জেসমিনের রিপোর্টগুলো নিয়ে যেতে বলেছেন। ভাবছি যাব কি না।

আমার মনে হয় যাওয়াটাই ভালো হবে। ভদ্রলোক যেহেতু নিজে ফোন করেছেন, আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো তথ্য তিনি দিতে পারবেন।

তা পারবেন। কিন্তু কী লাভ তাতে? জেসমিন আর ওর বাচ্চাটার কী হবে?

আসলে পোড়া কপাল আমাদের! এই বয়সে এসে এমনভাবে বেইজ্জতি হতে হবে কোনোদিনও ভাবতে পারিনি।

মন খারাপ কোরো না। লক্ষ রেখো জেসমিনের উপর। আবার যেন আত্মহত্যা করতে না যায়।

ঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে যদি আত্মহত্যা করে ঠেকাব কীভাবে?

নাজমুল হোসেন এবার চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, তুমি এখন থেকে রাতে জেসমিনের পাশে ঘুমাতে পারো। তাহলে ও আর আত্মহত্যা করার সুযোগ পাবে না।

জেসমিন কি আমাকে তার পাশে ঘুমাতে দেবে? আমি তো তিন মাস আগে থেকেই বলতেছি, ও রাজি না। একা ঘুমাবে, এমনকি জয়, জনিকেও ঘুমাতে দেয় না পাশে।

বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভালো লাগছে না। এক কাপ চা খাওয়াবে?

দিচ্ছি। কিন্তু এই অসময়ে চা খাবে! ঘুম আসবে না তো।

দাও, অসুবিধা নেই।

সাথে আর কিছু দেব?

না।

পারলে জেসমিনের কাছে তুমি একটু যেও। তোমার কথা কম-বেশি হলেও শুনে। আমাকে কেন যেন ও পছন্দ করে না। যদি খাবারটা খাওয়াতে পারো বড় ভালো হয়।

ঠিক আছে যাচ্ছি।

নাজমুল হোসেন চেয়ার থেকে উঠে জেসমিনের কক্ষের সামনে এলেন। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এখন ঘুমানোর কথা নয় জেসমিনের। অথচ সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জেসমিন যে জেগে আছে নিশ্চিত তিনি। একবার ভাবলেন ডাকবেন, পরে বাদ দিলেন। অনুভব করলেন, কেমন যেন ভয় ভয় করে জেসমিনের সাথে কথা বলতে। কারণটা কী তা ঠিক জানেন না। তবে অনুধাবন করলেন, ‘হতাশাগ্রস্ত যে মানুষ আত্মহত্যা করতে চায় তাকে সবাই ভয় পায়। কারণ তার নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে না। যখন মানুষের নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে না তখন সে হয় সবচেয়ে দুর্বল কিংবা সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ।

*

ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে বসে আছেন। মনটা বেশ খারাপ। কারণ হামিদের বোন হুশনা তাকে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে,

শ্রদ্ধেয় স্যার,
আশা করি ভালো আছেন। আমি ভালো নাই। ভালো নাই হামিদ ভাইজানও। তার পাগলামি আগের চাইতে বাড়ছে। এখন অনেক বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করে। গ্রামের সবাই পরামর্শ দিতেছে তারে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। কিন্তু অত টাকা আমাগো নাই। আমার মনে হইতেছে, হামিদ ভাইজান বেশিদিন বাঁচবে না। ইদানীং বেশি ‘শিরিন শিরিন করতেছে। যদি শিরিনরে একবার আনা যাইত, মনে হয় অল্প হইলেও মনে শান্তি পাইত সে। অবশ্য জানি, বাস্তবে শিরিনরে নিয়া আসা কোনোভাবেই সম্ভব না। কারণ এখন সে অন্যের স্ত্রী এবং তার সংসার আছে। কেন যেন গতকাল হঠাৎ ভাইজান আপনের কথা বলতেছিল। আপনে নাকি শিরিনরে নিয়া আসবার পারবেন। জানি না, সত্য কি না। স্যার, চিঠি লিখা বিরক্ত করলাম। মনে কষ্ট নিয়েন না, সময়ে অসময়ে বিরক্ত করি। আসলে স্যার, আমি আমার ভাইজানরে বড় ভালোবাসি। পারলে একবার আইসেন। আপনের প্রিয় রুগীরে দেইখা যাইয়েন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
ইতি
হুশনা।

ডাক্তার তরফদার চিঠিটা পরপর দুবার পড়লেন। খামের উপর সিল দেখে বুঝলেন দুই দিন আগে চিঠিটা লিখেছে হুশনা। হুশনার এই একটা অভ্যাস, চিঠি লেখা। এই যুগে এইরকম মানুষ খুব কম আছে। হুশনার ভাষ্যমতে চিঠি লিখলে গুরুত্ব নাকি বেশি দেয়া হয়। হয়তো সত্য। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করছেন, সত্যি তার একবার যাওয়া উচিত হামিদকে দেখতে। কারণ হামিদ যে আসলেই বেশিদিন বাঁচবে না তা তিনি নিজেও অনুধাবন করছেন। তবে একবার যদি শিরিনের সাথে তার দেখা করিয়ে দেয়া যেত ব্যাপারটা মন্দ হতো না। এতদিন পর শিরিনকে দেখে হামিদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা অবশ্য ভাবার বিষয়। শিরিন থাকে সিলেটে। ধনাঢ্য এক ব্যক্তির স্ত্রী সে। বছরখানেক আগে ঠিকানা জোগাড় করেছিলেন তিনি। একবার ভেবেছিলেন যোগাযোগ করবেন। পরে আর করেননি। শিরিনের ফোন নম্বর জোগাড় করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পারেননি। সিলেটে গিয়ে তিনি অবশ্য তার সাথে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু তার ভয় আবার তার পারিবারিক জীবনে কোনো অশান্তি নেমে না আসে।

ডাক্তার তরফদার সিদ্ধান্ত নিলেন শিরিনকে একটা চিঠি লিখবেন। তবে সাংকেতিক ভাষায়। শিরিন যদি আজও হামিদকে ভালোবেসে থাকে, অবশ্যই সাড়া দেবে। কারণ, জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা হৃদয়ের দেয়ালে এমনভাবে অঙ্কিত থাকে যে চাইলেও মোছা যায় না।

বাঁশি, ডালিম’

ডাক্তার তরফদার মাত্র এই দুটি শব্দ লিখলেন মূল চিঠিতে। প্রেরক আর প্রাপকের ঠিকানা লিখলেন খামের উপরে। তারপর করিম চাচাকে দিলেন চিঠিটা পোস্ট করার জন্য। করিম চাচার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা রয়েছে। জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত যে শিরিন চিঠি পাওয়ার পর আসবে কি আসবে না। ডাক্তার তরফদার, কখনোই জিজ্ঞেস করেন না। তিনি পছন্দ করেন, জীবন তার গতিতেই চলুক, অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত কোনো ক্ষমতার পূর্বাভাসে নয়।

চেম্বারে আবার বসতে না বসতে নাজমুল হোসেন এলেন। কুশল বিনিময়ের পর নাজমুল সাহেব নিজে থেকেই বললেন, স্যার বড় বিপদে আছি।

ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বুঝতে পারছি, এজন্যই আসতে বলেছি আপনাকে। রিপোর্টগুলো এনেছেন?

হ্যাঁ এনেছি।

ডাক্তার তরফদার রিপোর্টগুলো দেখলেন। তারপর দেখলেন আলট্রাসনোগ্রামের ফিল্মগুলো। পেটে যে বাচ্চা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাড়ের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বললেন, নতুন একটা আলট্রাসনোগ্রাম কি করতে পারবেন? তাহলে বুঝতে পারতাম বাচ্চাটা কত বড় হয়েছে।

আমি তো করতে চাচ্ছি। কিন্তু রাজি হচ্ছে না জেসমিন। তার ধারণা জন্মেছে যে, আলট্রাসনোগ্রাম করলে বাচ্চার ক্ষতি হয়।

এখন কেমন আছে জেসমিন?

ভালো না, শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

কথা বলছে আপনাদের সাথে?

আপনি যেদিন গিয়েছিলেন তারপর দুটো দিন ভালো ছিল। এখন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। আর…

আর কী?

প্রায় প্রত্যেকদিন রাতেই লাল শাড়ি পরে ঘুমিয়ে থাকে। ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে।

পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া ভালো। কিন্তু লাল শাড়ি পরবে কেন?

জানি না স্যার। সকালে উঠে অবশ্য ও পরিবর্তন করে ফেলে। কিন্তু ওর মা সকালে পিছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছে লাল শাড়ি পরা থাকে জেসমিন।

প্রত্যেক রাতেই?

বলতে পারেন।

ডাক্তার তরফদারের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। বললেন, লাল শাড়ি কি জেসমিনের খুব প্রিয়?

এরকম কিছু ছিল না। আগে তো ও শাড়িই পরত না। শাড়িটা ওর মায়ের। নিয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার। তারপর আর ফেরত দেয়নি ওর মাকে। বড় অবাক হয়েছি।

বাঙালি নারীর শাড়ি পরা শুরু হয় মায়ের শাড়ি দিয়ে। মায়ের শাড়িই হয় তার প্রথম পছন্দের শাড়ি। তবে জেসমিনের লাল শাড়ি পরার যৌক্তিকতা ঠিক ঐরকম মনে হচ্ছে না। বিষয়টা রহস্যজনক।

নাজমুল হোসেন উপরে নিচে মাথা নেড়ে বললেন, আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না।

নতুনভাবে কাউকে কি সন্দেহ করছেন আপনারা?

নাজমুল হোসেন চুপ থাকলেন, কিছু বললেন না। কথা বলছেন না কেন?

আসলে, আসলে আমার মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভৌতিক। কোনো পিশাচের কাজ হবে এটা। সন্ধ্যার পর সম্ভবত ওর ঘাড়ে চড়ে বসেছে।

কী বলছেন এসব!

একজন ফকিরকে ডেকেছিলাম। কুতুব ফকির। সে বিষয়টা নিশ্চিত করেছে আর বলেছে ঐ পিশাচকে দূর করতে হবে, ছায়া হয়ে নাকি আসে। কাজটা সে-ই করবে।

কীভাবে দূর করবে?

ধোঁয়া দিয়ে দূর করবে। কী সব শিকড়ের ধোঁয়া! হাজার দশেক টাকা লাগবে। আমরা টাকা দিয়ে দিয়েছি। বড় বড় চোখ করে ডাক্তার তরফদার বললেন, কী বলছেন এসব! আপনি শিক্ষিত মানুষ! আপনি ভূত-প্রেত, পিশাচে বিশ্বাস করবেন কেন?

আসলে স্যার বিপদে পড়ে গেছি। মাথা ঠিক নেই।

ঐ কুতুব ফকিরের ফাঁদে পা দেবেন না। আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন। দেখি কিছু করতে পারি কি না।

আচ্ছা স্যার।

নাজমুল হোসেন চলে গেলে ডাক্তার তরফদার বাগানে এলেন। দেখলেন আকাশে অনেক মেঘ জমেছে, কালো মেঘ। সাথে বাতাসও আছে। তিনি বুঝতে পারলেন আজ বৃষ্টি হবে, অনেক বৃষ্টি। কেন যেন তার অবচেতন মন বলছে, এই বৃষ্টি মানুষের জন্য মঙ্গলময় হবে না, হবে ক্ষতির, মারাত্মক ক্ষতির। এটা একটা বাস্তব সত্য যে, বৃষ্টি সবসময় সবার জন্য সুন্দর আর মঙ্গলময় হয় না। দৃষ্টিনন্দন বৃষ্টিরও একটা কষ্টের রূপ থাকে।

ডাক্তার তরফদারের ভাবনার মধ্যেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতে চা মন্দ না। তাই তিনি রান্নাঘরে এলেন। দুধ চা বানালেন এক কাপ। তারপর নিয়ে এসে বসলেন চেম্বারে। জেসমিনের ফাইলটা টেনে লিখতে শুরু করলেন,

জেসমিন মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ, বিষয়টা নিশ্চিত। তার অসুস্থতার প্রধান কারণ তার গর্ভবতী হওয়া। কিন্তু কীভাবে সে গর্ভবতী হলো এ বিষয়টি রহস্যময়। তার পেটের সন্তানের বাবা রাশেদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও তৃতীয় কেউও হতে পারে। এই মুহূর্তে রাশেদ অবশ্য সন্দেহের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তবে তৃতীয় ব্যক্তিটি কে তা বড় রহস্যময়। এই রহস্য ভেদ করতে গিয়ে কিছু বিষয় নজরে এসেছে। প্রথম বিষয়টা হলো, ‘নীল চোখের ছায়া। এক্ষেত্রে নীল চোখের কেউ একজন তার পরিচিত বলে ধরে নিতে হবে, কিন্তু কে সে? দ্বিতীয় বিষয়টা হলো ‘লাল শাড়ি। রাতে জেসমিন মাঝে মাঝেই লাল শাড়ি পরে! কেন? বড় জটিল প্রশ্ন। একজন নারী শাড়ি পরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এবং তার নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। নিঃসন্দেহে এটাই সত্য যে, বাঙালি নারী সবচেয়ে সুন্দর শাড়ীতে। কিন্তু রাতে কেন শাড়ি পরবে জেসমিন? কোনো পুরুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য, নাকি নিজের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য দ্বিতীয় বিষয়টা সত্য হতে পারে, নিজের সন্তুষ্টির জন্য কেউ কেউ পছন্দের পোশাক পরে। নিজেকে সুন্দর দেখার এই প্রবণতার নাম নারসিসিজম (Narcissism)। কিন্তু জেসমিন নারসিসিজম-এ আক্রান্ত বলে মনে হয় না। কারণ দিনের বেলায় সে তার সৌন্দর্য নিয়ে যে খুব বেশি সচেতন থাকে, সেরকম কিছু জানা যায়নি। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, যা কিছু ঘটছে সবই কক্সবাজার থেকে আসার পর। কক্সবাজারে রেইনবো রেইন হোটেলে একা সে একটা কক্ষে ছিল। ঐ কক্ষে কেউ তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে কি না তা বিবেচনার বিষয় রয়েছে। ঐ কক্ষটাতে না গেলে জানা যাবে না। রেইনবো রেইন হোটেলের কক্ষ নম্বর ছিল ২২১। হোটেলে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে, সেরকম কোনো ঘটনার স্বীকার হতে পারে জেসমিন। বিষয়টা হয়তো এরকম যে, হোটেল বয় কিংবা অন্য কেউ কিংবা একাধিক ব্যক্তি রাতে তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে বাধ্য করেছে শারীরিক সম্পর্ক করতে। অর্থাৎ জেসমিন ধর্ষিত হয়েছে। লজ্জায় অপমানে সে হয়তো বলতে পারেনি কাউকে। হতে পারে তার কলেজের কোনো শিক্ষক কাজটা করেছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাত্রীদের জন্য বড় কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের শিক্ষাসফরে একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ শিক্ষক ছিল। যে দুজন পুরুষ শিক্ষক ছিল তাদের বয়স কত জানতে হবে তাকে। অবশ্য বয়স কোনো বিষয় নয়। নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পুরুষের বয়সের প্রয়োজন হয় না, যে কোনো বয়সের পুরুষ একজন অল্পবয়সি নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। এই আকর্ষণের মূল কারণ ‘টেসটেসটেরন হরমোন যা একজন মানুষের পুরুষ হিসেবে বেড়ে উঠার অন্যতম নিয়ামক যাইহোক, কক্সবাজারে যে কিছু একটা ঘটেছে এটা মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু এই যুক্তিটা মিলছে না এ কারণে যে জেসমিনের শরীরে কোনো ধস্তাধস্তির দাগ ছিল না, তাছাড়া সে চিৎকার করতে পারত। অবশ্য যদি পানীয় কিংবা অন্যকিছুর সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে অচেতন করা হয়ে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যাচ্ছে, লাল শাড়ি কেন পরে জেসমিন? উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা মূর্তির কথা এসেছে। কক্সবাজারে অনেক মূর্তি আছে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রতিমা, মূর্তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐ রকম কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় দেখতে যায়নি জেসমিন। তাহলে কোন মূর্তি দেখতে গিয়েছিল? প্রশ্নটা করতে হবে শান্তাকে কিংবা তার অন্য বন্ধু-বান্ধবীদের। যে কেউ একজনের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। অনুসন্ধানে আরো এসেছে পাহাড়-সমুদ্রের কথা। ঐ এলাকাটাও কক্সবাজার হবে। যাইহোক, সবকিছু মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে কক্সবাজারে রেইনবো রেইন হোটেলে যেতে হবে এবং খুঁজে পেতে হবে মূর্তির রহস্য।

ফাইলে উপরের অংশটুকু লিখে ডাক্তার তরফদার বারান্দায় এলেন। ঝড় শুরু হয়েছে, সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি। কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে রিকশা। দেখা গেল, তবে বাতাসের সাথে যেন পেরে উঠছে না তারা। দূরে কোথাও শব্দ হলো ভয়ংকর বজ্রপাতের। একজন মহিলাকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাতাসের বিপরীতে দৌড়াতে দেখা গেল যেন মহাবিপদে আছে সে।

ডাক্তার তরফদার আবারও উপলব্ধি করলেন, বৃষ্টি সবসময় সবার জন্য সুন্দর আর মঙ্গলময় হয় না। দৃষ্টিনন্দন বৃষ্টিরও একটা কষ্টের রূপ থাকে।

*

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।

নিলুফার বসে আছেন বারান্দায়। তার সামনে কুতুব ফকির। গলা থেকে পা পর্যন্ত কালো একটা পোশাক পরা। চুল-দাড়ি অনেক লম্বা। বয়স সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। পঞ্চাশও হতে পারে, ষাটের বেশিও হতে পারে। তাকে দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করছে নিলুফারের। ইচ্ছে হচ্ছে বলেন, যেন বাড়ি থেকে চলে যায়। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। কারণ তাকে নিয়ে এসেছে তারই জোবেদা খালা। জোবেদা খালার যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন নাকি এই কুতুব ফকির তাকে পড়া পানি খাইয়ে আর ঝাড়ফুক দিয়ে দোয়া করে বলেছিল, “যা তোর সন্তান হবে। ঐ দোয়া পাওয়ার এক মাসের মাথায় গর্ভবতী হন জোবেদা খালা। সেই থেকে তার ভক্ত জোবেদা খালা। জোবেদা খালা তার আত্মীয়, শারীরিকভাবে লম্বা-চওড়া। কথাবার্তায় সবসময় কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। এজন্য ঠিক নিষেধ করতে পারছেন না তাকে। বাড়িতে ফকির নিয়ে আসার এই ব্যাপারটা তার স্বামী নাজমুল হোসেনও পছন্দ করেননি। প্রথমে দোটানায় থাকলেও বিকেলে জানিয়ে দিয়েছেন যেন কুতুব ফকির এই বাড়িতে না আসে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য না করতে পারেননি নিলুফার। মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ আশার আলো ছিল যে সুস্থ হবে জেসমিন। কিন্তু এখন বড় ভয় করছে তার।

কুতুব ফকিরের সাথে একজন কিশোর এসেছে। সে তার সাগরেদ। নাম হাসু। বয়স ষোলো-সতেরো হবে। কুতুব ফকির চেয়ারে চোখ বুজে নির্দেশ দিচ্ছে আর সে সব কাজ করছে। কুতুব ফকির বলছে, হাসু।

ফকিরবাবা বলেন।

পিশাইচটা কি আছে?

আমি বলবার পারতেছি না।

তুই পারবি ক্যামনে? তুই ছোড মানুষ। আমি পারব। আছে, পিশাইচটা আছে। কালা কুইচকুইচা। এইরকম পিশাইচ খুব কমই দেখা যায়। জীবনে এই নিয়া আমি তিনবার দেখলাম। যাইহোক, গত দুইবার আমি ঐগুলারে তাড়াইছি, এইবারও তাড়াব। মরিচ কোথায় মরিচ?

মালশায় আছে বাবা।

কয়ডা মালশা?

পাঁচটা আছে।

ভালো। এই মরিচে বড় ঝাল, দামেও ঝাল। বেশি টাকা দিয়া কিনা লাগছে। মরিচগুলা সামনে রাইখা এক রাইত ধইরা মন্ত্র পড়া হইছে। মরিচের ধোঁয়ায় দৌড়াইয়া পালাবে পিশাইচ। যা, তুই বাড়ির চাইরপাশে চাইরডা মালশা রাইখা আয়। আর একটা মালশায় মরিচ পুড়াব জেসমিনের সামনে, শিকড়গুলা নিচে দিস। দেখি ওর শরীরে কতক্ষণ বইসা থাকবার পারে ঐ পিশাইচ।

জোবেদা খালা এবার নরম গলায় বললেন, আর কিছু লাগবে, বাবা?

আপাতত দরকার নাই। তয় কিছু খরচপাতি হইছে। নগদে কিছু শিকড় কিনা লাগছে, দাম বেশি। হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে।

হাজার পাঁচেক!

হ খরচটা একটু বেশিই। তয় কোনো উপায় নাই।

জোবেদা খালা নিলুফারের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস বললেন, পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আসো।

এত টাকা তো ঘরে নাই।

কত আছে?

তিন হাজারের মতো হবে।

ঐ টাকাই আনো। আমি আর দুই হাজার টাকা দিয়া দিতেছি। ফকির বাবারে অসন্তুষ্ট রাখা যাবে না। তাইলে পিশাইচ তাড়ানো কঠিন হইয়া পড়বে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বাড়িতে তিন হাজার এক শ টাকা ছিল। নিলুফার তিন হাজার টাকা এনে হাতে দিল জোবেদার হাতে। খালা তার নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করল আরো দুই হাজার টাকা। তারপর পাঁচ হাজার টাকা ফকির বাবাকে দিয়ে বলল, বাবা, পিশাইচটা যেন এই বাড়িতে আর না থাকে।

ফকির বাবা ধমকে উঠে বললেন, না, থাকবে না। এই বাড়িতে আর থাকবে না পিশাইচ। ওরে শুধু এই বাড়ি না, গ্রামছাড়া করব, দ্যাশছাড়া করব। যা কালাপিশাইচ যা, ভাগ এইখান থাইকা, ভাগ?

কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ির চারপাশে হাঁটা শুরু করল কুতুব ফকির। এককোনায় যাচ্ছে আর মালশার শিকড় মরিচে আগুন ধরাচ্ছে সে। যখন চারপাশের মালশায় আগুন জ্বালানো শেষ হলো তখন মরিচের ঝাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম সবার। নিলুফার বললেন, খালা, বাড়ির মধ্যে থাকা তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

কষ্ট হইলেও থাকা লাগবে।

ফকির বাবা এরপর ঢুকলেন জেসমিনের ঘরে। জেসমিন আগে থেকেই জানত যে তাকে ফকির দিয়ে ঝাড়ফুক দেয়া হবে। সে রাজি ছিল না। নিষেধও করেছিল তার বাবা মাকে। ভেবেছিল সত্যি ফকির আসবে না। কিন্তু এখন ফকির দেখে রাগে কাঁপতে শুরু করল সে। তার উপর মরিত্রে ঝাঁজে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। নিজে থেকেই বলল, আমার ঘরে ঢুকবেন না কেউ।

কুতুব ফকিরের হাতে একটা মালশা। মালশায় এখনো আগুন ধরানো হয়নি। ধরালে ঘরের মধ্যে মরিচের ঝাজ আরো বাড়বে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জোবেদা খালা মুখের উপর কাপড় চেপে ধরে রেখেছেন। একইভাবে ঝাঁজ থেকে নিজেকে রক্ষা করছেন নিলুফার।

কুতুব ফকির বলল, পিশাইচটা আমারে ভয় দেখাইতেছে, ঘরে ঢুকবার নিষেধ করতেছে।

খবরদার ঘরে ঢুকবেন না।

চিৎকার করে উঠল জেসমিন।

কুতুব ফকির এবার জোরে ধমক লাগাল, চুপ হারামজাদা! কোনোরকম চেঁচামেচি করবি না। ভালোয় ভালোয় এই বাড়ি থাইকা বাইরায় যা, নইলে মরিচের ঝাল দিয়া তোরে পুড়ায় দিব।

না এই ঘরে মরিচ জ্বালাবেন না।

ক্যান জ্বালাব না। তোর শরীর জ্বলবে, মন জ্বলবে, না? আমি তো চাই তুই জ্বইলা পুইড়া শ্যাষ হইয়া যাবি। এখন পর্যন্ত জেসমিনের মতো কতজনের সর্বনাশ করছস? আর সুযোগ পাবি না। পুরা বাড়ি ধোয়ায় ছাইয়া গেছে। পালাবারও পারবি না। তোর আইজ মরণ হবে, মরণ।

কথাগুলো বলতে বলতে মালশাতে আগুন ধরাল কুতুব ফকি মরিচের তীব্র ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ঘরের মধ্যে। ঝাঁজ সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড় দিল জেসমিন। কিন্তু তার হাত ধরে বসল কুতুব ফকির। তারপর টেনে টেনে বলল, না তোরে পালাবার দিব না। তোরে আইজ আমি মাইরা ফেলাব, নিজের হাতে মারব। গামছা কই, দুইডা গামছা দ্যান, বাইন্দা ফেলাই ওরে।

জোবেদা খালা এবং নিলুফার দুজনের অবস্থাই খারাপ। চোখ, নাক দিয়ে পানি ঝরছে। এর মধ্যেই জোবেদা খালা বললেন, দুইটা গামছা দরকার, কোথায় পাব?

নিলুফার বললেন, না না। আমার মেয়েটা মরে যাবে। ওকে ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন। আর, ফকির বাবা, আপনি চলে যান। লাগবে না, লাগবে না পিশাচ তাড়ান।

কুতুব ফকির বলল, না না, আমার যাওয়া ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে পিশাইচডারে ছাড়াও যাবে না, তাইলে সর্বনাশ হইয়া যাবে। পিশাইচের সাহস বাইড়া যাবে। তখন আরো ক্ষতি করবে মানুষের। গামছা দ্যান, গামছা। শক্ত কইরা বাইন্দা রাখি। পুড়া মরিচের ঝাঁজ নাক-মুখ দিয়া শরীরে ঢকান লাগব। পিশাইচটা সমস্ত শরীরে বইসা আছে। তয় বড় কষ্ট হইতেছে পিশাইচের।

নিলুফার এবার এগিয়ে এসে নিজেই ছাড়িয়ে নিলেন জেসমিনকে। জেসমিন আর দাঁড়াল না। দৌড়ে ঢুকে গেল তার ঘোট দুই ভাইয়ের কক্ষে।

এদিকে খুবই রেগে গেল কুতুব ফকির। চোখ বড় বড় করে বলতে থাকল, এই বাড়িতে গজব পড়ক, গুজব। এত কাছে আইসাও মারবার পারলাম না পিশাইচটারে। আরো কতজনের যে সর্বনাশ করবে? না না, মানুষ কিছু বুঝে না, কিছুই বুঝবার চায় না, মানুষ বড় খারাপ, বড় খারাপ!

কথাগুলো বলে বাড়ির বাইরে বের হয়ে গেল কুতুব ফকির। তার পিছন পিছন গেলেন জোবেদা খালা। তিনিও খুব বিরক্ত এবং লজ্জিত নিলুফারের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য!

*

ডাক্তার তরফদারের আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল কক্সবাজার ঘুরতে আসবেন। কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। এবার সুযোগটা নিয়েছেন তিনি। একটা মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসেছেন। ড্রাইভার সালাম নামের এক যুবক। কখনো গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে সালামকে বলেন তিনি। যুবক বয়সি সালাম সবসময় হাসিখুশি থাকে। এজন্য সালামকে বেশ ভালো লাগে তার। ড্রাইভার হিসেবেও খুব ভালো। নিয়ম মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে গাড়ি চালায়। তাছাড়া তাকে খুব শ্রদ্ধাও করে। তিনি ডাকলে অন্য যত বড় কাজ থাকুক না কেন চলে আসবে সে।

রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর রুমটা বুক দিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার তরফদার। এজন্য ঐ রুমে উঠতে পেরেছেন। হোটেলটা মাঝারি আকৃতির। পাঁচতলা। এক তলায় ডাইনিং হল, রিসেপশন, ওয়েটিং রুম। দোতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত থাকার রুম। প্রত্যেক তলায় বিশটি করে রুম। শুধু দোতলায় একটা রুম বেশি। এই রুমটাই হলো ২২১ নম্বর। রুম হিসেবে অতিরিক্ত হওয়ায় কেমন যেন খটকা লাগল ডাক্তার তরফদারের। কেন দোতলায় একটা রুম বেশি করা হয়েছে। বিষয়টা রহস্যজনক।

এখানে আসার আগে ডাক্তার তরফদার জেসমিনদের কলেজের প্রভাষক রাবেয়া খাতুনের সাথে কথা বলে এসেছেন। রাবেয়া খাতুন শিক্ষা সফরে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন সবই বলেছেন ডাক্তার তরফদারকে। রাতে যে তার থাকার কথা ছিল জেসমিনের সাথে সে কথাও বলেছেন এবং তিনি যে থাকেননি তাও গোপন করেননি। তবে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ২২১ নম্বর কক্ষে এমন কোনো অঘটন ঘটেনি যা উল্লেখ করার মতো।

রাবেয়া খাতুনের কাছ থেকে হাডসন হিলের মূর্তির কথা জেনেছেন ডাক্তার তরফদার। ঐদিন যে জেসমিন লাল শাড়ি পরেছিল, বকা খেয়েছিল তাও জেনেছেন। পরে জেসমিনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু জেসমিন তার সাথে কথা বলেনি। শেষে কথা হয় জেহানের সাথে। জেহান অনেক বেশি হতাশ এখন। সে জানিয়েছে জেসমিনের শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে এবং কারো সাথে কথা বলে না ইদানীং। এজন্য সে নিজে খুব অস্থিরতায় ভুগছে। আর বরাবরের মতো জেসমিনের কাছে তার ভালোলাগার আর ভালোবাসার কথা এখনো বলতে পারেনি। ডাক্তার তরফদার আসার আগে তার মাথায় হাত রেখে বলেছেন, মনে রাখবে, ‘আবেগে নয়, ভালোবাসা হয় প্রকাশে।

হোটেলে ডাক্তার তরফদার সবচেয়ে পুরাতন একজন বয় খুঁজে বের করলেন। নাম উদিম। উপজাতীয় হলেও সে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। ম্যানেজারকে বলে দিলেন, উদিমই যেন তার রুমে কাজ করে। ম্যানেজার রাজি হলেন।

উদিম পানি নিয়ে এলে ডাক্তার তরফদার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বয়স কত উদিম?

চব্বিশ বছর।

কত বছর ধরে এই হোটেলে আছ?

স্যার দশ বছর। হোটেলের শুরু থেকেই।

তার মানে তোমার যখন বয়স চৌদ্দ তখন থেকেই তুমি কাজ শুরু করেছ এখানে। তাই না?

জি স্যার।

এত কম বয়সে কাজে নিল কেন তোমাকে?

বেতন কম দেয়া লাগত এজন্য স্যার। বড় মানুষ রাখলে টাকা বেশি দেয়া লাগে। আর ছোট মানুষ রাখলে পেটে-ভাতে রাখা যায়। আমাকে অবশ্য দুই হাজার টাকা বেতন দিত তখন, অন্যরা পেত ছয়-সাত হাজার টাকা।

এখন তোমার বেতন কত?

দশ হাজার টাকা।

তাহলে তো ভালোই। আচ্ছা একটা বিষয় বলো তো আমাকে, দোতলায় এই একটা রুম বেশি কেন? মানে এই ২২১ নম্বর রুমটা।

স্যার এই রুম করা হয়েছিল মালিকের ছেলের জন্য। সাধারণত ভাড়া দেয়া হয় না। তবে কাস্টমার বেশি হলে ভাড়া দেয়া হয়। বিশেষ করে শীতকালে ফাঁকা পাওয়া যায় না।

মালিকের ছেলে এই রুম দিয়ে কী করে?

মাঝে মাঝে আসে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে ফুর্তি করে।

আজ তো দেখছি একটা খাট। কখনো কি দুটো খাট ছিল?

প্রয়োজন হলে দিয়ে দেই স্যার। হোটেলে ছোট ছোট লোহার খাট আছে। উপরে ফোম। যখন যেখানে প্রয়োজন দিয়ে দেই। আপনের এই বেড তো ডবল বেড। আর একটা সিঙ্গেল খাট কি দিব? কেউ কি আসবে?

না আসবে না। যাইহোক, তোমার ঐ মালিকের ছেলে কোথায় এখন?

উদিম চুপ হয়ে গেল।

কী ব্যাপার, কথা বলছ না কেন?

স্যার জেলে আছে।

জেলে আছে মানে?

স্যার আসলে কী বলব, বড় লজ্জার কথা। এই কক্ষের মধ্যে সে এক মেয়েকে নিয়ে আসছিল। তারপর তার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে। ঐ মেয়ে পরে মামলা করে দিয়েছে বাশার স্যারের নামে। আসলে স্যার, বাশার হলো মালিকের ছেলের নাম।

ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, ঐ রাতে তুমি ছিলে এখানে?

না, স্যার। বাশার স্যারের ডিউটি করার জন্য আলাদা এক বয় আছে। নাম লিটন। আমার মতোই বয়স।

আমি কি লিটনের সাথে কথা বলতে পারব?

এখন ডিউটি নেই স্যার। ডিউটিতে আসলে আমি আপনার কাছে নিয়ে আসব।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

এখন কি খাবার দিব স্যার?

না, ক্ষুধা নেই। রাতে ডাইনিংয়ে গিয়ে খাব। ইচ্ছে একটু সাগরপাড়ে যাব। সারাদিনের জার্নিতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

ঠিক আছে স্যার। যখন প্রয়োজন হবে তখন ডাকবেন। আমি এই হোটেলেই থাকি। আপনি ডাক দিলে চলে আসব। আর এই কক্সবাজার এলাকা আমার চেনা। কোথাও যেতে চাইলে আমাকে বলবেন।

তা বলব। তুমি কি হাডসন হিল সম্পর্কে কিছু জানো?

আমি জানি স্যার, তবে বেশি জানি না। আনন্দভ্রমণ” বইতে লেখা আছে হাডসন হিল সম্পর্কে। আমি কি একটা বই আপনাকে দেব? পড়ে দেখতে পারেন।

ঠিক আছে দাও।

তবে কি স্যার…

হ্যাঁ, বলল।

আনন্দভ্রমণ’ বইতে যা লেখা আছে তা সব বিশ্বাস করবেন না। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। আর ওখানে কিছু টুরিস্ট গাইড আছে। টুরিস্টদের কাছ থেকে টিপস পাওয়ার জন্য নিজেদের মতো গল্প তৈরি করে। আপনি ওখানে গেলে বুঝতে পারবেন।

অবশ্য এটা সত্য, ডাক্তার হাডসন বড় ভালো মানুষ ছিলেন।

তুমি জানলে কীভাবে?

শুনা কথা।

ও আচ্ছা।

ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে জানতে হলে এমন কাউকে খুঁজে পেতে হবে যে ডাক্তার হাডসনের খুব কাছের ছিল। এরকম মানুষ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ এখন ২০২২ সাল। আর ডাক্তার হাডসনের ঘটনা ১৯৫০ সাল কিংবা তার কাছাকাছি সময়ের। অর্থাৎ সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগের। এক্ষেত্রে তাকে কমপক্ষে নব্বই কিংবা এক শ বছর বয়সি কাউকে খুঁজে পেতে হবে। বিষয়টা একেবারে সহজ না।

*

মাঝ রাত জেগে আছে জেহান। ঘুম আসছে না। ইদানীং তার ঘুম খুব কম হয়। শরীরটাও কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে। হয়তো ঘুম কম হওয়ার জন্য এমন হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আজ সে লম্বা একটা ঘুম দেবে। কিন্তু ঘুম যেন আজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। জেহান এবার বিছানা থেকে উঠে ডায়ারিটা নিল। তারপর লিখতে শুরু করল,

প্রিয় জেসমিন,
তোমাকে খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। কিন্তু সেরকম সুযোগ নেই। তুমি ইদানীং কারো সাথে কথা বলো না। একেবারে একা হয়ে গেছ। তোমার রুম থেকেও বের হও না। ঘন্টার পর ঘণ্টা ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা পাই না তোমার! মনে বড় কষ্ট আমার। এত ভালোবাসি তোমাকে, অথচ তোমার ভালোবাসা পাই না। জানি না পাব কি না। তোমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে সবকিছুর জন্য দায়ী রাশেদ ভাই, আমি জানি, কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন তুমি তার নাম বলছ না। আমি চাই তার শাস্তি হোক। যে অপরাধ সে করেছে, তার কোনো ক্ষমা নেই। তুমি তোমার জীবন নিয়ে অতটা চিন্তা কোরো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসাব। যদি তোমার সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তোমাকে পাওয়ার জন্য ঐ সন্তানসহ তোমাকে আমি গ্রহণ করব। সত্যি কথা বলতে কি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আর হ্যাঁ, রাশেদ ভাই যে সর্বনাশ তোমার করেছে তার জন্য তাকে পস্তাতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি দুই-একদিনের মধ্যে আমি প্রতিশোধ নেব। এত বড় একটা অপকর্ম করে সে পার পেতে পারে না, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। প্রিয়তমা আমার, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। ইদানীং খুব ইচ্ছে হয় তোমার হাত ধরে একটা দিন হাঁটি। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বড় বেশি কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার বাড়ির সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু পারি না। ডাক্তার তরফদার স্যার বলেছেন, আবেগে নয়, ভালোবাসা হয় প্রকাশে। তোমার জন্য আমার আবেগ, ভালোলাগা, ভালোবাসার অভাব নেই, অথচ আমি প্রকাশ করতে পারি না। এজন্যই আমার ভালোবাসা তোমাকে বোঝাতে পারছি না। এবার আমি যেভাবেই হোক প্রকাশ করার চেষ্টা করব। তরফদার স্যার আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। আর তা হলো, প্রিয়জনের কাছে প্রথম ভালোবাসার কথা বলে প্রকাশ করার থেকে লিখে প্রকাশ করা অনেক সহজ। আমি মুখে বলতে না পারলেও তোমাকে এ পর্যন্ত লেখা আমার সকল চিঠিগুলো দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখন তুমি বুঝতে পারবে আমার এই বুকে তোমার জন্য কত ভালোবাসা জমে আছে। অবশেষে, এই কামনা করি তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো। আর হ্যাঁ, ভাবছি, আগামীকাল ডাক্তার তরফদার স্যারের বাসায় যাব। ওখানে করিম চাচা আছে। সে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। আমি তার কাছে গিয়ে জানতে চাইব তোমাকে আমি আমার জীবনে পাব কি না। আশা করছি আশার আলো থাকবে করিম চাচার কথায়। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো প্রিয়তমা আমার।
তোমারই ভালোবাসার
জেহান

চিঠি লেখা শেষ হলে আবার বিছানায় এলো জেহান। এবার শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুম, ঠিক যেমনটা সে আশা করেছিল।

সকালে কলেজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো জেহান। বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে এপার আসতে ফুটপাতে এক গণককে বসে থাকতে দেখল। সে টিয়াপাখির মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করে। জেসমিনের কথা বলাতে গণক বলল, কোনো চিন্তা করবেন না, টিয়াপাখি শতভাগ সঠিক উত্তর দেবে।

কত টাকা লাগবে?

মাত্র দশ টাকা।

এই যে দশ টাকা নিন।

টাকা হাতে নিয়ে গণক টিয়াপাখিকে বলল, বাবা, তুমি আমাগো জানাও তো জেহান ভাইজান জেসমিনরে পাবে কি না?

টিয়া লাফ দিয়ে ডানে বামে গেল দুবার। তারপর নিচে রাখা অসংখ্য খাম থেকে একটা তুলে দিল গণকের হাতে। গনক মিষ্টি হেসে খামটা খুলল। তারপর বলল, এই যে দ্যাখেন ‘হ্যাঁ লেখা। তার মানে কী? আপনে আপনার জীবনে ভালোবাসার জেসমিনরে পাবেন।

জেহান খুব খুশি হলো। পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্ত বকশিশ দিল গণককে। তারপর রিকশা নিয়ে রওনা দিল ডাক্তার তরফদারের বাসার উদ্দেশে।

করিম চাচাকে পাওয়া গেল বাড়িতেই। তার কাছ থেকে জানতে পারল ডাক্তার তরফদার কক্সবাজার গেছেন। জেহানের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার তরফদারের সাথে কিছু কথা বলার। কিন্তু আজ আর সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে কিছুটা হলেও মন খারাপ হলো তার। শেষে করিম চাচার কাছে আসার কারণটাও খুলে বলল সে।

করিম চাচা বাড়ির ভিতরের বইগুলো ঝেড়ে রাখছিল। অনেকদিন এক জায়গায় থাকলে বইগুলোর উপর ধুলো জমে যায়। সবকথা শোনার পর করিম চাচা বলল, পৃথিবীতে প্রেম ভালোবাসা সবকিছু না, আরো মেলা কিছু আছে।

তারপরও আমি জানতে চাই জেসমিন আমাকে ভালোবাসবে কি না।

পৃথিবীর সব মানুষই সবাইরে ভালোবাসে।

আমি ঐ ভালোবাসার কথা বলছি না। প্রেম-ভালোবাসার কথা বলছি চাচা। আমি জানি, আপনি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। প্লিজ আমাকে বলুন।

ভবিষ্যৎ জানলে জীবনের প্রতি আগ্রহ কইমা যায়।

তারপরও আমি জানতে চাই।

এইডা ঠিক না।

আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বড় বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার।

করিম চাচা জেহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি চা বানায় আনতেছি, চা খাইলে ভালো লাগবে।

না, আমি চা খাব না।

পৃথিবীতে অনেক কিছু খাবার ইচ্ছা না করলেও খাইতে হয়, অনেক কিছু করবার না চাইলেও করতে হয়। উলটাভাবে, অনেক কিছু করবার ইচ্ছা থাকলেও না কইরা বইসা থাকতে হয়, অনেক কিছু চাইলেও না পাইয়া দুঃখ কষ্ট বেদনা সহ্য করতে হয়। পৃথিবী যেমন পাওয়ার, তেমন না-পাওয়ারও। পৃথিবী যেমন সুখের, তেমনি দুঃখেরও।

আপনার কথাগুলো বড় জটিল করিম চাচা। আমি বুঝতে পারছি না, স্পষ্ট করে বলুন। আমি সুখী হতে চাই, সত্যি জেসমিনকে নিয়ে সুখী হতে চাই।

আমি চা নিয়া আসতেছি।

কথাগুলো বলে করিম চাচা রান্নাঘরে গেল। চা নিয়ে ফিরে এসে দেখল যে জেহান নেই। করিম চাচা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে আবার বইয়ের উপর মনোনিবেশ করল।

জেহান এবার এলো কলেজে। খুব উত্তেজিত হয়ে আছে সে। উত্তেজনার মূল কারণ রাশেদ। কলেজের মাঠের কোনায় একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। এই মেয়েটার সাথেই নতুন প্রেম শুরু করেছে সে। জেহান সিদ্ধান্ত নিল যেভাবেই হোক শায়েস্তা করবে জেহানকে। এজন্য তার একটা ছুরি দরকার। ছুরিটা সে কলেজের পাশের বাজার থেকে কিনল। বেশ ধারালো ছুরি, কাউকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট।

*

রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর কক্ষে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য জেসমিন এখন গর্ভবতী, এই বিষয়টাকে ডাক্তার তরফদার একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। বিষয়টা যদি ধর্ষণ পর্যায়ের হয়ে থাকে, স্বাভাবিকভাবে লাজলজ্জার ভয়ে জেসমিন কাউকে কিছু বলতে চাইবে না। হয়তো সেরকম কিছু ঘটেছে। কিন্তু বিষয়টা প্রমাণ করা বড় কঠিন। কারণ একটা ব্যাপার তিনি বুঝতে পারছেন না, বাইরে থেকে ভিতরে কেউ প্রবেশ করবে কীভাবে? মূল দরজায় এবং বারান্দার সাথের দরজায় ছিটকিনি রয়েছে। এক্ষেত্রে বাইরে থেকে কারো পক্ষে ভিতরে প্রবেশ করা অসম্ভব। হতে পারে কেউ আগে থেকে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু যুক্তিটা বড় অবাস্তব। একজন অপরাধী এত বড় ঝুঁকি কীভাবে নেবে? অবশ্য যদি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র হয়, যাকে বলে অর্গানাইজড ক্রাইম, তাহলে হয়তো সম্ভব হতে পারে। বিষয়টাকে ডাক্তার তরফদার বেশ গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আনন্দভ্রমণ’ বই পড়ে হাডসন হিল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পেলেন না ডাক্তার তরফদার। একদিন আরো খোঁজখবর নিলেন। কিছুদিন হলো জায়গাটা পরিচিত পেয়েছে পর্যটন স্পট হওয়ার কারণে। হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে উদিমকে পাঠিয়েছিলেন হাডসন হিলে বয়স্ক কোনো মানুষ পাওয়া যায় কি না খুঁজে বের করার জন্য। উদিম একজনকে খুঁজে পেয়েছে। নাম ইরফান আলী। জনশ্রুতি আছে তার বয়স এক শ বছর। একসময় ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। এখন বাড়িতেই থাকেন।

ডাক্তার তরফদার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রথমে তিনি হাডসন হিলে যাবেন। জায়গাটা দেখার জন্য তার নিজের মধ্যেই এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এরকম পরিকল্পনা থেকে সকাল আটটার সময় রওনা দিলেন হাডসন হিলের উদ্দেশে। সাথে ড্রাইভার সালাম আর হোটেল-বয় উদিম। উদিম থাকায় পথ চিনতে সমস্যা হলো না। হাডসন হিলে এসে ডাক্তার তরফদার বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত সুন্দর জায়গা! সাগরের তীর ঘেঁষে উঁচু উঁচু পাহাড়। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা হাডসন হিল। সামনে ছোট-বড় গাছ। তারপর সমুদ্রের তীর আর সাগর। পাহাড়ের উপরের অংশটা দারুণ সবুজ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু গাছ এত বড় যে কল্পনা করা যায় না।

হাডসন হিলে আট-দশজন দেশি পর্যটক হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি প্রথমে এলেন এলিজা স্টোন বা নীল পাথরে। উপরে উঠে চারদিকে তাকাতে এক কথায় নয়ন জুড়িয়ে গেল তার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাতটা এখানেই কাটাবেন। দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় ঘুরেছেন, কিন্তু এরকম জায়গায় কখনো এসেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। শরীরে বাতাসের পরশ এতটাই আরামদায়ক যেন মনে হয় সকল অস্বস্তি আর অসুস্থতাকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

পাথরের উপরে অনেকে অনেককিছু লিখেছে। ডাক্তার তরফদার ছবি তুললেন, ভিডিও করলেন যেন পরবর্তীকালে যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণে কাজে লাগাতে পারেন। অতঃপর এলেন হাডসন গুহায়। ভিতরটা দেখে একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলেন। গুহার পিছনের দিকে একটা বিশাল মূর্তি। সেই মূর্তির সামনে সাদা পাথরের চত্বর। এখানে সাদা পাথর থাকার কথা নয়। কীভাবে এলো তা এক বিস্ময়! মূর্তিটার পরনের পোশাক অনেকটা পায়জামা পাঞ্জাবির মতো। চারপাশের দেয়ালে অনেক নাম লেখা। পুরো গুহাটার অনেক ছবি তুললেন তিনি, ভিডিও করলেন চারপাশটা। কেমন যেন ঠান্ডা ভিতরের অংশে, পরিবেশটা বেশ আরামদায়ক। একপাশে পাথুরে চৌবাচ্চায় পানি জমে থাকতে দেখলেন, পরিষ্কার পানি।

মূর্তিটার একেবারে কাছে এলেন ডাক্তার তরফদার। পাথরের তৈরি মূর্তি। পাহাড়ের সাথে যে পাথর থাকে সেই পাথর কেটে বানানো হয়েছে। কাছে এলে বোঝা যায় মূর্তিটা কত বড়। এত বড় একটা মূর্তি ডাক্তার হাডসন নিজে বানিয়েছেন বিশ্বাস করা কঠিন। বহু সময় লাগবে। পেশাদার ভাস্কর ছাড়া পাথর দিয়ে মূর্তি বানানো সহজ নয়। অথচ এই কাজটিই করেছেন ডাক্তার হাডসন। অবশ্য একটা সন্দেহ কাজ করছে ডাক্তার তরফদারের মনে। ডাক্তার হাডসন কেন নিজের মূর্তি নিজে বানাবেন। তার বানানো উচিত ছিল তার স্ত্রী এলিজার মূর্তি! অবশ্য পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাজকর্ম অন্যদের সাথে মিলে না। সেই বিবেচনায় ডাক্তার হাডসনের নিজের মূর্তি বানানো সমর্থনযোগ্য হতে পারে।

স্থানীয় একজন টুরিস্ট গাইড পেলেন ডাক্তার তরফদার। নাম আকিব। তার কাছ থেকে জানতে পারলেন ব্রিটেনে ডাক্তার হাডসনের মৃত্যু হলেও তার আত্মা নাকি এখানে চলে এসেছে।

ডাক্তার তরফদার উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কীভাবে বুঝলেন যে তার আত্মা এখানে থাকে?

রাতে অনেকেই দেখেছে স্যার।

কী দেখেছে?

একটা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষ ঘুরে বেড়ায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কী রঙের পাঞ্জাবি?

নীল রঙের।

ও আচ্ছা। আপনি কখনো দেখেছেন?

না স্যার, দেখিনি। তবে একবার চেষ্টা করেছিলাম। শুনেছিলাম সন্ধ্যার পর গুহা থেকে বের হয় তার আত্মা। আমি আর আমার তিন বন্ধু রাত নয়টা পর্যন্ত ছিলাম। তারপর আর থাকতে পারিনি। ভয়ে শরীর কেমন যেন ছমছম করছিল।

এমন কেউ আছে যে রাতে ডাক্তার হাডসন বা তার আত্মাকে দেখেছে?

আমাদের গ্রামে আছে। নাম মোবারক।

আমি কি মোবারকের সাথে কথা বলতে পারি?

পারেন স্যার। আমি ব্যবস্থা করব। তাকে কি ডাক দেব?

দিতে পারেন।

আর একটা কথা স্যার। কী কথা?

ডাক্তার হাডসন কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার উপর ভর করে বসে।

কী বলছেন এসব!

জি স্যার। আসলে তার স্ত্রী ‘এলিজা এখানে মারা গিয়েছিল তো, তাই তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। তখন থেকেই মেয়েদের প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখলে তার আত্মা ঐ মেয়ের প্রতি এখনো আগ্রহ অনুভব করে। মেয়েরাও ডাক্তার হাডসনকে খুব পছন্দ করে। কারণ বিদেশি ফর্সা মানুষ। গ্রামে অনেক মেয়েই নাকি ডাক্তার হাডসনকে রাতে তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছে!

এমন কোনো মেয়ে পরিচিত আছে?

আমার নেই। তবে খুঁজলে বের করতে পারব।

পারলে ভালো হতো। আর আপনি কীভাবে জানলেন যে ডাক্তার হাডসন সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করে?

এই কাহিনি সবাই জানে, আমার মতো যত ট্যুরিস্ট গাইড আছে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর দেখবেন, যত মেয়ে এখানে আসছে সবাই ছবি তুলছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে।

এটা তো স্বাভাবিক যে তারা ছবি তুলবে। কারণ ডাক্তার হাডসনের মূর্তি তো আর কোথাও নেই। জীবনে হয়তো তারা এই সুযোগ একবারই পাবে। স্মৃতিটা ধরে রাখতে কে না চায়!

না স্যার, এত সহজভাবে নিবেন না বিষয়টা। বছর ত্রিশেক আগে এখানে এক সুন্দরী মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বয়স আঠার-উনিশ হবে। লাশটা পাওয়া গিয়েছিল সাগরের তীরে। শুধু ছায়া আর ব্লাউজ পরা ছিল। লাল শাড়িটা খানিকটা দূরে পড়ে ছিল। ঐ মেয়েটা কোথা থেকে এসেছিল জানা যায়নি। আশেপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হদিস মেলেনি তার বাবা-মায়ের।

আপনার বয়স কত?

স্যার বাইশ বছর।

তো ত্রিশ বছর আগের ঘটনা কীভাবে জানলেন?

সবাই জানে স্যার। যাকে জিজ্ঞেস করবেন সে-ই বলবে।

লাশটা কী করা হয়েছিল?

মাটি দেয়া হয়েছিল। পরে কবরের ভিতর থেকে লাশটা আবার বের করেছিল কেউ। ধারণা করা হয় ডাক্তার হাডসনের আত্মাই করেছিল কাজটা।

কী বলছেন!

দ্বিতীয়বার মাটি দেয়ার পর অবশ্য ডাক্তার হাডসন কিংবা তার আত্মা আর আসেনি কবরের কাছে। তবে অনেকে বলে, ঐ মেয়েটার সাথে নাকি এখনো ডাক্তার হাডসন ঘুরে বেড়ায়। ডাক্তার হাডসনের সাথে মেয়েটার আত্মাও আছে এই হাডসন হিলে।

ডাক্তার হাডসন যদি মেয়েটিকে হত্যা করে থাকে তাহলে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন?

আমি বলতে পারব না স্যার। মোবারক বলতে পারবে।

আচ্ছা ঠিক আছে, মোবারককে ডাকার ব্যবস্থা করুন, দেখি সে কী বলে।

মোবারক এলো আধঘণ্টা পর। এই আধঘণ্টা ডাক্তার তরফদার চারপাশটা ঘুরলেন। সত্যি ভালো লাগার মতো জায়গা। সাগরের ঢেউয়ের শব্দের পাশাপাশি গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে বাতাস যাওয়ায় একরকম শো শো শব্দ কানে আসে। এই দুটো শব্দ শুনতে বড় ভালো লাগে। একটা দিনের জন্য যদি কেউ এখানে বেড়াতে আসে নিঃসন্দেহে উপভোগ্য হবে দিনটা।

মোবারকের কাছ থেকে যে কাহিনি শুনলেন তা হলো, ‘মোবারক দুই বছর আগে ডাক্তার হাডসনকে এই হাডসন হিলের বিচে হাঁটতে দেখেছিল। সময় ছিল মাঝরাত। সে আর তার গ্রামের আরো দুজন মিলে সাগরে মাছ ধরে ফিরছিল। তাদের কাছে মাছও ছিল। ডাক্তার হাডসন তাদের কাছে আসেন এবং মাছ চান। ভয়ে ঐ মাছ ফেলে দৌড় দেয় মোবারক আর তার দুই সঙ্গী। সকালে তারা আবার আসে মাছের সন্ধানে। মাছ পায়নি তারা, শুধু পেয়েছিল মাছের কাটা।

ডাক্তার তরফদারের বেশকিছু প্রশ্ন করার ছিল মোবারককে। কিন্তু তিনি রলেন না। কারণ অশরীরীয় আত্মায় তিনি বিশ্বাস করেন না। ষাট-সত্তর বছর আগে মৃত কোনো ব্যক্তির আত্মা এই সাগরতীরে ঘুরে বেড়ায়, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। তাই তিনি মনোযোগ দিলেন ইরফান আলীর সাথে সাক্ষাৎ করার বিষয়ে। ডাক্তার তরফদারের বিশ্বাস ইরফান আলী তাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।

*

জেহান কলেজে এসেছে। সে সুযোগ খুঁজছে কীভাবে রাশেদকে একা পাওয়া যায়। তাহলেই পেটের মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু সুযোগ সে পাচ্ছে না। রাশেদ সবসময় তিন-চারজন সঙ্গী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় দেখা হলো শান্তার সাথে। ডাক দিল তাকে। কাছে যেতে বলল, জেসমিনের কী অবস্থা?

আমি জানি না আপু।

তোমার তো বাড়ির পাশে। কথা বলো না কেন?

আমি গতকাল গিয়েছিলাম। কিন্তু খালাম্মা বলল, কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না জেসমিন। একা একা থাকতে চায় সবসময়।

এটা একটা কথা হলো। আমি যাব ভাবছি।

একটু থেমে শান্তা আবার বলল, তুমি কি সংবাদটা শুনেছ?

কী সংবাদ?

রাশেদ ভাই নতুন যে মেয়েটার সাথে প্রেম শুরু করেছে, নাম মুনিরা, ওর সাথে ঝগড়াঝাটি হয়েছে।

না শুনিনি। কেন?

ভয়ংকর সংবাদ।

কী ভয়ংকর!

চারদিকে এই কথা কানে ভাসছে যে মুনিরা প্রেগন্যান্ট। মুনির পেটে রাশেদ ভাইয়ের সন্তান। মুনিরা রাশেদ ভাইকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য কিন্তু রাজি হচ্ছে না রাশেদ ভাই।

কী বলছেন আপনি আপু!

হ্যাঁ। আমার ধারণা কি জানো?

কী?

জেসমিনের পেটের সন্তানও রাশেদ ভাইয়ের। রাশেদ ভাই অস্বীকার করছে।

কীভাবে সম্ভব! একজন মানুষ এতজন মানুষের সাথে সম্পর্ক করবে কীভাবে? এটা তো অন্যায়।

তোমাকে বললাম এ কারণে যে তুমি জেসমিনদের বাড়ির পাশে থাকো। আমি ভাবছি বিষয়টা আমি জেসমিন আর খালাম্মাকে জানাব। তুমি পাশে থাকবে। জেসমিনের বাচ্চার একটা সুরাহা করা দরকার। তা না হলে পিতৃপরিচয়হীনভাবে বাচ্চাটা বড় হবে। এটা হতে পারে না। তুমি এই ফাঁকে সত্যতা যাচাই করে নাও।

আপনি বলেছেন এটাই সত্য।

আমি বলেছি বলে নয়, মুনিরার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমাকে বলেছে।

কী হচ্ছে কলেজে এসব? প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছু করছেন না কেন?

কেউ তো দরখাস্ত দিচ্ছে না। জেসমিন দেয়নি, দেয়নি মুনিরাও। একটা দরখাস্ত দিলে তদন্ত হতো, তখন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিতে পারতেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার।

জেহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আর পদক্ষেপ আপা! যা করার আমাদেরই করতে হবে।

আমরা করব কীভাবে?

দেখি কী করা যায়। আপনি কখন যাবেন জেসমিনদের বাড়িতে?

তোমাকে ফোন করে জানাব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

জেহান কলেজে এলোমেলো কিছুক্ষণ ঘুরল। খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করল মুনিরার প্রেগন্যান্ট হওয়ার বিষয়ে। কিন্তু নিশ্চিত কোনো তথ্য পেল না। শেষে যখন চলে আসবে তখন দেখল কলেজের পুকুড়পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। নিজে থেকেই ডাক দিল তাকে।

জেহান যাবে কি যাবে না ভাবছে। কারণ রাশেদের সাথে একটি ছেলে আছে। অবশ্য সে কলেজের না, বাইরের কোনো জায়গার হবে। জেহানের বুকটাও ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। ছুরিটা পরিকল্পনামতো ব্যবহার করতে পারবে কি না সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে। আর তাছাড়া সে কোনো সাক্ষী রাখতে চায় না। অথচ পাশের ছেলেটা যাবে বলে মনে হলো না।

জেহান কাছে পৌঁছাতে রাশেদ বলল, কেমন আছিস তুই জেহান?

কথা শুনে খানিকটা ভড়কে গেল জেহান। কারণ রাশেদ তাকে ‘তুই’ করে বলছে। আগে ‘তুমি’ করে বলত। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ভালো ভাইয়া।

আমাকে তুই ভালোমতোই চিনস?

হ্যাঁ, চিনি।

আমি যতদূর জানি তোর বাপ অনেক বড়লোক। আমার কিছু টাকা দরকার। হাজার বিশেক। আমাকে ধার দেয়া লাগবে।

এত টাকা আমি পাব কোথায়?

তুই পাবি ক্যামনে? তোর বাপে দিবে। আনবার পারবি না?

না।